—প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গে শব্দদূষণ এখন একটি বহু-আলোচিত বিষয়। এই সংক্রান্ত ঘটনাবলির একটি উল্লেখযোগ্য দিন ধরা যেতে পারে ১ এপ্রিল ১৯৯৬। মেদিনীপুরের একটি সমিতি বনাম এক স্থানীয় অধিবাসীর মন্দিরে মাইক বাজানো সংক্রান্ত মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় রায় দিয়েছিলেন যে, রাত ৯টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত মাইক বাজানো যাবে না। আর শব্দের মান দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ঠিক করে দেবে। শব্দদূষণের মাত্রা অবশ্য কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ১৯৮৬ সালেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের বিধি অনুযায়ী, রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত রাত গণ্য হয়। ফলে, সেই সময়ে মাইকের ব্যবহার নিষিদ্ধ। উল্লেখ্য, মন্দির নিয়ে মামলার যে রায়, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের ধর্মীয় নেতারা তার বিরুদ্ধে আবেদন করেন। কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তা খারিজ করে দেয় ১৯৯৮-এর মার্চে। এর পর সুপ্রিম কোর্টে আবেদন খারিজ হয়ে যায় ২০০৫-এ। তার পর দুই দশক কেটে গেল— তা মানার কোনও লক্ষণ নেই। পরিবেশবাদীদেরও কোনও প্রতিবাদ নেই। সংবাদমাধ্যমও নীরব।
অথচ, এমন নয় যে শব্দদূষণ নিয়ে সাধারণ ভাবে নীরবতাই বিরাজ করছে। বাস্তবিক, ধীরে ধীরে ৬৫ ডেসিবেল কথাটা লোকের মুখেও শোনা যেতে থাকল। টেলিভিশন, রেডিয়োতে শব্দদূষণ নিয়ে সচেতনতা বার্তায়, সংবাদমাধ্যমে ৬৫ ডেসিবেল বেশ পরিচিত শব্দ হয়ে উঠেছে। অনেকটা এক সময় যেমন বন্যা হলেই কত কিউসেক জল ছাড়া হল বা বিদ্যুৎ চলে গেলে কত মেগাওয়াট কম— তা নিয়ে চায়ের দোকানে আলোচনা শুরু হয়ে যেত, ডেসিবেল সে রকম হতে শুরু করল। অথচ, ৬৫ ডেসিবেল বলে শব্দদূষণের কোনও সীমা নেই, এমন কোনও আইনও নেই।
যা আছে তা হল— বাণিজ্যিক এলাকায় (রাস্তাঘাট, বাজার) শব্দদূষণের সীমা হল ৬৫ ডেসিবেল সমতুল্য মান (এল-ই-কিউ), ৬৫ ডিবি(এ)এল-ই-কিউ। ‘এ’ অক্ষরটি বোঝায় যে শব্দ মানুষের কানে যে ভাবে শোনা যাবে, সে ভাবে মাপার যন্ত্রে নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ, ৬৫ ডেসিবেল আর ৬৫ ডেসিবেল সমতুল্য মান একেবারেই এক নয়। সমতুল্য মানের অর্থ একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে বিভিন্ন মানের শব্দ শোনা যাবে, তার একটি গড়। বাজারে বা রাস্তায় কেউ ৯০ ডেসিবেলে চেঁচালেই শব্দদূষণের সীমা লঙ্ঘন হয় না। তবে যে-হেতু ডেসিবেল এককটি লগারিদমিক মানদণ্ড (স্কেল), ফলে এর গড় সোজাসুজি পাটিগণিতের গড় নয়, এই গড় করতে প্রয়োজন বিশেষ সমীকরণ। সুতরাং, ৬৫ ডেসিবেল নিয়ে বাঙালির মাতামাতিটা একেবারেই ভুয়ো।
এর পর এল কালীপুজো, দীপাবলির পালা। কালীপুজো, দীপাবলি উদ্যাপনের অঙ্গ দীপ জ্বালানো এবং আতশবাজি, শব্দবাজি পোড়ানো। আসল কথা, বাজি ফাটানোই হয় তার শব্দের জন্য, কারণ অনেক মানুষ বাজির আওয়াজ উপভোগ করেন। তেমনই অনেকেই এর বিরোধী, সেই বিরোধিতা বাড়ছে। বিরোধিতায় পরিবেশ সংগঠনগুলি এখন খুবই সক্রিয় এবং সংবাদমাধ্যম এর গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। বাজির শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ শব্দবাজির শব্দের সীমা ৯০ ডেসিবেল ঘোষণা করে অনেক আগেই। এটি পর্ষদের কাজকর্মে দীর্ঘ কাল বাম মনোভাবের নিয়ন্ত্রণের ফসল।
এখন জানা যাক, ৯০ ডেসিবেল শব্দের প্রাবল্য কতটা, তাতে বোঝা যাবে এই মানের শব্দ আদৌ কতটা ভয়ানক। আপনি একটু জোরে কথা বললেই তার আওয়াজ ৯০ ডেসিবেল হতে পারে। দিনে সেটা আপনাকে অনেক বারই করতে হয়। কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে বলে না যে, আপনি রোজ বেশ কিছু বাজি ফাটান। ভারতের কারখানা আইন অনুযায়ী, এক জন শ্রমিক দিনে আট ঘণ্টা সময় ধরে ৯০ ডেসিবেল শব্দের মধ্যে কাজ করতে পারেন। এ শুনে যে কেউ নির্দ্বিধায় বলবেন যে, তা হলে ৯০ ডেসিবেল কোনও বাজির শব্দই নয়। আসলে ৯০ ডেসিবেল শব্দের কোনও বাজি হয় না, কেউ অর্থ ব্যয় করে সে বাজি কিনবেন না। আলোর বাজি থেকে শব্দবাজির দাম অনেকটাই কম, শব্দবাজি গরিবের বাজি। ৯০ ডেসিবেল বাজির গপ্পোটা তা হলে একেবারেই কাঁচা। এ বার আসা যাক ১২৫ ডেসিবেলের প্রসঙ্গে। ১৯৯৯ সাল থেকেই দেশের কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী শব্দবাজির সীমা ১২৫ ডেসিবেল। এত দিন পর এ বছর পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ নিজেদের পুরনো নিয়ম সংশোধন করে এখানেও দেশের নিয়ম চালু করেছে। ফলে, শব্দদূষণ বিরোধী পরিবেশবাদীরা সরব হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গকে যে অপসংস্কৃতির গহ্বরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, দূষণকারী বাজিশিল্পের কাছে রাজ্যকে বিক্রি করে দেওয়া হল ইত্যাদি অতিপরিচিত অভিযোগ।
ব্যাপারটা একটু বোঝা যাক। আমরা এত ক্ষণ আলোচনা করেছি একটানা বা নিরবচ্ছিন্ন শব্দ নিয়ে। শব্দবাজি কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন শব্দ নয়, সেটা এক বারই ফেটে শব্দ করে, যা থাকে এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের সময়ে। কারখানার ভাষায় একে বলা হয় সংঘর্ষজাত বা ঘাতজ শব্দ। যেমন— হাতুড়ি পেটার শব্দ বা কোনও যন্ত্র দ্বারা ক্রমাগত কোনও বস্তুকে আঘাত করার শব্দ। এ রকম ধরনের শব্দের কারখানায় আইনি সীমা থাকে। কারখানায় এক জন শ্রমিক ১২৫ ডেসিবেল ঘাতজ শব্দ আট ঘণ্টায় ৩১৬০ বার শুনতে পারেন। অর্থাৎ, আপনি ১২৫ ডেসিবেলের বাজি আট ঘণ্টায় ৩১৬০টি ফাটালে কোনও সমস্যা নেই। আপনি তো ঘণ্টাদুয়েক বাজি ফাটাবেন। ফলে ৮০০টি বাজি ফাটাতেই পারেন, যদিও দু’ঘণ্টায় আপনি গোটা পঞ্চাশ বাজির বেশি ফাটাতে বোধ হয় পারবেন না। এ ছাড়া চার দিকে ফাটা অনেক বাজির শব্দ, সেগুলোকে কি যোগ করতে হবে? না, করতে হবে না। দূরত্বের সঙ্গে এবং আশপাশের বাড়িঘর-গাছপালার প্রভাবে শব্দের প্রাবল্য অনেক কমে যায়। যেমন, একেবারে ফাঁকা জায়গায় ১০ মিটার দূরে ১২৫ ডেসিবেলের বাজি ফাটলে তা আপনার কানে শোনাবে ৯৪ ডেসিবেল। যা কিছুই নয়। এই শব্দের প্রাবল্য আর ওই আপনার ফাটানো ১২৫ ডেসিবেলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোনও শব্দমান বাড়াবে না। সুতরাং, পাড়ায় দূরে ফাটা বাজিরা কোনও সমস্যা তৈরি করতে পারবে না। এই সংক্রান্ত গাণিতিক বিষয়টি এখানে আলোচনা করা হল না। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে ধন্যবাদ যে, তারা সর্বভারতীয় পথে হেঁটে ৯০ ডেসিবেলের কৌতুক মুছে দিয়ে ১২৫ ডেসিবেলের বাস্তব সীমাকে মান্যতা দিল।
এ বার একটু সাহেবসুবোদের ব্যাপার দেখা যাক। ব্রিটেনে বসতি অঞ্চলের ভিতরে বাজি ফাটানোর শব্দসীমা ১২০ ডেসিবেল। আর খোলা জায়গায় সেই সীমা আর একটু বেশি। ফ্রান্সেও প্রায় একই রকম। এটা মনে রেখে দূষণসীমা নির্ধারণ, এবং সমস্ত রকম ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ হলে বলা যেত সত্যিই শব্দদূষণের নিরাময় প্রচেষ্টা চলছে। কিছু ক্ষেত্রে সক্রিয়তা, কিছু ক্ষেত্রে নীরবতা— শেষ অবধি উদ্দেশ্যটিই নষ্ট করে দেয়।
সব শব্দকে দূষণ বলা যায় না। কিন্তু স্থান, কাল ও মাত্রার বিধিনিষেধ গ্রাহ্য করেই তা পালনীয়। এবং সর্ব ক্ষেত্রে একই ভাবে পালনীয়। তা না হলেই ঘটে চলবে এই দূষণের শব্দ কল্প দ্রুম্।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy