পীঠস্থান: ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি-র অফিস
কয়েক জন অল্পবয়সি বাঙালি যুবা কলকাতা শহরে একটি ছোট্ট সিনে ক্লাবের গোড়াপত্তন করেন ১৯৪৭-এর ৫ অক্টোবর। এঁদের মধ্যে কেউ সাংবাদিক, কেউ বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী, কেউ বা শিল্পী। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সঙ্গে কারও প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই, কিন্তু প্রত্যেকের মধ্যেই ফিল্ম নিয়ে অবাধ কৌতূহল আর এক রাশ স্বপ্ন। এঁদের আদর্শ প্যারিস শহরের সিনে ক্লাব, যেগুলি ১৯২০-র শেষ ভাগ থেকে ফরাসি জনসাধারণকে নানা দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিল। যুদ্ধ-পরবর্তী ফ্রান্সে এই সব সিনে ক্লাব থেকেই বিনির্গত হন সমালোচক অঁাদ্রে বাজাঁ, কাইয়ে দ্যু সিনেমা বা পজ়িটিভ-এর মতো চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা, এবং গদার, ত্রুফো, রোমার, রিভেৎ-র মতো সমালোচক এবং বহু বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা।
কেবলমাত্র ভাল ছবি দেখা নয়, চলচ্চিত্রকে সমাজ গঠনের এক অপরিহার্য অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার বার্তা নিয়েই ‘ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ (সিএফএস)-এর বুনিয়াদ। শুধু বিনোদন বা বাণিজ্যের স্বার্থে নয়— সাহিত্য, থিয়েটার এবং অন্যান্য চারুকলার পাশে যদি সিনেমাকে অধিষ্ঠিত হতে হয়, তা হলে ছায়াছবি ঘিরেও মননশীল চর্চা এবং লেখালিখি প্রয়োজন। দেশ স্বাধীন হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, হিরণ সান্যাল, রাধামোহন ভট্টাচার্য সিএফএস স্থাপন করেন। শুনেছি সিএফএস-এর গ্রন্থাগারিক ছিলেন পূর্ণেন্দু নারায়ণ এবং ট্রেজারার মনোজেন্দু মজুমদার, যদিও গোড়ার দিকে অর্থ এবং গ্রন্থ, দুটোরই চূড়ান্ত অভাব ছিল। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
এটা বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, সিএফএস ভারতবর্ষের প্রথম ফিল্ম সোসাইটি নয়। ১৯৬৪’র ইন্ডিয়ান ফিল্ম সোসাইটি নিউজ় পত্রিকাতে প্রকাশিত একটি প্রশ্নমালা থেকে জানা যায় যে, ব্রিটিশ আমলে বম্বেতে দুটো ফিল্ম সোসাইটি ছিল— ‘অ্যামেচার সিনে সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ (১৯৩৯) এবং ‘বম্বে ফিল্ম সোসাইটি’ (১৯৪৩)। কিন্তু দুটোরই নির্মাতা এবং বেশির ভাগ সদস্য সাহেব। সিএফএস কিন্তু সম্পূর্ণ ভারতীয় উদ্যমের ফসল। তবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সিএফএস-এর যে খুব গভীর সম্পর্ক ছিল, তা বলা যায় না। চলচ্চিত্র-অনুরক্ত এই যুবা গোষ্ঠী কলকাতায় একটা কসমোপলিটান বাতাবরণ তৈরি করেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, নন্দনতত্ত্ব সবই তাঁরা অনুসরণ করতেন সিনেমার মাধ্যমে। এঁদের ধ্যানজ্ঞান চলচ্চিত্র। অ্যান্ড্রু রবিনসনের ইনার আই বইয়ের একটি গল্প এই সিনেফিলিয়া বা চলচ্চিত্র প্রেমের চমৎকার নিদর্শন। সত্যজিৎ রায়কে ১৫ অগস্ট ১৯৪৭ নিয়ে জিজ্ঞেস করায় উনি নাকি উত্তর
দেন যে, ওই দিনটির কোনও স্মৃতি তাঁর নেই। তবে যে দিন মহাত্মা গাঁধী নিহত হন, সেই দিনটা ভালই মনে পড়ে, কারণ উনি ও চিদানন্দ দাশগুপ্ত সে দিন প্রশান্ত মহলানবিশের বাড়ি গিয়েছিলেন ওঁকে সিএফএস-এর প্রেসিডেন্ট হওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে। ফেরার পথে ট্রামে গাঁধীর মৃত্যুর খবর মেলে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, হঠাৎ মহলানবিশ কেন? তিনিও কি চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ? তা নয়, কিন্তু গোড়ার দিকে ফিল্ম সোসাইটির কোনও সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তাই অনেক নামী ব্যক্তিকেই ফিল্ম ক্লাবের সদস্য করা হত। যাতে তাঁদের নামমাহাত্ম্যে সিনেফিলিয়ার একটু কদর হয়।
প্রথম দিকের বছরগুলির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মানিকবাবু আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস-এ লেখেন যে তাঁদের দু’দিক থেকে আক্রমণ করা হত। এক দিকে এই ইন্ডাস্ট্রির লোকজনদের সমালোচনা যে কিছু ভুঁইফোঁড়, উন্নাসিক, অল্পবয়সি ছেলে-ছোকরা মিটিং সেমিনার করে বাংলা ছবির বদনাম করে বেড়াচ্ছে। অন্য দিকে, প্রতিবেশী-বাড়িওয়ালা যাঁর বসার ঘরে চলচ্চিত্র আলোচনার আয়োজন করা হত। তাঁর ভয়, সিনেমার মতো নিচু মানের বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজন তাঁর বাড়ির পরিবেশ বিষময় করে তুলছে। “হ্যাঁ মশাই, আপনাদের ফিল্ম সোসাইটি তা কী ব্যাপার? ফিল্মের আবার সোসাইটি কিসের?” এ ধরনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, মানিকবাবু এবং আরও অনেকে। পাশ কাটানোর অছিলায় উত্তর দিতেন, “এই ছবিটবি দেখি, বইপত্র পড়ি, আলোচনা করি। আর বলেন কেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।”
বস্তুত, ১৯৫২ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং ১৯৫৫-য় পথের পাঁচালীর বিপুল সাফল্যের পূর্বে, সিএফএস বা আর্ট সিনেমা কোনওটিরই তেমন কদর কলকাতায় হয়নি। ১৯৪৮-এ সিএফএস তাদের নিজস্ব পত্রিকা চলচ্চিত্র প্রকাশ করে। কিন্তু ক’দিনের মধ্যেই প্রকাশনায় ছেদ পড়ে। পরে অবশ্য চিত্রপট নামে আর একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, নিমাই ঘোষ, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, এবং আরও অনেকে সিএফএস-এ আসা-যাওয়া করতেন। ষাটের দশকে কলকাতা তথা ভারতের অন্যান্য শহরে অনেক ফিল্ম সোসাইটি গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে কলকাতায় স্থিত মুষ্টিমেয় ফিল্ম সোসাইটি আজও নানা দুর্লভ প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, চিত্রনাট্য ও স্মৃতিকথা প্রকাশ করে। অতীতে সবচেয়ে জমকালো সিনে ক্লাব হওয়া সত্ত্বেও সিএফএস আজ পূর্ববৎ নেই বললেই চলে।
১৯৫০-এর শেষার্ধে ও ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ছিল সিএফএস-এর রমরমা। সেখানে সব থেকে বেশি সংখ্যক বিদেশি (নন-হলিউড, নন-ইন্ডিয়ান) ছবি দেখানো হত। তাদের আয়োজিত সভায় বক্তৃতা করে গিয়েছেন জঁ রেনোয়া, মারি সিটন, জেমস কুইন প্রমুখ। তাদের গ্রন্থাগারে মিলত নানা বই এবং তাবৎ চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা— সাইট অ্যান্ড সাউন্ড, মান্থলি ফিল্ম বুলেটিন, ফিল্ম কোয়ার্টার্লি ইত্যাদি। রাম হালদার রচিত কথকতা কমলালয় ও প্রসঙ্গ ফিল্ম সোসাইটি নামক বই থেকে জানতে পারি যে, ওঁকে সিএফএস-এর সদস্য হতে আমন্ত্রণ করার প্রধান কারণ চাঁদার পরিবর্তে সিনেমা সংক্রান্ত অনেক বই জোগাড় করে দেওয়া। হালদার মশাই এও বলেন, সিএফএস-এর সদস্যপদ সবার জন্য ছিল না। খাঁটি বোদ্ধা না হলে সিএফএস-এ ঢোকা দায়। এমনকি চিদানন্দ দাশগুপ্তের স্ত্রীকেও নাকি সিএফএস-এর সদস্য করা হয়নি। বিরক্ত হয়ে হালদার মশাই সিএফএস ছেড়ে ১৯৬০-এ ‘সিনে ক্লাব’-এর সদস্য হন। তবে এ কথাও বলেন যে, বকেয়া আদায় করতে মানিকবাবুকেও সদস্যপদের মাপকাঠি একটু আলগা করতে হয়েছিল।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষে এবং সত্তরের গোড়ায় ভারতীয় চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গের সূচনা হয়। তখন থেকে ফিল্ম সোসাইটির ভূমিকা নিয়েও নানা বিতর্ক ওঠে। ছায়াছবির নান্দনিক দিকের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে বাঙালি সিনে ক্লাব সদস্যরা মেতে ওঠেন। সত্যজিৎ রায়, আশিস বর্মন, মৃণাল সেনের লিখিত বিতর্ক স্মরণ করলে বোঝা যায়, চলচ্চিত্র নিয়ে এ রকম ধারালো বিতর্ক এই সময়ের আগে বা পরে হয়নি। এই বাতাবরণ তৈরি করায় সিএফএস-এর অবদান কম নয়। ২০১৬’র একটি প্রবন্ধে পড়ি যে, ভাড়া দিতে না পাড়ার দরুন সিএফএস-কে এলআইসি বিল্ডিং থেকে উঠে যাওয়ার নোটিস দেওয়া হয়।
কোনও ভাল জিনিসই চিরন্তন নয়। কলকাতার হেরিটেজের খাতিরে সিএফএস-কে পুনরুজ্জীবিত করা উচিত কি না, জানি না। ফিল্ম সোসাইটি ব্যাপারটা অ্যানালগ যুগের ঘটনা। আজকে তার ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। কিন্তু ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই সিনে ক্লাবটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজ়েশনস, সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ়, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy