ভূষণ: রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথের মুকুটে কোহিনুর। ২০১৪ সালের ছবি। গেটি ইমেজেস।
সে দিন দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার হেডলাইনটি ছিল যাকে বলে, সপাট: “ইন্ডিয়া আর্কাইভ দেখলে বোঝা যায় রাজ-রত্নভান্ডারের কতখানি উপনিবেশ থেকে চুরি করে আনা।” আর্কাইভ বা অভিলেখ্যাগার থেকে এই সংবাদপত্র বার করে এনেছে এক অসামান্য নথি— ৪৬ পাতার একটি ফাইল। এতে বলা আছে রাজা চার্লসের পান্নাখচিত বেল্টটি-সহ আরও কত শত অমূল্য ধন আহরিত হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে। সাম্রাজ্যের উপঢৌকন হিসাবে যেগুলি রানি ভিক্টোরিয়ার ভান্ডারে গচ্ছিত হয়েছিল।
নতুন করে অবাক হওয়ার কিছু নেই অবশ্য। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সম্পত্তির মধ্যে যে ভারত থেকে চুরি করা অসংখ্য মণিমাণিক্যের ছড়াছড়ি, সে তো আমাদের জানাই আছে— বিশেষ করে জানা আছে কোহিনুরের কথা। প্রসঙ্গত, সকলকে চমকে দিয়ে ভারতের বিজেপি-নিযুক্ত সলিসিটর জেনারেল একটি আদালতি হলফনামায় বলে দিয়েছেন যে, ওই কোহিনুর নাকি ইংরেজ রাজপরিবারকে ভারতের তরফ থেকে উপহার দেওয়া হয়েছিল, ফলে ফেরতের দাবি উঠতেই পারে না। সঙ্গে আরও একটি মাথা-ঘোরানো মন্তব্য ছিল তাঁর— সেই হিরের পূর্বতন মালিক শিখদের সঙ্গে যে যুদ্ধ ইংরেজদের করতে হয়েছিল তার খরচ মেটানোর জন্যই নাকি ইংরেজদের কোহিনুর দেওয়া হয়েছিল! তবে এ সব সরকারি হলফনামা ইত্যাদি সত্ত্বেও ভারতীয়দের কোহিনুর-দুঃখ ভোলানো যায়নি, ইতিহাসের দিক দিয়েও না, আবেগের দিক দিয়েও না।
ওই অপূর্ব হীরকখণ্ড রানি ভিক্টোরিয়াকে আনুষ্ঠানিক ভাবে দিয়েছিলেন শিখ রাজ্যের শিশু উত্তরাধিকারী দিলীপ সিংহ, যাঁর এ বিষয়ে সে সময়ে কোনও মতামত থাকাই সম্ভব ছিল না। আমি যুক্তি দিয়েছিলাম, আমার মাথায় যদি আপনি বন্দুক ধরে থাকেন, আমি আমার মানিব্যাগটি ‘উপহার’ দিয়ে দিতেই পারি, কিন্তু তার মানে কি বন্দুকটা সরিয়ে নেওয়ার পরও আমি আর সেটা ফেরত চাইব না!
কোহিনুর ছিল সে সময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ হিরা। ত্রয়োদশ শতকে ভারতের বর্তমান অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুরের কাছে কাকতীয় রাজন্যবর্গের অধীনে এই হিরা খনি থেকে উত্তোলিত হয়েছিল যখন, তার ওজন ছিল ৭৯৩ ক্যারাট বা ১৫৮.৬ গ্রাম (পরবর্তী কালে এই ওজনকে কমিয়ে বলা হয়, প্রধানত ব্রিটিশদের মুখে মুখেই তা কমে এখন দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০৫ ক্যারাট-এ)। কাকতীয় রাজারা সেটিকে এক মন্দিরে স্থাপিত করেন। পরবর্তী কালে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি এসে সেই মন্দির লুণ্ঠন করে আরও বহু ধনরত্নের সঙ্গে ওই হীরকখণ্ডটিকেও দিল্লিতে নিয়ে চলে যান। দিল্লিশাসকদের হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে শেষে এটি মোগল রাজকোষে এসে পড়ে। ষোড়শ শতকে প্রতিষ্ঠিত এই মোগল সাম্রাজ্যের পতন হয় ১৭৩৯ সালে, পারস্যের শাসক নাদির শাহের আক্রমণের ঘায়ে। নাদির শাহ অন্তহীন লুটপাট চালান দিল্লিতে, ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ চলে রাজধানী জুড়ে। সেই লুটের মধ্যেই ছিল অমূল্য ময়ূর সিংহাসন এবং কোহিনুর।
হিরাটির নাম ‘কোহিনুর’ দিয়েছিলেন নাদির শাহই। কোহিনুর— যার অর্থ, আলোক-পর্বত। তাঁর অন্যতম বেগম নাকি এটিকে দেখে একটি অসামান্য প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন: “কোনও শক্তিমান পুরুষ যদি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম এই চার দিকে চারটি পাথর ছোড়েন, পঞ্চম পাথরটি উপরের দিকে হাওয়ায় ছুড়ে দেন, এবং এদের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানটিকে যদি সোনায় ভরে দেওয়া হয়, তাতেও তার দাম কোহিনুরের সমান হবে না।” নাদির শাহের মৃত্যুর পর হিরাটি এল তাঁর অন্যতম সেনাপ্রধান আহমদ শাহ দুরানির হাতে, যিনি তখন আফগানিস্তানের আমির। ১৮০৯ সালে দুরানির এক বংশধর বাধ্য হলেন পঞ্জাবের শিখ মহারাজা রঞ্জিত সিংহের হাতে কোহিনুরকে উপঢৌকন হিসাবে তুলে দিতে। তিনিই প্রথম রাজক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে সেটিকে জনসমক্ষে পরিধান করলেন। তাঁর বংশধররা তাঁর সেই দুর্দম ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেন না। ইংরেজের কাছে শিখরা পরাজিত হলেন পর পর দুই কালান্তক যুদ্ধে। ১৮৪৯ সালে পুরো শিখ রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল। তখনই কোহিনুরও এসে পড়ল ব্রিটিশের হাতে।
অনেক প্রাক্তন উপনিবেশ সম্প্রতি দাবি তুলেছে যে, কয়েক শতক ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তাদের শোষণ করেছে, সুতরাং আজ তাদের কিছু ক্ষতিপূরণ (রেপারেশন) প্রাপ্য। সাম্রাজ্যের মধ্যাহ্নসূর্য যখন ছারখার করে দিচ্ছিল এই সব দেশ, সেই সময়কার লুটতরাজের কিছু অংশ ফেরত দেওয়াই সেই ক্ষতিপূরণের প্রথম ধাপ হওয়া উচিত। কোহিনুর ফিরিয়ে দেওয়া উচিত ভারতকে— যে ভারত তার উৎসভূমি, এবং তার বহু রঙিন কাহিনির জন্মভূমি। পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয়দের কাছে এর যা মূল্য, রানির গয়নার বাক্সের মধ্যে থাকলে তার সেই মূল্য হতেই পারে না। ভারতেই কোহিনুর প্রথম পাওয়া গিয়েছিল, এবং ভারতীয় শাসকদের কাছেই তা কয়েক শতক ধরে গচ্ছিত ছিল: ফলে এর উপর ভারতের হকই সর্বাপেক্ষা বেশি— যত রকম দাবিই তোলার চেষ্টা করুক না কেন পাকিস্তান (কেননা রঞ্জিত সিংহের রাজধানী ছিল লাহোর), কিংবা আফগানিস্তান (কেননা আহমদ শাহ দুরানি সেখানকার শাসক ছিলেন), কিংবা ইরান (কেননা নাদির শাহ এটি লুট করেছিলেন)।
এই যে এতগুলি দেশের দাবি, এর ফলে ব্রিটেনের খুব সুবিধাই হয়েছে। সুদূর উপমহাদেশটিতে চড়াও হয়ে শোষণ-লুণ্ঠনের সাম্রাজ্যবাদ চালানোর অন্যায়কে স্বীকার না করে আপাতত নানা দাবির ঝড় আটকানোকেই প্রধান কাজ করে নেওয়া গেছে। আসলে ‘পার্থেনন মার্বল’ থেকে শুরু করে কোহিনুর— বিশ্ব জুড়ে নানা দেশের ঐতিহ্যসম্পদ কেড়ে এনে নিজের দেশ গুছিয়েছে যে দেশ, সেখানে বিষয়টির গুরুত্ব বিরাট। স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশদের ভয়— কোনও একটি ক্ষেত্রে যদি এই সমঝোতা করতে হয়, তবে তো প্যান্ডোরার বাক্স খুলে কী না জানি বেরিয়ে আসবে। পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ২০১০ সালের জুলাইয়ে ভারতে এসে বলেছিলেন: “কোনও এক জনকে হ্যাঁ বললে আমরা দেখব হঠাৎ ব্রিটিশ মিউজ়িয়ম পুরো খালি করে দিতে হচ্ছে। তাই আমার মনে হয়, কোহিনুর যেখানে আছে সেখানেই থাকুক।”
তবে ইতিহাসের অংশ হিসাবে তাকে রেখে দেওয়া, আর ঔপনিবেশিক লু্ণ্ঠনের ইতিহাস মনে করিয়ে রানিমাতার কোহিনুর-শোভিত শিরোভূষণটিকে টাওয়ার অব লন্ডন-এ রাখা তো এক নয়। যত ক্ষণ না এটিকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে, অন্তত প্রতীকী ক্ষমাপ্রার্থনার খাতিরে এটিকে সাম্রাজ্যবাদী লুট হিসাবেই গণ্য করা উচিত। সম্ভবত এ জন্যই নতুন রানি ক্যামিলা স্থির করেছেন, তিনি কালকের রাজ-অভিষেকে এই মণিভূষণ পরবেন না।
পরবেনই না যদি, তা হলে ফেরত দেওয়ার কথাটাও ভাববেন কি? সেটাই কিন্তু হত সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত কাজ। আমরা হয়তো এত দিনে এমন এক সময়ে পৌঁছেছি যেখানে ‘ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন’ বিষয়টিকে সোজাসুজি স্বীকার করা গিয়েছে। এখন আর তাকে ‘সভ্যতা শিক্ষার আসর’ বলে প্রসাধন করিয়ে দেখতে বা দেখাতে হয় না। আমরা দেখছি, ব্রিটেন শেষ পর্যন্ত বেনিন ব্রোঞ্জ কিংবা ঘানার আসানতি আসন (স্টুল) ফেরত দিয়েছে, অর্থাৎ লুণ্ঠিত বস্তু যথাস্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার একটা ধারা শুরু হয়েছে। আগামী প্রজন্ম এ সব দেখে ভাববে, এই সামান্য কাজটা করার জন্য এত দিন সময়ই বা লাগল কী করে!
এ কোনও হিসাব চোকানোর বিষয় নয়। ইতিহাস অনেক এগিয়েছে, এখন দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আধুনিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সময়। চুরির সামগ্রী ফেরত দেওয়ার পর বাকিটা ইতিহাস বইয়ের হাতে ছেড়ে দিলেই চলবে। তবে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি একটু অন্য ভাবে ‘ক্ষতিপূরণ’ বিষয়টি মনে রাখলে ভাল। ব্রিটেনের ক্ষেত্রে যেমন— সে দেশের স্কুলে সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস পড়ানো উচিত। সাম্রাজ্যবাদের মিউজ়িয়ম বানানো উচিত, যেখানে সাম্রাজ্যবাদের ভাল ও মন্দ অভিজ্ঞতা ধরা থাকবে। উপনিবেশের ভূমিকা স্বীকার করে কিছু স্মারক নির্মাণ করা উচিত, যেমন দু’টি বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের হয়ে কালো ও বাদামি চামড়ার মানুষের আত্মবলিদানের স্মারক। এবং সব শেষে, অতীত অন্যায়ের জন্য অন্তত একটু দুঃখপ্রকাশ করা উচিত। ব্যস, তার পর আমরা সবাই আবার সামনের দিকে হাঁটতে পারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy