শিক্ষাটুকু ফাঁকি না পড়লেই হল।
নবদ্বীপের মাটিতে আবক্ষ মূর্তি হয়ে বুনো রামনাথ অপলক চেয়ে থাকেন তাঁর দেশের পাঠশালাগুলির দিকে। অষ্টাদশ শতকে এই পণ্ডিত টোল খুলেছিলেন নবদ্বীপে। এখন অবশ্য সেগুলোর চেহারা বদলে গিয়েছে। ‘রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত’ নামে এখন আর কোনও শিক্ষকের দেখা প্রায় মেলেই না। আমাদের রামনাথও আসলে কল্পনাই। তাকিয়ে তািকয়ে দেখেন, মানুষের পরনে অন্য ধরনের পোশাক, তাঁদের অন্য চালচলন। মজা পান পণ্ডিতমশাই। এঁরাই ছাত্র পড়ান তা হলে? আবার ছাত্রীও আছে? তিনি খুশি হন। ‘শিক্ষক’ শব্দের পাশে ‘শিক্ষিকা’ শব্দটিকে উচ্চারিত হতে দেখে পণ্ডিতের মনে হয়, নিজের স্ত্রী’কে এমন এক টোলের দিদিমণি হিসেবে দেখতে তাঁর কেমন লাগত? মাঝেমধ্যে দেখেন, ছাত্রের কাঁধে হাত রেখে মাস্টারমশাই চা খাচ্ছেন। ছাত্রের হাতেও চায়ের ভাঁড়। দিদিমণি বেড়াতে যাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে; হাসছেন, মজা করছেন সকলে মিলে। বুনো রামনাথের অবাক লাগে, অস্বস্তিও। তার পর ভাবেন, শিক্ষাটুকু ফাঁকি না পড়লেই হল।
কিন্তু সব পাঠশালায় আলো থাকে না। কোথাও ঘর আছে তো মাঠ নেই। কোথাও মাঠ আছে তো শৌচালয় নেই। কোথাও চেয়ারে শিক্ষক, বেঞ্চি ফাঁকা। আবার কোথাও বেঞ্চিতে ভর্তি শিক্ষার্থী, চেয়ার ফাঁকা। রামনাথ অঙ্কটা গুলিয়ে ফেলেন। তাঁর অরণ্যস্থিত টোল কোনও কালে রাজ-অনুগ্রহ নেয়নি। চরম দারিদ্র সাদরে বরণ করে তিনি বারংবার ফিরিয়ে দিয়েছেন শাসকের দয়ার দান। কিন্তু শিক্ষাদানও কি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি? তার প্রসারণ কি কোথাও সীমিত হয়ে পড়েনি? রাজার দেওয়া অর্থ কেন ‘অনুগ্রহ’ হবে? প্রজাপ্রদত্ত করের অর্থই রাজার সম্পদ। কাজেই প্রজার সন্তান তো প্রকারান্তরে প্রজার অর্থেই প্রতিপালিত হত। রাজা তো মাধ্যম মাত্র! রামনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। অতীতে ফেরা সম্ভব নয় বলে অন্তর্দৃষ্টি মেলে প্রবেশ করতে চান দেশের প্রত্যেক পাঠশালের বর্তমান অন্তঃপুরে। আজকের শিশু, কিশোর, তরুণের কলরব শোনার জন্য তাঁর হৃদয় ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
তৃতীয় শ্রেণির ওই শিশুটি অমন কাঁদছে কেন? এ কোন জায়গা? রামনাথ বিদ্যালয়ের দ্বারপ্রান্তে লাগানো বোর্ডের লেখা পড়েন— ‘ব্রহ্মদত্ত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়/ সিরসিয়া/ উত্তরপ্রদেশ’। এক শিক্ষক একফোঁটা ছেলেটাকে পৈশাচিক ভাবে মারছেন। ছেলেটা আর্তনাদ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল। ন’দিন পর দেশের পঁচাত্তর পেরোনো ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’-এর জলসার দু’দিনের মাথায় সে চলে গেল এই পৃথিবী ছেড়ে। কেন গেল? কারণ, সে ‘দলিত’ এবং দরিদ্র। স্কুলের ফি’বাবদ আড়াইশো টাকা দিতে পারেনি। রামনাথ ভাবেন, তা হলে রুসো থেকে রবি ঠাকুর করলেন কী? এক দিকে এমিল মাইনে না দিতে পেরে খুন হয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে, মানুষ-তোতা সোনার খাঁচায় আটক হয়ে শেখানো বুলির চাপে দম আটকে মরছে। তার ঠোঁট ফাঁক হলেই পুঁথির শুকনো পাতা খসখস, গজগজ করে যন্ত্রযাতনায় ছটফটায়।
রামনাথের মনে পড়ে গেল তার কিছু দিন আগের কথা। উঁচু জাতের জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলার ‘অপরাধ’-এ রাজস্থানের জালোরে আর এক শিশু ছাত্রকে পিটিয়ে মেরেছিলেন তার শিক্ষক। সেই শিশুও ‘দলিত’ ছিল। রামনাথ ভাবেন, তা হলে কি তাঁর পাঠশালের চার পাশের জঙ্গল আজ প্রসারিত হতে হতে মানুষের মনোজগৎ ছেয়ে ফেলে তাকে হিংস্র পশু বানিয়ে দিচ্ছে? কোথায় তা হলে তাঁর দেশের স্বাধীনতা? এক দিকে ‘ভাতা’প্রাপ্ত ভাতহীন শৈশব। অন্য দিকে, ভারবাহী ভারতীয় শিক্ষার্থী। গাজ়িয়াবাদে এক দশম শ্রেণির ছাত্র নাকি অষ্টম শ্রেণির অপর ছাত্রকে খুন করে ফেলেছে শুধু জেলে গেলে লেখাপড়া করতে হবে না, সেই আনন্দে! কেউ আবার পরীক্ষার ফলের ভয়ে নিজেই শেষ করছে নিজেকে। এ শিক্ষা তা হলে মৃত্যু থেকে অমৃতে নয়, গভীরতর মৃত্যুতে পৌঁছে দিচ্ছে।
মালদহে বসবাসকারী চুয়াত্তর বছরের বৃদ্ধ শিক্ষককে লোকে ‘কৃপণ’ বলতেই অভ্যস্ত ছিল। মাটিতে শুতেন, সামান্য খরচে চালাতেন খাওয়াপরা। তার পর এক দিন তিলতিল করে সঞ্চয় করা একাশি লক্ষ টাকা দরিদ্র ছাত্রের কল্যাণার্থে দান করে নিঃশব্দে চলে গেলেন তীর্থ করতে। পণ্ডিত রামনাথ মনে মনে প্রণাম জানান সেই শিক্ষককে। তাঁর মনে পড়ে, জীবনসঙ্গীর আত্মাভিমান অক্ষুণ্ণ রাখতে তেঁতুল পাতার ঝোল রেঁধে দিন গুজরান করেছেন এক মহিলা। তাঁকে সহযাপনের শরিক হিসেবে না পেলে কোথায় থাকত পণ্ডিতের আত্মত্যাগের খ্যাতি? আজ সেই নিভৃতচারিণীই হয়তো হয়ে উঠতেন কলকাতার সেই সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, যিনি জীবনভর সঞ্চিত প্রায় এক কোটি টাকা মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার জন্য দান করলেন। মহিলা কোনও দিন বাস ছাড়া গাড়িতে চাপেননি। বাড়ির কাজের জন্য নিয়োগ করেননি কোনও সাহায্যকারিণীকে।
ভারতীয় মেয়েদের সাক্ষরতা এখনও শতাংশের নিরিখে সত্তর ছুঁতে পারেনি। সামাজিক বাধা, দূরত্ব, দারিদ্র, পরিকাঠামোগত সমস্যা তো রয়েইছে (বিশেষত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে) কিন্তু এ দেশের ছত্রিশ শতাংশ ছাত্র এবং একুশ শতাংশ ছাত্রী স্কুলছুট হয় কেবল পড়ায় মন বসে না বলে। শিক্ষণ সহায়ক উপকরণ, ক্লাসঘরের পরিবেশ ইত্যাদির দুর্দশার তালিকায় যোগ হতে থাকে উল্টো তরফের ঔদাসীন্য, অবহেলা, অতিরিক্ত ছুটি। বিশেষত, অতিমারি ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। ছাত্র গিয়েছে গাড়ি ধুতে, ছাত্রী হয়েছে গৃহবধূ। যদি বা কয়েক জন ক্লাসঘরে ফেরত এসেছে, তাদের অনেকেই অক্ষর চিনতে শেখেনি। বুনো রামনাথ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। এই আবক্ষ মূর্তি যদি দু’টি পা পেত, তিনি ছুটে যেতেন ওই কচিকাঁচাদের কাছে। নতুন পদ্ধতি আর পুরনো ভালবাসার সেতু গড়ে তাদের পৌঁছে দিতেন শিক্ষার দরজায়।
দিদিমণির শরীর ভাল নেই। তাই ছাত্রীর ভারী চিন্তা। মাধ্যমিক পাশ করতেই মা-বাবা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন। পুলিশে খবর দিয়ে, পাড়ার লোকজন ডেকে দিদিমণি ঠেকিয়ে দিয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকের খানকয়েক বই কিনে দিয়েছেন নিজের টাকায়। তরুণ মাস্টারমশাই অন্য স্কুলে বদলি নিয়েছেন। ছাত্রছাত্রীরা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। কিছুতেই যেতে দেবে না। স্যর চলে গেলে খেলার ছলে নামতা শেখাবেন কে? তাদের গানের সুরে সুর মেলাবেন কে? বুনো রামনাথ শান্ত হন। মনে হয়, আসলে ওই শিক্ষকের পায়ে ভর দিয়ে তিনি আবার পৌঁছে গিয়েছেন প্রিয় পাঠশালায়। এখন তাঁর হাতে চক-ডাস্টার। সব আলো নিবে যায়নি। প্রচারের আলোয় আসে না এমন অনেক প্রদীপ এখনও শিক্ষালয়ের কুলঙ্গিতে জ্বলছে। শুধু তাঁদের ছবি তুলে ধরা দরকার। যেন দলিত ছাত্রের হত্যাকারীর অন্ধকার আজকের এই জীবনপ্রদীপের আলোয় মুছে যেতে পারে। শিক্ষার কাজই তো শিক্ষার্থীকে অন্ধকার থেকে আলোয় আনা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy