E-Paper

‘পোড়া দাগটাই পুরস্কার’

রাঙাপানিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ট্রেন-দুর্ঘটনার দিন এই কন‍্যা প্রাণ বাজি রেখে দোমড়ানো কামরা থেকে জীবন্ত বার করেছিল এক রক্তাক্ত যাত্রীকে।

সন্দীপন নন্দী

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:১০
Share
Save

পৌষ মাসে ব্রিগেডে কোনও সমাবেশ নেই, রাজ‍্যে কোনও নিয়োগের পরীক্ষা নেই‌। অথচ জেনারেল কোচে রাশি রাশি ছেলেমেয়ে ঠাসাঠাসি করে চলেছে। তোমরা কী করো? সাইড লোয়ার থেকে উত্তর আসে, “বিপদ মারি।” মানে? “মানে সিভিল ডিফেন্স।” সিট নেই, ঘুম নেই, তবু এরা দিব্যি বিরক্তিহীন। পা ব‍্যথা করছে না? শুনে এনজেপি থেকে মালদহ অবধি টয়লেটের সামনে একটানা দাঁড়ানো মেয়েটি বলল, “জীবনে কতটা দাঁড়াতে পেরেছি জানি না, তবে আমার জন‍্য এক জন নিজের পায়ে হাঁটছে, এটা ভাবতে ভাল লাগে।” রাঙাপানিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ট্রেন-দুর্ঘটনার দিন এই কন‍্যা প্রাণ বাজি রেখে দোমড়ানো কামরা থেকে জীবন্ত বার করেছিল এক রক্তাক্ত যাত্রীকে। তবু মন খচখচ করে ফাঁসিদেওয়া গ্রামের এই মেয়েটির। “এক জনকে রেসকিউ করতে গিয়ে বাকিদের সঙ্গে অন‍্যায় করলাম না তো?”

এর পর মালদহ টাউন স্টেশন থেকে ওঠা ছেলেটি শোনায় তার গল্প। “সে বার মহানন্দা ব্রিজ থেকে ভরা নদীতে ঝাঁপ দিল দু’জন। ছটপুজোয় স্পিডবোটে টহল চলছিল। কিচ্ছু না ভেবে জলে ডুব দিলাম। ছেলেটি স্রোতে ভেসে গেল আর মেয়েটিকে চুল ধরে ভাসতে ভাসতে টেনে আনলাম বোটে। বেঁচে গেল। শুনেছি, আজও পরিবার ওই দিনে মেয়েটির সেকেন্ড বার্থ ডে সেলিব্রেট করে।”

ট্রেন সিগন‍্যালে দাঁড়াতে আবছা আলোয় চোখ পড়ল আর একটি ছেলের মুখের দিকে। তার কপালে পোড়া দাগ, দেখে মনে হয় খাবলা দিয়ে কেউ একটু মাংস তুলে নিয়েছে বুঝি। বাঘের থাবা না কি? না, আগুনের থাবা। “রথবাড়ি বাজারে সাতসকালে আগুন লাগল। দমকল আসার আগেই ক’জন দৌড়ে গেলাম। দাউ দাউ আগুনে গুদামে ঢুকতেই বেআইনি কার্বাইডড্রামগুলো বার্স্ট করল। একটা টুকরো কপালে ঢুকল। তবু হাল ছাড়িনি। প্রায় এক কোটি টাকার মাল বাইরে এনেছিলাম।” এমন লড়াই করে কী পেলে? “এই পোড়া দাগটাই পুরস্কার।”

ট্রেন শিয়ালদহ আসতেই স্টেশনের ভিড়ে মিশে গেল ওরা। নিজেদের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে রাজ্যপালের কাছে নাকি আবেদন জমা দেবে। যদিও ওদের নিয়ে রাষ্ট্রের হেলদোল নেই। বন্যাত্রাণ, অগ্নিকাণ্ড, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মেলা, পুজো, যে কোনও বিপদে এগিয়ে দেওয়া হয় সিভিল ডিফেন্স-এর ছেলেমেয়েদের। কিন্তু তাদের দুর্ঘটনা বিমা, জীবনবিমা নেই, পেনশন প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষার তো প্রশ্নই নেই। ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড মিলেছে, এই অবধি। জেলাশাসকের দফতরে এক আধিকারিক স্থির করেন, কবে কোথায়, কত সিভিল ডিফেন্স কর্মী লাগবে। দৈনিক মজুরিই সম্বল, যার পরিমাণ ছ’শো টাকার মতো। নিয়মিত কাজ পাওয়ার আশায় জল ঢেলেছে দলীয় রাজনীতি। কেন্দ্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিভিল ডিফেন্স ভলান্টিয়ার বাহিনী থাকা সত্ত্বেও রাজ্য নানা কাজে, কেন্দ্রীয় সংস্থার প্রশিক্ষণে, এগিয়ে দিচ্ছে অপ্রশিক্ষিত কিন্তু নেতা-ঘনিষ্ঠ সিভিল ভলান্টিয়ারদের, এই অভিযোগ উঠেছে। মাসে দু’চার দিনের বেশি কাজ পাচ্ছেন না অনেক সিভিল ডিফেন্স ভলান্টিয়ার, যেখানে সিভিল ভলান্টিয়ারদের একটা বড় অংশ প্রায় নিয়মিত কাজ করছেন।

‘কিছু একটা’ করতে পারার আশায় বহু তরুণ-তরুণী এগিয়ে আসে প্রশিক্ষণ নিতে। তার পর হালহকিকত দেখে অনেকেই সরে যায় নীরবে। সরকারি ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গে ছিয়াত্তর হাজার কর্মী সিভিল ডিফেন্স-এ প্রশিক্ষণ নিলেও, সক্রিয় রয়েছেন সতেরো হাজার। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় মোট ৫৫২৩ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হলেও সক্রিয় মাত্র ১২৮ জন। মালদহে প্রায় দশ হাজার জন প্রশিক্ষণ নিলেও নিয়মিত কাজ করছেন তিনশোর মতো। জলপাইগুড়িতে মাত্র ২৭০ জন কর্মী সক্রিয়। উত্তর ২৪ পরগনার মতো বড় ও জনবহুল জেলাতে মাত্র হাজারখানেক।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিজ়াস্টার ম‍্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ফাইটার অ্যাসোসিয়েশন-এর সভানেত্রী সুফিয়া খাতুন বললেন, “জানি, আমরা যে কাজটা করি, সেটা খুব বড়, মহান কাজ। কিন্তু খালি পেটে কি সব সময় খাটা যায়? আমরা তো মাসে ত্রিশ দিন কাজ চাইনি। ঝড়ের পরে পুলিশের অপেক্ষা না করে বিরাট বিরাট গাছ কাটি, সরাই। মেয়েরাও এই কাজ করি। একটু ডালভাত চাই, আর কিচ্ছু না।” বলেই অভিমানে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন এনায়েতপুর গ্রামের ডাকাবুকো মেয়েটি। আর ফোন ধরলেন না। সম্প্রতি কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতর হোমগার্ড এবং সিভিল ডিফেন্স ভলান্টিয়ারদের সনদ সংশোধনে উদ্যোগী হয়েছে। কর্মীদের কাজের মেয়াদ থেকে শুরু করে নতুন ধরনের প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ, সব বিষয়েই রাজ্যগুলির কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। যাঁরা অন্যের জন্য জীবন দিতে তৈরি, তাঁদের জন্য কী করতে পারে তাঁদের দেশ?

তবে সেটাই একমাত্র কথা নয়। “জানেন স‍্যর, ছাব্বিশে জানুয়ারির প্যারেডে এই খাকি পোশাক গায়ে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে মার্চ করতে করতে সব দুঃখ জল হয়ে যায়। নিজেকে মহামানব মনে হয়,” জেলার সরকারি নাট‍্যপার্বণে এক ফাঁকে এক আধিকারিককে কথাগুলো বলেছিলেন এক ডিউটিরত সিভিল ডিফেন্স কর্মী যুবক। তাঁর কাজ ছিল নাটক-শেষে পরিচালকদের সংবর্ধনার জন্য স্মারক আর উত্তরীয় বয়ে আনা। অন্যের জন্য প্রাণ দিতে তৈরি এই তরুণ-তরুণীদের গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দেবে কে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Disaster Management Volunteers

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।