—ফাইল চিত্র।
দেশ জুড়ে যখন প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সফল ইন্ডিয়া জোট, তখন পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোট ধরাশায়ী। এই জোটের ঘোষিত উদ্দেশ্য যে-হেতু বিজেপি-বিরোধিতা, ফলে ধরে নেওয়া যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-বিরোধী ভোটার সে কাজে জোটের উপরে তেমন ভরসা করতে পারেননি। রাজ্যে জোটের ফলাফল কেমন, তা বোঝার জন্য জেতা-হারার হিসাব না দেখে ২০১৯ সালের তুলনায় কত মানুষ জোটকে ভোট দিয়েছেন, তা দেখা ভাল। ২০১৯ ও ২০২৪-এর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা বিভিন্ন কারণে একেবারে নিখুঁত ভাবে তুলনীয় নয় ঠিকই, কিন্তু এই তুলনা থেকে তার চলন বুঝে নেওয়া যায়।
কোচবিহার ও পুরুলিয়া বাদে রাজ্যের বাকি ৪০টি আসনের প্রতিটিতে জোট প্রার্থী দিয়েছিল— হাতে গোনা ব্যতিক্রম বাদে সব আসনেই জোটের ভোটপ্রাপ্তি আগের দফাতেও যৎসামান্য ছিল, এ বারও তাই। তার মধ্যে ৩০টি আসনে জোটের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ২০১৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ও বাম প্রার্থীদের সম্মিলিত ভোটের চেয়ে কম। ৪০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছিল ১০টিতে— তার মধ্যে মালদহ দক্ষিণে কংগ্রেস প্রার্থী জয়ী। হেরে যাওয়া ন’টি আসনের মধ্যে শুধু বহরমপুরে কংগ্রেসের ভোট কমেছে, বাকি আটটি আসনেই ২০১৯ সালে কংগ্রেস প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে ২০২৪-এ জোটের প্রতিনিধি হিসাবে কংগ্রেস প্রার্থীরা বেশি ভোট পেয়েছেন। অর্থাৎ, জোটের কংগ্রেস প্রার্থীর প্রতি বাম ভোট গিয়েছে। তবে, পুরোপুরি নয়— এর মধ্যে ছ’টি আসনে কংগ্রেসের ভোটবৃদ্ধির পরিমাণ ২০১৯-এ সেই আসনে বাম প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে কম। অর্থাৎ, বামের পুরো ভোট কংগ্রেসে আসেনি।
জোটের যে ৩০টি আসনে বামফ্রন্ট প্রার্থী দিয়েছিল, তার মধ্যে ১৪টিতে তারা ২০১৯ সালের বাম প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় কম ভোট পেয়েছে। বাকি ১৬টি আসনে ২০১৯ সালে বাম প্রার্থীর পাওয়া ভোটের চেয়ে জোটের বাম প্রার্থীর ভোট বেড়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে দশটি আসনে জোটের ভোট ২০১৯ সালে বাম ও কংগ্রেস প্রার্থীর মিলিত ভোটের চেয়ে কম। পড়ে থাকা ছ’টি আসনে জোটের ভোট বেড়েছে, অর্থাৎ আগের নির্বাচনে যাঁরা বাম বা কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দেননি, এমন কিছু লোক এ বার জোটের বাম প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। তার মধ্যে শ্রীরামপুর আর দমদমে এই বৃদ্ধি তুলনায় বেশি— তৃণমূল বা বিজেপির তুলনায় নয়, জোটের অন্য প্রার্থীদের তুলনায়।
অর্থাৎ, রাজ্যের বেশির ভাগ আসনেই জোটে সম্পূর্ণ ভোট ট্রান্সফার হয়নি। জোটে না-যাওয়া ভোট কোথায় গিয়েছে? অনুমান করা চলে, কংগ্রেসের ভোট গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের ঝুলিতে; যেমন জোটবিমুখ বামপন্থী ভোট সম্ভবত গিয়েছে বিজেপির দিকে। জোটভুক্ত দলের সমর্থকরাই যদি জোটের উপরে ভরসা না করতে পারেন, তা হলে অন্য দলের ভোট টানার প্রশ্ন ওঠে না।
গোটা দেশেই বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও। আসনসংখ্যা হ্রাসের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের ধাক্কা প্রবলতর— সর্বভারতীয় স্তরে যেখানে বিজেপির আসন কমেছে ২০%, পশ্চিমবঙ্গে তা ৩৩.৩%। তবে এ কথা ঠিক যে, ২০১৯ সালের তুলনায় আসন কমাই স্বাভাবিক— কারণ, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন, ২০১৬ এবং ২০২১-এর বিধানসভা, কোনওটিতেই আসনসংখ্যার নিরিখে বিজেপির সাফল্য ২০১৯-এর লোকসভার ধারেকাছেও নয়। ২০১৯ ব্যতিক্রমী বছর ছিল, ২০২৪ আবার ফিরে গিয়েছে নির্দিষ্ট কক্ষপথে। তবে, এ বারের বিজেপির ফলাফলকে শুধু স্বাভাবিক স্তরে প্রত্যাবর্তন বলা মুশকিল। এ রাজ্যে বিজেপির দুটো অভাব প্রকট— এক, রাজ্যস্তরে এমন কোনও নেতা নেই, যাঁর পক্ষে গোটা রাজ্যের নাড়ির গতি বোঝা সম্ভব; এবং দুই, বিজেপির সংগঠন অতি দুর্বল। সন্দেশখালি নিয়ে বিজেপি যে বিপুল হট্টগোল বাঁধিয়েছিল— স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তেমন ভাবে মণিপুরের খোঁজ না রাখলেও ফোন করেছিলেন রেখা পাত্রকে— তাকে গোটা রাজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচনী প্রশ্ন করে তুলতে পারা তো দূরের কথা, বসিরহাট লোকসভা আসনেই তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্কে টোল ফেলতে ব্যর্থ বিজেপি।
গত দফায় জয়ী এবং গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রার্থীর আসন এ বার বদলে দিয়েছিল বিজেপি— রায়গঞ্জ থেকে দেবশ্রী চৌধুরীকে নিয়ে এসেছিল কলকাতা দক্ষিণে; মেদিনীপুর থেকে দিলীপ ঘোষকে নিয়ে গিয়েছিল বর্ধমান-দুর্গাপুরে। তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত, কারণ কলকাতা দক্ষিণ আসনটি তৃণমূলের দুর্জয়তম ঘাঁটিগুলোর একটা; অন্য দিকে, বর্ধমান-দুর্গাপুরে গত বার বিজেপি প্রার্থী সুরেন্দ্রজিৎ সিংহ অহলুওয়ালিয়া জিতেছিলেন মাত্র আড়াই হাজার ভোটে। দু’টি আসনেই হেরেছে বিজেপি।
অধিকারীদের খাসতালুক পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় কী ঘটল? ২০১১ সালে, প্রবল তৃণমূল হাওয়ায় পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ও কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের অধীন ১৪টি বিধানসভা আসনেই জিতেছিল তৃণমূল। ২০১৬ সালে তার মধ্যে হাতছাড়া হয়েছিল ৩টি আসন। ২০২০ সালে শুভেন্দু দল বদলালেন। ২০২১-এর নির্বাচনে ১৪টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেল আটটি, তৃণমূল ছ’টি। তবে, ২০১৬ অবধি ১৪টির মধ্যে কোনও আসনেই বিজেপি দ্বিতীয় স্থানেও ছিল না— ২০২১-এর বিধানসভায় যে ছ’টিতে তৃণমূল জিতেছিল, তার প্রতিটিতেই দ্বিতীয় হল বিজেপি। এই লোকসভার ভোটকে প্রতিটি আসনের অন্তর্গত বিধানসভা ক্ষেত্রে ভাঙলে দেখা যাচ্ছে, কাঁথির পটাশপুর বাদে বাকি ১৩টি বিধানসভা আসনেই এগিয়ে আছে বিজেপি। দু’টি লোকসভা কেন্দ্রেই জিতেছে বিজেপি— তবে দু’টি আসনেই ২০১৯-এ তৃণমূল যত ভোটে এগিয়ে ছিল, এ দফায় বিজেপি এগিয়ে আছে তার চেয়ে অনেক কম ভোটে— এ বারে বিজেপির লিড আগের বারের তৃণমূলের লিডের ৪০%।
৩০ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে, রাজ্যের এমন ১৩টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১০টিই তৃণমূলের দখলে। তার মধ্যে একটি আসন— বহরমপুর— এ বার কংগ্রেসের থেকে তৃণমূলের দখলে এল। আরও দুটো আসন— জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদ— তৃণমূলের দখলে এসেছিল ২০১৯ সালের নির্বাচনে। বাকি সাতটি আসনে অন্তত ২০১৪ সাল থেকেই তৃণমূল জয়ী হচ্ছে।
বহরমপুর আসনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ৫৬ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু ভোটবিশিষ্ট এই আসনে আগের দফার চেয়ে অধীর চৌধুরীর ভোট কমেছে দেড় লক্ষেরও বেশি। অন্য দিকে, বিজেপির ভোট বেড়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ। এই লোকসভা আসনের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যে যে দু’টিতে সংখ্যালঘু ভোট সবচেয়ে কম, সেই বড়ঞা ও বহরমপুরে বিজেপি তুলনায় অনেক বেশি ভোট পেয়েছে— অধীর চৌধুরীর খাসতালুক বহরমপুরে অবশ্য কংগ্রেস এগিয়ে আছে বিজেপির চেয়ে, অনেক পিছিয়ে তৃণমূল। বাকি পাঁচটি ক্ষেত্রেই তৃণমূলের ভোট সবচেয়ে বেশি, বিজেপির চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেশি।
যে-হেতু ৩০ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু ভোটার থাকা কেন্দ্রগুলির সিংহভাগ তৃণমূলের দখলে, তাই একটি প্রশ্ন উঠছে— সংখ্যালঘুরা কি তৃণমূল দলটিকে ভোট দিচ্ছেন, না কি সে দলের হয়ে দাঁড়ানো সংখ্যালঘু প্রার্থীকে? এমন আসনগুলির মধ্যে বহরমপুর বাদে বাকি যে ন’টিতে তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী, তার মধ্যে ছ’টি আসনে তাদের প্রার্থী ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু নন। তার চেয়েও বড় কথা, এই আসনগুলির মধ্যে পাঁচটিতে ইন্ডিয়া জোটের প্রার্থী ছিলেন ধর্মীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু। এই পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই জোটের প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ২০১৯-এর নির্বাচনে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট প্রার্থীদের মিলিত ভোটের চেয়ে কম। অর্থাৎ, সংখ্যালঘুরা যদি সত্যিই তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে থাকেন, তবে তা দল হিসাবেই, প্রার্থীর ধর্মীয় পরিচিতি দেখে নয়। বিজেপি যত প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ততই তাকে ঠেকানোর জন্য সংখ্যালঘুরা বেছে নিয়েছেন তৃণমূলকে। অর্থাৎ, বামপন্থীদের ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব দাঁড়াচ্ছে না। মোদী-শাহরা এ রাজ্যে যত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সুর চড়াবেন, সম্ভবত সংখ্যালঘুরা তত বেশি তৃণমূল কংগ্রেসের উপর ভরসা করতে বাধ্য হবেন।
হাজার দুর্নীতি ও অত্যাচারের অভিযোগ সত্ত্বেও তৃণমূল ২৯টি আসনে জয়ী। কিন্তু, তাদের আশঙ্কার জায়গাও অনেক। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্ণ পুরুষ ভোটের সিংহভাগ সম্ভবত হাতছাড়া। সিএএ-বিরোধী প্রচার সত্ত্বেও মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের বড় অংশ এখনও অধরা। উত্তরবঙ্গে যেটুকু জমি পুনরুদ্ধার করা গিয়েছিল, তা-ও ফস্কে যাচ্ছে। ভোটে জিতলেও চিন্তা থাকছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy