বাড়তে থাকা বেকারত্ব, নিত্য অভাব ইত্যাদি বেটিং অ্যাপের বড় মূলধন। প্রতীকী ছবি।
চায়ের দোকানের অদূরে কয়েকটা গাছ। গাছতলায় বেদি। আলো-অন্ধকারের সান্ধ্য মিশেল। ফোনের স্ক্রিনগুলো জ্বলছে। একটা বাড়তি তৎপরতা: “তাড়াতাড়ি কর রে। আর পাঁচ মিনিট আছে।” এই তাড়া আসলে টিম তৈরির। বেটিং অ্যাপ থেকে কয়েক কোটি টাকা জেতার স্বপ্ন দেখছে কিছু যুবক।
সারা বছর ধরে বিভিন্ন বেটিং অ্যাপের রমরমা চলে ঠিকই, তবে আইপিএল এলে ‘পয়সা লাগানো’-র প্ল্যাটফর্মগুলোতে যোগদানকারীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। এই গাছতলার ছেলেগুলির মতো আরও অনেকেই সহজে বড়লোক হতে চায়। সারা দিনের মজুরির টাকা— বাড়ি ফেরার পথে দু’কেজি চাল, আড়াইশো ডাল, পাঁচটা ডিম, তেল-ঝাল-মশলার ফর্দ মিলিয়ে কেনার সম্ভাবনা ভেসে যায় বেটিং-এর বেনোজলে। কয়েক বার অর্থহানির পর তৈরি হয় জেদ: “আজ জিতে দেখিয়ে দেব।” সেই জেদ থেকে আবার টিম তৈরি, টাকা লাগানো। কালেভদ্রে একশো-দু’শো টাকা জিতলে মনে হয় ‘এই তো, রাস্তা খুলছে’। নেশা তো তৈরি হয় এ ভাবেই।
বাড়তে থাকা বেকারত্ব, নিত্য অভাব ইত্যাদি বেটিং অ্যাপের বড় মূলধন। এ জন্যই অতি কম সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে অ্যাপগুলি, ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। সহজে বড়লোক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় টাকা ধার করে বেটিং অ্যাপে টাকা লাগানোর আসক্তি এমন, টিম সেট না করলে অস্থিরতা কাজ করে। মানসিক শান্তি বিঘ্নিত হয়।
বেটিং অ্যাপের মহিমা এমনই, যাঁরা ক্রিকেটের সব নিয়ম বোঝেন না, পরিসংখ্যান ইত্যাদি তো দূর, হয়তো প্লেয়ারদের নামও ঠিকঠাক জানেন না, তাঁরাও এই খুড়োর কলের পিছনে ছুটছেন। মরসুমি ক্রিকেট ফ্যান হয়ে ওঠেন শুধু ‘টাকা লাগানো’-র কারণে। যুবক-যুবতীদের কিছু বাড়তি টাকা হাতে পাওয়ার চটজলদি পথ এটাই। ক্রিকেট ‘বোঝেন’, এমন বন্ধুর কাছে টিম বানিয়ে দেওয়ার দাবি করেন তাঁরা। ‘আমি টিম বানিয়ে দিচ্ছি, জিতে যাবি’ জাতীয় বিশেষজ্ঞের আশ্বাস অসফল হলে ‘তোর জন্য এতগুলো টাকা গেল’-র সূত্র থেকে সম্পর্ক খারাপ হয়।
প্লেয়ার-ফিল্মস্টাররা বেটিং অ্যাপের বিজ্ঞাপনের শেষে যে আসক্তি এবং আর্থিক ক্ষতির সতর্কবাণী দেন, তা ঢাকা পড়ে যায় তাঁদের মহাতারকা ভাবমূর্তির নীচে। সর্বোপরি কাঁচা টাকার তুমুল প্রয়োজনের কাছে ওই দায়সারা সতর্কবাণীর তেমন কোনও প্রভাব নেই। তারকারা বিজ্ঞাপনের পারিশ্রমিক পান, আর ভক্তরা অর্থ খোয়াতে থাকেন। এ ব্যাপারে তথাকথিত ‘আইকন’-দের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা নেই। বিজ্ঞাপনে তাঁরা হাসিমুখে বলেন, “আপনি টিম বানান, আমি আপনার কাজ করে দিচ্ছি।” যেন জীবনের সহজ হিসাব— “আপনার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি, আপনি বেটিং-এ মশগুল থাকুন।”
ইদানীং তারকার তালিকায় যোগ হয়েছেন ইউটিউবার, সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সররাও। জনপ্রিয় ইউটিউবাররা তাঁদের চ্যানেলে ক্রিকেট-জুয়ার প্রচার করছেন। ‘অমুক ইউটিউবার বলছেন মানে নিশ্চিন্তে খেলা যাবে’-র ভ্রান্ত বিশ্বাসযোগ্যতাও তৈরি হচ্ছে। কিছু বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় সাধারণ দিনমজুর, গৃহবধূ, অর্থাৎ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ‘টাকা লাগিয়ে’ কয়েক লাখ টাকা জিতে পাল্টে ফেলছেন নিজেদের জীবন। বিজ্ঞাপন তো বিজ্ঞাপনই, তার সঙ্গে আর বাস্তবের যোগ কতটুকু!
এই সব অনলাইন জুয়া কি আইনসম্মত? তা-ই হবে নিশ্চয়ই, নয়তো প্রকাশ্যে এত জমজমাট প্রচার চালিয়ে এমন ব্যবসা চলে কী করে? ক্রমে তা হয়ে উঠছে বৃহৎ অর্থনীতির অঙ্গ। কেউ ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বলতে পারেন, কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি স্বেচ্ছায় এই খেলায় নাম লেখাতে চান, তাঁকে বাধা দেওয়ার কোনও কারণ নেই। তিনি তো ঝুঁকির কথা জেনেই খেলছেন। কথাটাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেওয়া উচিত হবে না। কিন্তু, সেই ব্যক্তিস্বাধীনতার ফল গোটা সমাজের উপর, ব্যক্তির পরিবারের উপর কী ভাবে পড়ছে, তার খোঁজ না রাখাও বিচক্ষণতার কাজ হতে পারে না। বেটিং অ্যাপের ফাঁদে বাড়ির গয়না বিক্রি, ঋণের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। প্লে স্টোরের স্বীকৃতি না থাকা অ্যাপের চক্করে অনেকে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ফেক অ্যাপ থেকে সাইবার জালিয়াতির সম্মুখীন হয়ে অ্যাকাউন্টে সঞ্চিত অর্থ খোয়াচ্ছেন।
জুয়া মানেই তো ভাগ্যের খেলা। কিন্তু, বেশির ভাগ জুয়ার ক্ষেত্রেই যেমন হয়, ক্রিকেট-জুয়াতেও একটা আপাত-দক্ষতার গল্প আছে। যাঁরা খেলছেন, তাঁদের অনেকেরই ধারণা, ক্রিকেট বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান এতটাই গভীর ও মজবুত যে, ভাগ্যকে টপকে তাঁরা নিজেদের দক্ষতার জোরে জিতে নিতে পারবেন বাজি। বিজ্ঞাপন, প্রচার সবই আসলে উস্কে দিতে চায় নিজের দক্ষতার প্রতি এই ভ্রান্ত, ভিত্তিহীন বিশ্বাসটাকে। আইপিএল-এর মরসুম শুরু হয়ে গিয়েছে। যাঁরা এই মওকায় হঠাৎ বড়লোক হওয়ার খোয়াব দেখছেন, তাঁরা এক বার থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে পারেন, সত্যিই কি ভাগ্যকে টপকে যাওয়ার মতো জোর তাঁদের আছে? না থাকলে, আগুন থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy