প্রণত: মন্দিরে সস্ত্রীক ঋষি সুনক, ২০২২। পিটিআই।
গত বছর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আসনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনকের অধিষ্ঠান নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, বিস্তর প্রশস্তি ও অভিনন্দনের বন্যা বয়েছে। গায়ের রং বাদামি, গোমাতার পুজো করেন, এমন এক জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, এই ঘটনা আরও এক বার মনে করিয়ে দেয় যে, পশ্চিম দুনিয়ায় ভারতসন্তানদের এখন বিরাট প্রতিপত্তি।
বেসরকারি শিল্পবাণিজ্যের পরিসরে এই ব্যাপারটা অনেক দিন ধরেই সুস্পষ্ট। ভারতে জন্ম, এ দেশে বড় হওয়া, এমন অনেকেই প্রথম সারির বহুজাতিক সংস্থার কর্ণধার হয়েছেন। ভুবনজয়ী আমেরিকান কোম্পানির নেতৃত্বে প্রতিভাবান ভারতীয়দের আরোহণের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তিনটি দৃষ্টান্ত হিসেবে সম্ভবত বলা যায় তিন জনের কথা: পেপসিকো-র ইন্দ্রা নুয়ি, মাইক্রোসফট-এর সত্য নাদেল্লা এবং (গুগল-এর জনক) অ্যালফাবেট-এর সুন্দর পিচাই। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্প্রতি আমেরিকার মনোনয়ন পেয়েছেন ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি মাস্টারকার্ড-এর ভূতপূর্ব প্রধান অজয় বঙ্গা। এই পদে তাঁর অধিষ্ঠান নিশ্চিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে পশ্চিম দুনিয়ার সম্পন্ন দেশগুলি বিধ্বস্ত ইউরোপ তথা বিশ্বের পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে যে ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’ তৈরি করেছিল, অতঃপর তার নেতৃত্বে আসছেন এক শিখ, মাথায় পাগড়ি।
কিন্তু এহ বাহ্য। ফরচুন তালিকার প্রথম ৫০০ কোম্পানির মধ্যে একটি-দু’টি নয়, ৫৮টির বর্তমান সিইও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ইতিমধ্যে ইন্দ্রা নুয়ি অবসর নিয়েছেন, অবসর নিয়েছেন ভোডাফোন-এর প্রাক্তন কর্ণধার অরুণ সারিন, টুইটার-এর প্রধান পরাগ আগরওয়ালকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, ডয়েশ ব্যাঙ্ক ও ক্যান্টর ফিটসজ়েরাল্ড-এর ভূতপূর্ব কর্ণধার অংশু জৈন প্রয়াত হয়েছেন। ৫৮ সংখ্যাটি তাঁদের বাদ দিয়েই। বর্তমান বা সাম্প্রতিক ভারতীয় সিইও’দের মধ্যে কয়েক জন শান্তনু নারায়ণ (অ্যাডোব), অরবিন্দ কৃষ্ণ (আইবিএম), রাজীব সুরি (নোকিয়া), লক্ষ্মণ নরসিংহন (স্টারবাকস), রাজ সুব্রহ্মণ্যন (ফেডেক্স)। বিশ্ববিশ্রুত ফরাসি সুগন্ধি ও ফ্যাশন হাউস শ্যানেল-এর সিইও লীনা নায়ার।
এই সাফল্য রাজনীতির ভুবনেও প্রসারিত হয়েছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিকরা ইউরোপের দু’টি দেশে সাম্প্রতিক কালে সরকারের প্রধান হয়েছেন: পর্তুগালে ২০১৫ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে আছেন আন্তোনিয়ো লুইস সান্তোস দা কোস্তা, আয়ারল্যান্ডে লিয়ো ভারাডকর ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, এ বছরে আবার সেই পদে ফিরে এসেছেন তিনি। আমেরিকায় ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের মা ভারতীয়, ২০২৪-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের অন্যতম সম্ভাব্য প্রার্থী নিকি হ্যালির মা-বাবা দু’জনেই ভারতের সন্তান। ব্রেক্সিট-উত্তর পর্বে ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মধ্যে জটিল সমস্যার মোকাবিলা করবেন সুনক এবং ভারাডকর— এটা বেশ অদ্ভুত বটে। তবে এর থেকেও চমকপ্রদ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে স্কটল্যান্ডে। হামজ়া ইউসুফ সেখানকার ফার্স্ট মিনিস্টার হয়েছেন। তিনি স্বাধীন স্কটল্যান্ডের দাবিদার। অতএব এমনটা হতেই পারে যে, ব্রিটেন ভাগ করার প্রশ্নে দ্বৈরথে অবতীর্ণ হবেন এক ভারতীয় এবং এক পাকিস্তানি!
যে সব সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে ভারতীয়রা অধিষ্ঠিত হয়েছেন সেগুলি পশ্চিমেই তৈরি, যে ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁরা উঠে এসেছেন তা-ও সম্পূর্ণত পশ্চিম দুনিয়ার, এবং পশ্চিম দুনিয়াতেও স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে দক্ষতা বা প্রতিভার কোনও ঘাটতি নেই। তা সত্ত্বেও ভারতীয়রা কী করে এতটা সফল হন?
অনেকে বলেন, এর পিছনে আছে ভারতে দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সুবাদে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ এবং উৎকর্ষ। কিন্তু কেবল ভাষাজ্ঞানের জোরে সাফল্য আসে না। আর, ইংরেজি জানার ফলে পর্তুগাল বা জার্মানির মতো দেশে তো বাড়তি কোনও সুবিধা নেই! অন্য অনেকের মতে, অভিবাসীরা বাড়তি উৎসাহ এবং আগ্রহ নিয়ে আসেন, সেটা তাঁদের সাফল্যের পথে এগিয়ে দেয়। ঠিকই, কিন্তু ভারতীয়রা অন্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের থেকে বেশি সফল। যেমন, আমেরিকায় সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভারতীয়দের মাথাপিছু উপার্জন সবচেয়ে বেশি।
প্রথম প্রজন্মের ভারতীয় অভিবাসীরা রুপোর চামচ মুখে নিয়ে বড় হননি। তাঁরা নিজেরা কষ্ট করে বড় হয়েছেন, কিংবা চার পাশে কৃচ্ছ্রসাধনের জীবনযাত্রা দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতার কারণেই আর্থিক অসচ্ছলতা থেকে উত্তরণের তাগিদ তৈরি হয়েছে তাঁদের মনে। এঁদের মধ্যে এগিয়ে যাওয়ার, সফল হওয়ার যে তাড়না, পশ্চিমি দুনিয়ার সমাজে অন্য অনেকের মধ্যেই সেটা থাকে না। সেটাই তাঁদের সাফল্যের পথে এগিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া, ভারতে তাঁদের বহু সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে, যেমন, প্রয়োজনীয় উপকরণ বা সম্পদের অভাব, পরিকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগের ঘাটতি, সরকারের অতিরিক্ত খবরদারি, আমলাতান্ত্রিক বাধাবিপত্তি ইত্যাদি। এই সব কিছু সামলানোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরে পশ্চিমের মুক্ত, মসৃণ পরিবেশে তাঁরা স্বচ্ছন্দে সাফল্য পেয়েছেন।
ভারতীয়রা বৈচিত্রময় পরিবেশে কাজ করতে অভ্যস্ত। আমাদের ইতিহাস এবং ভারতের বহুবর্ণ সামাজিক পরিবেশের কারণে ভারতীয়রা নানা ভাষা, নানা ধর্ম, নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে অভ্যস্ত। একটা বহুজাতিক সংস্থার কাজের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়াটা তাঁদের পক্ষে সহজ। বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ্য তাঁদের পক্ষে নিতান্ত স্বাভাবিক। ভারতে বড় হওয়ার মধ্য দিয়ে এই তরুণ-তরুণীরা এক দিকে ব্যক্তিগত উৎসাহ আগ্রহ এবং মৌলিক চিন্তাশক্তিতে সমৃদ্ধ হন, অন্য দিকে আচরণের সৌজন্য, অগ্রজদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং উচ্চাবচ কাঠামোর মর্যাদাবোধ তাঁদের চরিত্রের অঙ্গ হয়ে ওঠে। এই সমন্বয়ের ফলে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় স্বচ্ছন্দ বোধ করা তাঁদের পক্ষে অনেক সহজ। শিক্ষা এবং জ্ঞান সম্পর্কে ভারতীয়দের স্বাভাবিক শ্রদ্ধা থাকে, পারিবারিক সংযোগ জোরদার হওয়ার ফলে তাঁরা একে অন্যের সহায় হতে পারেন, কঠোর পরিশ্রমের অভ্যাস তাঁদের মধ্যে সুপ্রচলিত। এগুলো তাঁদের খুবই সাহায্য করে।
করুণ পরিহাস এই যে, এই বৈচিত্র এবং বহুত্বের ধারণা আজকের ভারতে সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী উগ্র-জাতীয়তার আক্রমণে বিপন্ন। চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব করে চলেছে একতন্ত্র এবং নয়া জাতীয়তার ধারণার প্রতি আনুগত্যের দাবি। এটা ভাবলে গভীর উদ্বেগ হয় যে, বাইরের দুনিয়ায় যে গুণগুলিকে ভারতীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে অভিবাদন জানানো হচ্ছে, সেগুলি হয়তো অচিরেই স্বদেশের তুলনায় বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যেই বেশি দেখা যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy