সিকিমের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি পর্যটন। —ফাইল চিত্র।
সিকিমের একটি ছোট্ট জনপদ জঙ্গু। আদতে সিকিম, দার্জিলিঙের আদি বাসিন্দা লেপচাদের জন্য সংরক্ষিত জনপদ সেটি। সেই জঙ্গুর বাসিন্দারাই প্রায় দু’দশক আগে প্রতিবাদে নেমেছিলেন। প্রতিবাদের কারণ, উন্নয়নের নামে তিস্তার উপরে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ। শুধু মুখে প্রতিবাদ নয়, ৯০০ দিনের বেশি ধরে রিলে অনশনও চলেছিল। কিন্তু তিস্তার জল আটকে উন্নয়নের রথের চাকা স্তব্ধ হয়নি। সেই একের পর এক বাঁধ নির্মাণের মধ্যে নব সংযোজন ছিল চুংথাংয়ে তিস্তা স্টেজ থ্রি বাঁধ। সেই চুংথাং, যা ক’দিন আগেই মেঘভাঙা বৃষ্টি এবং হিমবাহ হ্রদের বন্যার তোড়ে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে আরও বহু বাঁধের। শুধু প্রচুর সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, ভেসে গিয়েছে বহু প্রাণও। সিকিমের একাংশ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। তার ফলেই গত কয়েক বছর ধরে হিমালয় পার্বত্য এলাকায় ‘উন্নয়নের দূষণ’ নিয়ে আলোচনা চলছিল। তা ফের জোরালো ভাবে আলোচনায় এসেছে।
উন্নয়ন কাকে বলে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মত আছে। কেবলমাত্র আর্থিক অগ্রগতিকেই উন্নয়ন হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও বিস্তর বিতর্ক আছে। এ কথা না বলে উপায় নেই যে, গত দু’দশক ধরে যে সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট বা সুস্থায়ী উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, তিস্তার জল আটকানোর জন্য একের পর এক বাঁধ তৈরি তার উল্টো পথে হাঁটে। তিস্তার মতো নদীর জল ধাপে ধাপে আটকানোর ফলে প্রকৃতির ক্ষতি হয়েছে, নদীর স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়েছে। বোল্ডার শুধু নয়, সেবকের কাছে পলি পড়েও নদীগর্ভ উঁচু হয়ে গিয়েছে। যার ফলে জলধারণ ক্ষমতা কমেছে। তার ফলেই আচমকা হুড়মুড়িয়ে জল চলে এলে দু’কূল ছাপিয়ে শুধু রাস্তা ভাসিয়ে দেয় না, বোল্ডার এবং পলি জমার ফলে সেবকের কাছে নদীর তলদেশের গড়নও বদলে গিয়েছে। তার ফলে জলের স্রোতের ধাক্কায় পাশের রাস্তাতেও ভাঙন ধরছে। উপরন্তু রয়েছে বেলাগাম দখলদারি। রাস্তার পাশের নির্মাণ নিজের এক্তিয়ার বাড়াতে বাড়াতে কার্যত তিস্তার বুকের উপরে চলে গিয়েছে। হড়পা বানের ধাক্কায় সে রকম অনেক বাড়িই এ বার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
যে ভাবে বাঁধ নির্মাণ করে নদীতে পলি বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, পাহাড়ি নদীর দুই কূল ঘেঁষে বহুতল হচ্ছে, নদী বিশেষজ্ঞ জয়া মিত্র এক সাম্প্রতিক লেখায় সে দিকে রাষ্ট্রের নজরদারির কথা বলেছেন, নদী সংক্রান্ত পৃথক দফতরের দাবিও তুলেছেন। কিন্তু, নদী সংক্রান্ত পৃথক দফতর তো দূরের কথা, উন্নয়নের রথের চাকায় নদী এবং পরিবেশ পিষ্ট হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে কি আদৌ নজর আছে? যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম নদীর ধারের বাসিন্দা, বন্যা হলে যাঁদের ক্ষতির আশঙ্কা সর্বাধিক, তাঁদের প্রতিবাদ কিংবা পরামর্শ কি আদৌ সিংহাসনে আসীন মানুষদের কানে পৌঁছয়? যদি সে সব কথার এক আনাও গুরুত্ব থাকত তা হলে তিস্তার উপরে জলবিদ্যুতের নামে একের পর এক বাঁধ নির্মাণ হত কি? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জলবিদ্যুৎ রাষ্ট্রের কাছে লাভজনক ব্যবসা। কোনও রাজ্যের উন্নতির ক্ষেত্রে অর্থশক্তির প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা চলে না। সেই কারণেই তিস্তা স্টেজ থ্রি-র উপরে এত বেশি জোর দিয়েছিল সরকার। গত অগস্টেই স্টেজ থ্রি থেকে উৎপন্ন ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বিক্রি নিয়ে এক সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করছিল সিকিম উর্জা লিমিটেড। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রের অর্থশক্তি যাঁদের উন্নয়নে নিয়োজিত হওয়ার কথা, তাঁরাই কি এই উন্নয়নের বলি হচ্ছেন না? প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে ক্ষতি মেরামতে যে টাকা খরচ হবে, তা-ও জনগণেরই টাকা। এক দিকে ঘরবাড়ি, প্রাণহানি হল। সেই ক্ষয়ক্ষতি মেটাতে নিজেদের করের টাকাই খরচ করতে হল!
সিকিমের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি পর্যটন। শুধু হোটেল বা গাড়ি ব্যবসা নয়, পথের দু’পাশে থাকা ছোট খাবারের দোকান, বাজারহাটে থাকা টুকিটাকি বাহারি জিনিসপত্রের কিংবা ফেরিওয়ালা, এঁরাও সেই পর্যটন ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক পুজোর আগে সিকিমে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটল, এবং গ্যাংটকে যাওয়ার মূল রাস্তা ভাঙল, তাতে পর্যটনের ক্ষতির আশঙ্কা চোদ্দো আনা। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর হোটেল বা গাড়ি ব্যবসায়ীরা সেই ক্ষতি উসুল করতেও পারেন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যবসায়ীদের সেই সুযোগ নিতান্ত কম।
শুধু সিকিম নয়, গত কয়েক বছরে উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশের মতো পাহাড়ি রাজ্যগুলিতে বার বার এমন বিপর্যয় ঘটেছে। বিপদের পর সরকারি স্তরে নানা কথা হয়েছে, ভুলত্রুটি শোধরানোর কথা হয়েছে। বাস্তবে অবশ্য তার প্রতিফলন ঘটেনি। এ বারও সিকিমের ক্ষত সেরে উঠবে। তার পর ফের ছুটবে উন্নয়নের রথ। তত দিন পর্যন্ত ছুটবে, যত দিন না প্রকৃতির প্রলয় নাচনে সব লন্ডভন্ড হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy