দিল্লির এক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের ক্লাস। শিক্ষিকা এসে ঘোষণা করলেন, একটা খুশির খবর আছে। ছেলেমেয়েরা হইহই করে উঠল। খুশির খবরটা কী? ইতিহাস বইতে সুলতানি যুগ নিয়ে যে অধ্যায়টি আছে, তা পড়তে হবে না। সেখান থেকে পরীক্ষায় কোনও প্রশ্ন আসবে না।
দিল্লি থেকে চলুন দক্ষিণবঙ্গে। জেলার একটি মেয়েদের স্কুলে প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে শিক্ষিকাদের বৈঠক চলছে। ছাত্রছাত্রীদের ট্যাব বিলি করা, সংখ্যালঘুদের স্কলারশিপ পর্যালোচনা, ঐক্যশ্রী পোর্টালে নাম তোলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বৈঠক শেষে মাইক বন্ধ করে ঘরোয়া ভাবে প্রশাসনিক কর্তারা জানিয়ে দিলেন, কারও নাম যেন বাদ না যায়। সব রকম সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দিতে হবে। নিয়মমতো মাপকাঠি মেনে যেন সব কিছু হয়, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।
দুটো দৃশ্য একেবারেই কাল্পনিক নয়। দিল্লি হোক বা পশ্চিমবঙ্গ, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এ সব রোজকার অভিজ্ঞতা। কারণ দুই ক্ষেত্রেই শিক্ষা ভোটব্যাঙ্ক তৈরির হাতিয়ার। শিক্ষার আঙিনা রাজনীতির বাহনে পরিণত।কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি শিক্ষার গৈরিকীকরণ করে নিজের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে চায়। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল শিক্ষায় দুর্নীতিকরণ তো করেছেই, তার সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রকে কন্যাশ্রী থেকে রূপশ্রী, ঐক্যশ্রী থেকে তরুণের স্বপ্নের মতো বিভিন্ন প্রকল্পে খয়রাতি বিলির মাধ্যমে পরিণত করেছে। দুই দলের কাছেই স্কুল আসলে শিক্ষাদানের মাধ্যম নয়, ভোটের রাজনীতির হাতিয়ার।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি খারিজের পরে মনে হয়েছিল, আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি বুঝি ব্রহ্মাস্ত্র হাতে পেয়ে গেল। সুপ্রিম কোর্ট শুধু চাকরি খারিজ করেনি, স্কুলের নিয়োগ ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার দিকে আঙুল তুলেছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন যে দুর্নীতি সত্ত্বে সকলের চাকরি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এই যোগ্য ও দাগি-দের ফারাকটা করতে চাইছিল না, তাও যতখানি স্পষ্ট ভাবে সম্ভব বলে দিয়েছে।
যে কোনও রাজ্যে বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে এমন রাজনৈতিক গোলাবারুদ হাতে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এই মুহূর্তে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হত, তা হলে হয়তো আন্দোলনের ঠেলায় গোটা রাজ্যে অচলাবস্থা তৈরি হত। কিন্তু বিজেপি কী করল? প্রথম দিকে শুভেন্দু অধিকারী বা সুকান্ত মজুমদাররা বেশ সরব হলেন বটে, কিন্তু তার পরে অচিরেই তাঁরা হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাস্তায় নেমে বাসে, লরিতে ধর্মীয় পতাকা লাগাতে বেশি মরিয়া হয়ে উঠলেন। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, যোগ্য শিক্ষকদের জন্য বিজেপি অবশ্যই লড়বে। কিন্তু আগে ধর্মকে বাঁচাতে হবে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী হিন্দু শহিদ দিবস পালনের কথা ঘোষণা করেছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো এর অপেক্ষাতেই ছিলেন। কারণ শিক্ষায় দুর্নীতির প্রসঙ্গ যত প্রচারের আলোয় থাকবে, যত এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে, ততই তাঁর শিক্ষিত ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরার আশঙ্কা বাড়বে। উল্টো দিকে ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে আন্দোলন বাড়লে, তাকে ঘিরে ধর্মীয় মেরুকরণ হলে তাঁর সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক আরও এককাট্টা হবে। কংগ্রেস, সিপিএমের দিকে একটি মুসলিম ভোটও যাতে ছিটকে না যায়, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রী প্রথমেই রাজ্যে ওয়াকফ আইন কার্যকর হবে না বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। বিজেপি যত উগ্র হিন্দুত্বের পথে যাবে, ততই তৃণমূলের লাভ। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট যদি এককাট্টা হয়ে তৃণমূলের ঝুলিতে পড়ে, তার সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী এবং বিজেপিবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের ভোট যোগ হয়, তা হলে ২০২৬-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্থ বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিশ্চিত।
বিজেপির মুশকিল হল, নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বা শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিজেপির নিজের ট্র্যাকরেকর্ড মোটেই ভাল নয়। গুজরাত, রাজস্থান, যেখানেই বিজেপি বেশি দিন ক্ষমতায় থেকেছে, সেখানেই সরকারি চাকরি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা আকছার দেখা যায়। মধ্যপ্রদেশের নিয়োগ দুর্নীতির ব্যপম কেলেঙ্কারিতে সাক্ষী থেকে তদন্তকারী সাংবাদিকরা খুন হয়েছেন। কেন্দ্রে বিজেপি আসার পরেও নিট পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কম হইচই হয়নি।
আর শিক্ষার মানোন্নয়ন? নরেন্দ্র মোদী সরকার শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে জাতীয় শিক্ষা নীতি চালু করেছে বটে, তবে তাতে শিক্ষার মানোন্নয়নের বদলে পাঠ্যক্রমের গৈরিকীকরণ এবং নিজের সুবিধা মতো নতুন করে ইতিহাস লেখার দিকে ঝোঁক বেশি বলে অভিযোগ। তুঘলক, খিলজি, লোদীদের সঙ্গে মোগল আমল ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে। বিজ্ঞানের বই থেকে বাদ গিয়েছে ডারউইনের তত্ত্ব। গান্ধী হত্যার পরে যে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। গান্ধী যে বলেছিলেন, ভারতকে শুধু হিন্দুদের রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা হলে ভারতকে ধ্বংস করা হবে, তা-ও নিঃশব্দে বাদ চলে গিয়েছে পাঠ্যপুস্তক থেকে।
জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ হল, রুটিরুজির প্রশ্ন থেকে নজর ঘোরাতে বিজেপি বার বার হিন্দুত্বের রাজনীতির আশ্রয় নেয়। হয়তো সেই অভ্যাসেই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগের মতো রুটিরুজির প্রশ্ন থেকে নজর সরিয়ে ধর্ম রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া বেশি প্রয়োজন বলে মনে করেছে। মুশকিল হল, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বা শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখা শুধু রুটিরুজির প্রশ্ন নয়, এর সঙ্গে গভীর সামাজিক প্রশ্নও জড়িত।
ছাত্রছাত্রীরা যদি স্কুলে যাওয়ার আগে জানতে পারে, তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা হয়তো ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তা হলে তারা কি শিক্ষকদের কথা শুনবে? শিক্ষক-শিক্ষিকারা যদি নিজেদের চাকরি নিয়েই নিশ্চিত না থাকেন, তা হলে কী ভাবে পড়াবেন? একই স্কুলের কিছু শিক্ষক যদি মনে করেন, বাকিরা ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন, তা হলে তাঁরা এক সঙ্গে কাজ করবেন কী ভাবে?
কন্যাশ্রী প্রকল্পে অনুদান থেকে সবুজ সাথী প্রকল্পে সাইকেল বিলির লক্ষ্য মহৎ ছিল। মাঝ পথে স্কুল ছেড়ে দেওয়া ঠেকাতে বা অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া বন্ধ করতে স্কুলের পরে উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়া অবিবাহিত মেয়েদের জন্য এত থোক টাকার প্রকল্পও চালু করেছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু উদ্দেশ্যর থেকে যখন বিধেয় বড় হয়ে ওঠে, তখন লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া অবধারিত। পশ্চিমবঙ্গে তাই ১৮ বছরের আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার ঘটনা যথেষ্ট বলে সরকারি পরিসংখ্যানই জানিয়েছে। জেলার স্কুলের শিক্ষিকারা জানেন, মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে হয়ে গেলেও তারা সিঁদুর মুছে স্কুলে চলে আসে যাতে সরকারি অনুদানের টাকা পাওয়া যায়। বিয়ে হয়নি বলে শাসক দলের বিধায়ক বা পঞ্চায়েত প্রধানরাই শংসাপত্র লিখে দেন। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাত বাঁধা। তাঁদের কিছুই করার নেই।
শিক্ষাব্যবস্থার এই সঙ্কট নিয়ে রাজ্যের বিরোধী দল বিজেপিকে কোনও দিনই সে ভাবে চিন্তিত হতে দেখা যায়নি। তারা অনেক বেশি চিন্তিত হিন্দুত্বের সঙ্কট নিয়ে। ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ স্লোগান দেওয়ার সুযোগ পেলে তাঁর আর কিছুই চান না। তাই চাকরিহারা শিক্ষকদের থেকেও বিজেপির কাছে এখন মুর্শিদাবাদের হিংসা বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। বিজেপি নেতারা হয়তো মনে করছেন, মুসলিম বিদ্বেষ তৈরি করতে পারলে হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ তাঁদের ভোট দেবেন। আর এত দিন যাঁরা বিজেপিকে হিন্দি বলয়ের সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে চিহ্নিত করে তৃণমূলকেই ভোট দিয়েছেন, তাঁরা এখন তৃণমূলের দুর্নীতি ও সংখ্যালঘু তোষণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিজেপিকে বেছে নেবেন।তৃণমূল ও বিজেপির এই ভোটের অঙ্ক কষার ঠেলায় লাটে উঠছে শিক্ষা। বলি হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। দুঃখের কথা হল, রাজ্যের মানুষের সামনে আর কোনও তৃতীয় বিকল্পও নেই। সিপিএম-কংগ্রেস এখনও শূন্যের ঘর থেকে মুক্তির পথ খুঁজতেই ব্যস্ত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)