Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
GDP

সরকারি খরচ কম নয়, তবু অনেক দেশের তুলনায় ভারতে পরিষেবার মান খারাপ কেন?

ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরিষেবা প্রদান করে না, এমন নয়। কিন্তু সেই পরিষেবার গুণগত মান বেশ খারাপ।

Does Indian government spending low and delivers poor infrastructure

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৫৫
Share: Save:

ভারতে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারগুলি কিছুতেই এমন দাবি করতে পারে না যে, তারাই বিশ্বে সব থেকে বেশি টাকা খরচ করছে। অন্যান্য বহু দেশের সরকার সে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি)-এর তুলনায় অনেক বেশি টাকা খরচ করে থাকে। এগিয়ে থাকা অর্থনীতির দেশগুলি তো বটেই, এমনকি লাতিন আমেরিকা, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির ক্ষেত্রে এর উদাহরণ আকছার। কিন্তু, ভারত সরকার বা দেশের রাজ্য সরকারগুলি খরচের কথায় যে ভেঙে পড়ে, এমন নয়। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক’-এর প্রতিবেদনে উল্লিখ করা পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সমবেত ভাবে দেশের জিডিপি-র ২৮ শতাংশ অর্থ খরচ করে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি, সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলির (তাদের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত) তুলনায় যা অনেকটাই বেশি। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের জিডিপি-র অনুপাতে ব্যয়ের তুলনাতেও ভারতের সরকারি খরচের পরিমাণ বেশি।

আরও পড়ুন:

টাকা তো খরচ হল, কিন্তু প্রশ্ন এই— খরচের ফল কী দাঁড়াল? উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের সরকারি স্তরে ব্যয় তার জিডিপি-র ১৪.৫ শতাংশ, যা কার্যত ভারতের অর্ধেক। কিন্তু, সে দেশের বাসিন্দাদের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল এবং স্কুলশিক্ষার মান ভারতের চাইতে উন্নত। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ভারতের প্রায় সমান সমান। জিডিপির তুলনায় কম অর্থ ব্যয় করেও তাইল্যান্ড বা ভিয়েতনাম সরকার স্বাস্থ্য বা শিক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এদের প্রত্যেকের এবং আরও অনেক দেশেরই রাজকোষে ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু, বেশির ভাগেরই সরকারি ঋণের পরিমাণ কম। ভারতের সরকারি ঋণ যেখানে ৮৩.২ শতাংশ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা এর অর্ধেক এবং ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে তা আরও কম। সুতরাং এ কথা কিছুতেই বলা যায় না যে, ভারত বিপুল অর্থ ব্যয় করছে এবং উন্নততর পরিকাঠামো বা পরিষেবা দিতে পারছে। সমস্যাটিকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?

এর একটি উত্তর হল, শতাংশের হিসাব অনেক সময়েই ভ্রান্তি তৈরি করে। কম জিডিপির সাপেক্ষে উচ্চতর শতাংশের মাথাপিছু খরচের তুলনায় যদি অধিক জিডিপি-র সাপেক্ষে কম খরচকে দেখা হয়, তা হলে সেই বিচার যথাযথ হবে না। সে দিক থেকে দেখলে, ভারত তার জিডিপি-র তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে খরচ করতেই পারত। কিন্তু তা সত্ত্বেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উচ্চতর আয়ের দেশগুলির চাইতে তার মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ কম। এবং সেই কারণেই স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো ক্ষেত্রে তার পরিষেবার মানও বেশ খারাপ। মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ কম রেখেও উন্নততর পরিষেবা দানের একমাত্র উদাহরণ হল বাংলাদেশ।

কিন্তু ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরিষেবা প্রদান করে না, এমন নয়। কিন্তু সেই পরিষেবার গুণগত মান বেশ খারাপ। সে দিক থেকে বিচার করলে সরকারি প্রকল্পগুলিকে সরকারের বৃত্তে আবদ্ধ না-রেখে তাকে গণমুখী করে তোলার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে বিবেচনা করার অবকাশ থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি, জি২০ সম্মেলনের আবহে নরেন্দ্র মোদী বিষয়টিকে জিডিপি-র দিক থেকে না দেখে মানবিক দিক থেকে দেখার বিষয়ে যুক্তি দিয়েছেন।

মোদীর কথা মতো তিনি গণমুখী ভিত্তিতে বেশ কিছু কাজ করেছেন। সর্বজনীন স্তরে বিদ্যুৎ এবং কলের জল সরবরাহ, গৃহবধূদের হাতে ভর্তুকি প্রাপ্ত রান্নার গ্যাস তুলে দেওয়া, সরকারি অনুদানে গৃহনির্মাণ প্রকল্প চালু করা, শৌচালয় তৈরি, বিনামূল্যে খাদ্যশস্য প্রদান ও নিখরচায় স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা এবং কৃষকদের হাতে অর্থের জোগান দেওয়া ইত্যাদি এর উদাহরণ। লক্ষণীয়, এই সব কাজের পাশাপাশি মোদী সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়েছেন। বিশেষ করে, পরিবহণ পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ বেশ চোখে পড়ার মতো। ভবিষ্যতের জন্য, বাছাই কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়াতে তিনি সরকারি ইনসেন্টিভের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনাও করে রেখেছেন।

মোদীর এই পদক্ষেপগুলির আর্থ-সামাজিক ফলাফল নিয়ে বিবেচনার সময় এখনও আসেনি। সরকারি পরিসংখ্যান ব্যবস্থা ( বিশেষ করে, জনগণনা না হলে ভোক্তার সংখ্যা জানাই যাবে না) অংশত এর জন্য দায়ী। সেই সঙ্গে এ-ও মনে রাখা দরকার যে, সাম্প্রতিক উদ্যোগগুলির বাস্তবায়ন এখনও শুরু হয়নি। যাই হোক, একটি সমস্যা কিন্তু ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। সেটি হল— সাধারণ ভাবে জিডিপি-র অংশ হিসেবে সরকারি রাজস্বে (কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় ক্ষেত্রেই) গত কয়েক বছরে সামান্য পতন লক্ষ করা যাচ্ছে। সেখানে এক দশক আগেকার শতাংশ-ভিত্তিক হিসাবের তুলনায় জিডিপি-র নিরিখে খরচের পরিমাণ বেড়েছে। যার ফলে ঘাটতি এবং সরকারি ঋণের পরিমাণও বাড়তির দিকে। এর জন্য নিঃসন্দেহে কোভিড পরিস্থিতি কিছুটা হলেও দায়ী। রেটিং এজেন্সি ‘ফিচ’ রাজকোষ ঘটিত সমস্যাকে এর পিছনে ক্রিয়াশীল অন্যতম কারণ হিসাবে দেখাচ্ছে।

রাজকোষে ঘাটতি এবং ঋণ— উভয় ক্ষেত্রেই সঙ্কোচনের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। এবং ব্যয় না-কমিয়েই তা করা কাঙ্ক্ষিত। মাথাপিছু জিডিপি-র হারে বৃদ্ধি ঘটাতে গেলে যে পরিমাণে দ্রুত আর্থিক উন্নতি আশা করা যায়, তা পেতে হলে এই কাজটি আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমুখী সরকারের তরফে যা করা একান্ত প্রয়োজন, তা হল— খরচের বিষয়টিকে পুনরায় মাথায় রেখে সামাজিক স্তরে বিনিয়োগ এবং গণকল্যাণমুখী প্রকল্পে বেশি অর্থ ব্যয় অথবা আর্থিক বৃদ্ধির মাধ্যমে বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি এই কাজে সফল হয়েছে। কারণ, তারা এই দু’টি কাজ দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছে। সরকারের তরফে গণমুখী হওয়া এবং একই সঙ্গে জিডিপি-র বিষয়টিকে মাথায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, শেষ পর্যন্ত অর্থনীতির বৃদ্ধিই বিবেচ্য। অন্য কিছু নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

GDP Fiscal deficit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy