E-Paper

প্রত্যন্তবাসী নাট্যরথী বন্ধু

হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের (১৯৪১-২০২৫) নানা মজার অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম ছিল বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতানোর এক-একটা বাঁধা খত। আমার জন্য যেমন বাঁধা ছিল ‘প্রিয়তম বন্ধু’, তেমনই গল্পকার অভিজিৎ সেনের জন্য ‘জামাই’।

শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৪৩
Share
Save

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির জয়যাত্রায় পুরাতন স্মৃতিচিহ্নগুলো অবান্তর হয়ে গিয়ে নতুন স্মৃতিচিহ্ন সারবান হয়ে ওঠে। আমার মোবাইলে ধরা আছে, শেষ দুটো তারিখে হরিমাধবকে পাঠানো আমার দুটো বার্তা: ‘২৬ জুন ২০২৪। এই মাত্র তোমার তিন খণ্ড নাট্যসংগ্রহ পেলাম। কৃতার্থ। প্রভূত ধন্যবাদ। শমীক। ১৩.১১’। ‘৪ অক্টোবর ২০২৪। কাল রাত্রে ফোন করেছিলে? এখন ফোন করলাম। সুইচ্‌ড্‌ অফ বলল। ১০.৪৯’।

তার পরও আরও ক’বার ফোন করেছি। যোগাযোগ হয়নি। সেই ফোনালাপ-বিচ্ছেদের কয়েকদিন মাত্র আগে যে বার শেষ হরিমাধবের সঙ্গে ফোনে কথালাপ হয়, সে বার তাঁর স্বরে পাইনি তাঁর অভ্যস্ত উদ্দীপ্ত উষ্ণতা, পেয়েছিলাম রোগাবসাদের ইঙ্গিত। তখনই কি জরাব্যাধি তাঁকে মারণটান মেরেছে? জানি না।

রয়েছে আরও একটি স্মৃতিচিহ্ন। হরিমাধবের নাট্যসংগ্রহ-এর প্রথম প্রকাশিত খণ্ডের শুরুতে তাঁর স্বহস্তবয়ান: ‘প্রিয়তম বন্ধু শমীক/ হরিমাধব মুখোপাধ্যায়/ ২৭/৯/২০১৯ বালুরঘাট’।

হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের (১৯৪১-২০২৫) নানা মজার অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম ছিল বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতানোর এক-একটা বাঁধা খত। আমার জন্য যেমন বাঁধা ছিল ‘প্রিয়তম বন্ধু’, তেমনই গল্পকার অভিজিৎ সেনের জন্য ‘জামাই’। এই সম্পর্কের খত পাতানোর স্বভাবলক্ষণ হরিমাধবের নাট্যনির্মাণের স্বভাবগত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর শ্রেষ্ঠ নাট্যকৃতিগুলির জন্য তিনি অন্যের গল্পের যে নাটকায়ন করে তার প্রযোজনা করেছেন, তাতে উৎস-গল্পের আদল ঘিরে শুধু চরিত্রে চরিত্রে নয়, চরিত্রের সঙ্গে তার সমাজ-সংস্কার-সংস্কৃতিরও যে অফুরান শাখাপ্রশাখায়িত মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটা কালপরিবেশের আবর্ত রচনা করার পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন— এক বার নয়, বহু বার— তার যোগ্য স্বীকৃতি, তাঁর জোটেনি। কারণ, তিনি আজীবন তাঁর নাট্যসাধনা করে গেছেন, কলকাতা থেকে বহু দূরে, উত্তরবঙ্গের বালুরঘাটে। পড়ুয়া, অধ্যবসায়ী, অধ্যাপকবৃত্তিতে নিষ্ঠাব্রতী, প্রতিভাবান মানুষটির আত্মপ্রচারে বা থিয়েটারি ব্যবসায়ী-পনায় প্রবৃত্তি ছিল না। কোনও বঞ্চনাবোধের লক্ষণ দেখিনি কোনও দিন।

১৯৫০-৭০ দশক জুড়ে বহুরূপী, এলটিজি, পিএলটি, নান্দীকার, নক্ষত্র, থিয়েটার সেন্টার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, চতুর্মুখ, থিয়েটার ইউনিট, সুন্দরমের নাট্যকাণ্ডে উদ্বেলিত আমাদের মতোই হরিমাধবও ১৯৫৬ সালে বালুরঘাট থেকে কলকাতায় পড়তে এসে ওই নেশাতেই মজে যান। ১৯৬৭-৬৮ সালে পাকাপাকি ভাবে বালুরঘাটে ফিরে এসেই স্থানীয় তিনটি নাট্যদলকে একত্র করে ত্রিতীর্থ নাট্যদল তৈরি করে রাজধানী শহরের ‘নবনাট্য’-এর আদলেই পুতুলখেলা, ফেরারি ফৌজ, নাট্যকারের সন্ধানে, শের আফগান মঞ্চস্থ করে যান। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হরিমাধব বলেন, “ওই মডেলটা, ওই হ্যাংওভারটা থেকেই আমার শুরু। ওই মডেলটা ফলো করতে করতেই সেভেনটিজ়-এর শেষ দিকে গিয়ে মনে হল, এটা একটা রং ওয়ে। আমাদের নিজেদের থিয়েটারটা করতে হবে।” কলকাতায় সত্তর দশকের শেষাশেষি দল ভাঙনের ক্রমান্বয়তায়ও আদি দলের নাট্যধর্মরীতি মেনেই নতুন দলের সামান্য ব্যত্যয়ে পুরাতন রীতির পুনরাবৃত্তির ফাঁক-ফাঁকিটা যখন আমাদেরও বিব্রত করছে, তখনই একটা চমকপ্রদ ‘আবিষ্কার’-এর মতোই কলকাতায় এসে পড়েছিল হরিমাধবের রোমহর্ষক নাট্যকীর্তি, বালুরঘাটের ত্রিতীর্থ প্রযোজনায় দু’টি রূপান্তরিত জার্মান নাটক— ক্লাইস্‌ট্‌-এর ভাঙা পট ও ড্যুরেনমাট্‌-এর তিন বিজ্ঞানী— দুই ভিন্ন জাতের নাটক— প্রথমটি উত্তরবঙ্গের রাজবংশী ভাষায়— ডায়ালেক্ট-এ— উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক স্থানিকতায় কী স্বতন্ত্র, অথচ কী এক আন্তর স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ওই অপরিচিত, পূর্বে অশ্রুত ভাষা ও দৃশ্যবিন্যাস, অভিনেতাদের আচার-আচরণের সঙ্গতিতে কলকাতার নাগরিক দর্শকদের নাটকের গভীরে নিয়ে গিয়েছিল। ওই একই সম্প্রদায় ওই একই সফরে ড্যুরেনমাট্‌-এর নাটকের পশ্চিমি বিজ্ঞানজগতের চিন্তাপ্রবাহের দ্বন্দ্ব-সংশয়ের বিচার-রণক্ষেত্রে ভাবনাবিহ্বল করে দিয়েছিল আমাদের।

আমাদের যে সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছি, তাতেই এই চমকপ্রদ দ্বৈতাভিজ্ঞতার বিস্ময় স্মরণ করে হরিমাধবকে যখন বলি, “দুটোর পার্থক্য চমকে দেওয়ার মতো। কোথাও ভাঙা পট-এর ভাবনা তিন বিজ্ঞানী-তে রিপিট হচ্ছে না।... তুমি তা হলে বলছ, কলকাতার ঐতিহ্যের প্রতি একটা সংশয় এবং সন্দেহ থেকেই তুমি এই নতুন মডেলের দিকে গেলে?” হরিমাধব ধরিয়ে দেন, কলকাতা-বালুরঘাটে যুগপৎ পরিচিত— অকালপ্রয়াত— আমাদের জার্মাননবিশ বন্ধু নীহার ভট্টাচার্য ওই জার্মান নাটক দু’টি ইংরেজি অনুবাদে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে, পরে নিজে সরাসরি জার্মান থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দিয়ে, কলকাতায় ম্যাক্সমুলার ভবনের জার্মান নাট্যোৎসবে নাটক দু’টি পরিবেশনার উদ্যোগ-যোগাযোগের দায়িত্ব গ্রহণ করে হরিমাধব ও ত্রিতীর্থকে কলকাতার নবনাট্যের মায়াঘোর কাটিয়ে অন্য পথ গ্রহণ করার স্পর্ধাটা জুগিয়ে দিলেন। কলকাতার দর্শকরাও তার আঞ্চলিকতার আকাঁড়া স্বাদে যে ধাক্কা খেলেন, তার অভিঘাতেই মফস্‌সল বাংলার থিয়েটারের স্বাতন্ত্র্য মহানগরে প্রথম মর্যাদান্বিত হল। বাংলায় থিয়েটারে শহর কলকাতার আধিপত্যে এক ধাক্কায় চিড় খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া থিয়েটারের প্রাণধারণ দেশে-দেশান্তরে সর্বত্রই তার নিজস্ব প্রত্যক্ষ তাৎক্ষণিক দর্শকসমাজের প্রাণরসে তথা সহজাত সমাদরে। সেই থিয়েটারের— উত্তরবঙ্গের নিজস্ব প্রাণের থিয়েটারের স্বচ্ছন্দ বহতার— সুলুকসন্ধান হরিমাধব পেয়েছিলেন বাংলা থিয়েটারের আর এক মহীরুহের কাছে। হরিমাধব কখনও ভোলেননি, “মহাজাতি সদনের পিছনের মাঠে বিজনদার (বিজন ভট্টাচার্যের) দেবীগর্জন দেখলাম। আমি দেখে, শমীক, স্টুপিফাইড হয়ে বসে থাকলাম খানিকক্ষণ। তখন দেবীগর্জন ভাবো, শ্যামল ঘোষ, রেবা রায়চৌধুরী, সজল রায়চৌধুরী, কবিতা, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়— সবাই মিলে কী রকম জমিয়ে তুলেছেন। বিজনদার থিয়েটার আমাকে ভাবিয়ে তুলল।”

হরিমাধব বিজন ভট্টাচার্যের প্রযোজনাতেই পেয়েছিলেন একটা অঞ্চলবিশেষের ভৌগোলিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-ভাষাগত সত্য তথা সত্তাকে তার পরিপূর্ণতার অনুপুঙ্খে আয়ত্ত করে শব্দকথায় তার স্বরের— আঞ্চলিক টানের বিশিষ্টতায়— উচ্চারণের শারীরবিভঙ্গে বাঙ্ময় করে তোলার নিশ্ছিদ্র কারিগরি। বালুরঘাটে এসে ভাঙা পট দেখে মুগ্ধ বিজনবাবু হরিমাধবকে বলেছিলেন, “এই পাওয়ার নিয়া... তুমি মনের দিক দিয়া ঠিক থাইকবা, আমাদের আশীর্বাদ কইরবার কেউ নাই। নিজের হাত নিজের মাথায় দিয়া আশীর্বাদ কইরতে হবে।” ত্রিতীর্থ প্রযোজনায় কলকাতার অবন মহলে বিজনদার সঙ্গে বসে দেবীগর্জন দেখতে দেখতে তাঁর স্বভাবোচিত মুগ্ধতার উচ্ছ্বাস শুধু লক্ষ করেছি, তা-ই নয়, বার বার আমার হাত চেপে ধরেছেন। বিজনদার শ্লাঘা ছিল, বাংলাদেশ, অসমে কুড়ি মাইল অন্তর অন্তর উপভাষার যে স্বরান্তর ঘটে, তা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন, সেই সংবেদনশীলতায় দীক্ষিত হরিমাধবও রাজবংশী বা ঢাকাই উপভাষায় বিজনদার কথার ‘দার্ঢ্য’ না পেয়ে তাঁর রাঢ়ী ভাষা তুলে নিয়ে তাতেই তাঁর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তৈরি করে নিয়েছিলেন।

এক দিকে নির্দিষ্ট এক আঞ্চলিক প্রাকৃতিক-চৈতন্যজারিত আবহ, অন্য দিকে অবলম্বিত সাহিত্যের নিখাদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যসাধনে হরিমাধবের বিস্তার ও ঋদ্ধির পরাকাষ্ঠা মহাশ্বেতা দেবীর গল্প অবলম্বনে তাঁর জল নাট্য— মূল গল্পে ছড়ানো-ছিটোনো কত উপাদান যে হরিমাধব প্রাণময়, শরীরায়ত, ব্যঞ্জনাময় করে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাকে একটা স্থানিক বাস্তবতা দিয়েছেন যে মহাশ্বেতার গল্প শেষ পর্যন্ত প্রাণদ বীজের ভূমিকাই পালন করেছে। কৃত্তিবাস পত্রিকায় ১৯৭৯ সালে মহাশ্বেতার ‘জল’ পড়ে হরিমাধব আমায় বলেন, গল্পটা ওঁকে ‘ভীষণই টেনেছিল’, আমি তাঁকে মহাশ্বেতা দেবীর বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিলে মহাশ্বেতাদি নিজেই নাট্যরূপ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তত দিনে ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘আজীর’, ‘বাঁয়েন’ নাট্যরূপ দিয়ে ফেলেছেন তিনি। হরিমাধব তাঁর নাট্যসমগ্র-র ভূমিকায় লিখেছেন, “স্ক্রিপ্ট-টা হাতে পেয়ে খানিক হতাশ হলাম— কেননা লোকসমাজ ও লোকসংস্কৃতির যে বিরাট ব্যাপ্তি এই নাটকে থাকার কথা, তা ওঁর স্ক্রিপ্ট-এ ছিল না।” আমিও মহাশ্বেতাদির কাছে সেই নালিশ করি। মহাশ্বেতাদি হরিমাধবকে লিখলেন, “থ্রো অ্যাওয়ে মাই স্ক্রিপ্ট ইন দ্য ডাস্টবিন অ্যান্ড রাইট ইট ইয়োরসেল্ফ, ইউ হ্যাভ দ্য লিবার্টি।” আমাদের সেই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের শেষে এসে হরিমাধব বলেছিলেন, “শমীক, আমার সব সময় মনে হয়েছে দ্য টেক্সট ইজ় আ চ্যালেঞ্জ টু মি।” থিয়েটারের চূড়ান্ত সিদ্ধি একটা সার্থক নাটকের গভীর থেকে তার সারসম্পদ তার স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করে তোলা। থিয়েটারি চমকদারি, বাহাদুরি, চটপট করতালির প্রসাদে থিয়েটারকে অধঃপাতিত করতে এই প্রত্যন্তবাসী নাট্যকর্মী কদাচ প্রস্তুত ছিলেন না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Legend Dramatist

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

ক্যানসেল করতে পারবেন আপনার সুবিধামতো

Best Value
প্রতি বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
প্রতি মাসে

৪২৯

১৬৯

প্ল্যানটি সিলেক্ট করে 'Subscribe Now' ক্লিক করুন।শর্তাবলী প্রযোজ্য।