E-Paper

‘রসভরা রসময় রসের ছাগল’

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম হাস্যরসিক লেখক ঈশ্বর গুপ্ত। মনে পড়ে তাঁর ‘পাঁটা’ কবিতা: “রসভরা রসময় রসের ছাগল। তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।।”

পিনাকী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৫৫
Share
Save

অঙ্গদ বলে সত্য করে কওরে ইন্দ্রজিতা।/ এই যত বসি আছে সব কি তোর পিতা।।/ কোন্ বাপ তোর দিগ্বিজয় কৈল তিনলোকে।”— এমন কথা বললে কোন ছেলে না লজ্জা পায়! মেঘনাদের হাল দেখে রাবণ মায়াভঙ্গ করতে বাধ্য হলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডে রামের হয়ে দৌত্য করতে লঙ্কায় উপস্থিত বালীপুত্র অঙ্গদ দেখেন, তাঁকে বিভ্রান্ত করতে সকলকে মায়াপ্রভাবে রাবণাকৃতি করে রেখেছেন রাবণ। প্রকৃত রাবণকে খুঁজে পেতে কৌশলী অঙ্গদ, মেঘনাদকে ‘কোন বাপ তোর...’ প্রশ্নে উত্ত্যক্ত করতেই এল সাফল্য। মায়াভঙ্গ করে রাবণের চ্যালেঞ্জ, “রাবণ বলে শোন্ বানরা তোরে বলি।/ কোথা হতে মরিবারে লঙ্কাপুরে এলি।।” এমন রঙ্গরীতি অলঙ্কারশাস্ত্রে ‘বক্রোক্তি’ রূপে পাই। স্বাভাবিকের সঙ্গে সঙ্গতিরক্ষা না হলেই আসে অনৌচিত্য, রঙ্গব্যঙ্গে যা গোড়ার কথা।

চর্যাগানের পদেও মেলে স্বভাববৈপরীত্য: “বলদ বিআএল গাবিআ বাঁঝে। পিটা দুহিএ এ তিনা সাঁঝে।।” বলদ প্রসব করল, কিন্তু গাই থাকল বন্ধ্যা। উদাহরণটি কৌতুক জাগায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ রাধা কৃষ্ণ বড়াই তিন চরিত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্ন কৌতুকের পাশাপাশি এসেছে শ্লেষ ও বিদ্রুপ। কৃষ্ণ নৌকার হাল ধরেছেন, ভার বয়েছেন, ধরেছেন ছাতা; জগতের নাথের এমন কাণ্ড কৌতুকের। রাধাকৃষ্ণের উক্তি-প্রত্যুক্তি তিরস্কারে তপ্ত, রঙ্গরসে উজ্জ্বল। পদ্মাপুরাণ-এ চণ্ডী ও পদ্মার কলহ মঙ্গলকাব্যে রঙ্গতামাশার প্রতিভূ। ধর্মমঙ্গল-এ লাউসেন ও কর্পূর-ধবল দুই ভাই গৌড়ের পথে বেরিয়ে বাঘের রাজ্যে পৌঁছয়, বাঘের নামে ভাই ভীত হলে লাউসেনের অভয়: “বাঘকে বৎসের তুল্য মানি চিরকাল।/ দেখিবে এখনি মেরে ঘুচাব জঞ্জাল।।” এই বাগাড়ম্বরে লুকিয়ে কৌতুক। মুরারি শীল, ভাঁড়ু দত্তের মতো চরিত্র রচয়িতার রঙ্গপ্রিয় মনটি দেখায়, ঠাট্টার আবহে সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরে। কালকেতুর দাপটে ধ্বস্ত পশুদের দেবীর কাছে নালিশ কৌতুকের, দুঃখেরও: “বনে থাকি বনে খাই জাতিতে ভালুক/ নেউগী চৌধুরী নহি না করি তালুক।”

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম হাস্যরসিক লেখক ঈশ্বর গুপ্ত। মনে পড়ে তাঁর ‘পাঁটা’ কবিতা: “রসভরা রসময় রসের ছাগল। তোমার কারণে আমি হয়েছি পাগল।।” প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যের তুলনায় উনিশ শতকে রঙ্গব্যঙ্গে সূক্ষ্মতা, ভিন্নতা এসেছে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বর গুপ্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ বসু, অমৃতলাল বসু প্রমুখের হাতে। এঁরা আধুনিক বাংলা হাস্যরসের প্রথম যুগের শিল্পী। উনিশ শতকে নবযুগের উন্মেষকালে ব্যঙ্গাত্মক, নকশা জাতীয় রচনারই প্রাধান্য। ফোর্ট উইলিয়াম, শ্রীরামপুরে প্রাতিষ্ঠানিক গদ্যচর্চা শুরু হলেও সেখানে হাসি, কৌতুক যেমন ছিল না, তেমনই তা আমজনতার ছিল না।

মানুষের কাছে খবর, সাহিত্য পৌঁছনোর তাগিদে এল সাময়িকপত্র। রঙ্গব্যঙ্গ শুরু থেকেই তার সঙ্গী। পশ্বাবলী, সম্বাদ রসরাজ, পাষণ্ডপীড়ন, সংবাদ দিনমণি-র পরে আসে বিদূষক, হরবোলা ভাঁড়। রঙ্গব্যঙ্গের বিষয় সেখানে হুতোমি ঢঙে বাবু সম্প্রদায়, রাজনীতি। বসন্তক, বঙ্গীয় ভাঁড়, বাঁদরামি, রসতরঙ্গ, রসিকরাজ বা ঢাকা থেকে প্রকাশিত সদানন্দ, শ্রীহট্টের ফুলতত্ত্ব প্রকাশিকা রঙ্গব্যঙ্গের আকর।

উনিশ শতকের শেষ পর্বে রসরচনায় নেতিদৃষ্টির বদলে উদ্দেশ্যমূলকতা, আক্রমণের স্থূলতা কমে হাস্যরস গভীর অনুভবের দোসর হল। ছুচ্ছুন্দরীবধ কাব্য-এ ব্যঙ্গাত্মক অনুকৃতির জন্য স্মরণীয় জগবন্ধু ভদ্র। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লোকরহস্য-তে বাঘের সভায় অমিতোদর নামের বাঘ বলে, “সভ্য জাতীয়েরা অতি স্পষ্ট করে গালি দেয় না। প্রচ্ছন্নভাবে আপনি আরও গুরুতর গালি দিতে পারেন।” ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও বাগ্‌বৈদগ্ধ্য মিশে গেল বঙ্কিমে। সমাজের অসঙ্গতি অননুকরণীয় ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। এ সময়ে বহতা পত্রিকার প্রবাহও, ১৮৭৮-এ চুঁচুড়া থেকে বেরোয় ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যঙ্গপত্রিকা পঞ্চানন্দ। ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’, ‘গোড়ায় গলদ’, ‘ব্যঙ্গকৌতুক’ প্রণেতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা সর্বতোমুখী।

বিশ শতকে সংশয়-অবিশ্বাস-অসহিষ্ণুতার সঙ্গে ঘনীভূত হল নানা জিজ্ঞাসা। নারায়ণ পত্রিকার পাতায় হরিদাস হালদারের লেখা ‘গোবর গণেশের গবেষণা’র অংশবিশেষ প্রকাশিত হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এই চিকিৎসক-সাহিত্যিকের লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথ সপ্রশংস চিঠি লেখেন প্রমথ চৌধুরীকে। সূক্ষ্মবুদ্ধির অধিকারী গবেষক গোবর গণেশের দর্শনে পৃথিবী কক্ষপথে ছুটছে ‘হায় রে পয়সা’ হেঁকে। তির্যক দৃষ্টি, শাণিত ব্যঙ্গে গণেশ ধর্ম, আইন, প্রেমের নিরীক্ষণ লিপিবদ্ধ করেছে; উঠে এসেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমকালীন নানা ছবি। বক্কেশ্বরের বেয়াকুবি নামে হরিদাসবাবুর দ্বিতীয় গ্রন্থে গাঁজাখোর বক্কেশ্বর ‘কমলাকান্ত’-এর প্রতিরূপ।

এমন সময়েই রঙ্গব্যঙ্গের দুনিয়ায় পরশুরামের সাড়ম্বর আবির্ভাব। দোসরহীন সুকুমার রায়ের পাশাপাশি, শনিবারের চিঠি-সহ একাধিক পত্রিকায় তখন তৈরি হচ্ছে বাংলা ব্যঙ্গের নতুন পরিসর, যার কারিগর বনবিহারী মুখোপাধ্যায়, পরিমল গোস্বামী, সজনীকান্ত দাস, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত সরকার, অজিতকৃষ্ণ বসু প্রমুখ। আবুল মনসুর আহমেদ, প্রমথনাথ বিশী, কুমারেশ ঘোষ, দীপ্তেন্দ্রনাথ সান্যাল, তারাপদ রায়, নবনীতা দেব সেন, হিমানীশ গোস্বামীরা রঙ্গব্যঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। আজও বহতা সে ধারা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali Literature comedy Bengali Writers

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।