Advertisement
E-Paper

জাতিভেদের রোগটা যায়নি

এ দেশে জাতের ভিত্তিতে পেশার প্রথা আজও বিদ্যমান। আর পেশার সঙ্গে জড়িত তাঁদের সামাজিক অবস্থান।

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৩৬
Share
Save

আমাদের দেশে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, মেয়েদের (এবং সব লিঙ্গের মানুষের) কাজের জগতে বঞ্চনার সঙ্গে তাঁদের জাতপাতের পরিচিতি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এ দেশে জাতের ভিত্তিতে পেশার প্রথা আজও বিদ্যমান। আর পেশার সঙ্গে জড়িত তাঁদের সামাজিক অবস্থান। সম্প্রতি কলকাতার এক মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষের মিশেল আবাসনে এক গাড়িচালক মেয়েকে ‘বাবু’দের লিফ্‌ট ব্যবহার করতে বাধা দেওয়া হয়। সেই মেয়েটি আবাসনের যে বাড়িতে যাচ্ছিলেন, সেই বাড়ির মালিক যখন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন বলা হয়, ‘অকুপেশন’-এর ভিত্তিতে সেই আবাসনে ঠিক হয় যে কে কোন লিফ্‌ট ব্যবহারের অনুমতি পাবেন। এ ধরনের বৈষম্য আর বিরল নয় কলকাতায়। পাঁচিল-ঘেরা বহু আবাসনে এই ‘বাবু’ সংস্কৃতির খবর শোনা যায়। কোথাও লিফ্‌ট-এ বৈষম্য, কোথাও আবার আবাসনের গেটে ঢোকা-বেরোনোর সময়ে মেয়ে গার্হস্থ শ্রমিকদের এবং অন্য শ্রমজীবী মানুষদের শারীরিক তল্লাশি নেওয়া হয়। যেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক মাত্রেই চোর! যে দেশে রাষ্ট্রের মাথারা শিল্পপতিকে চুরি করে দেশ ছেড়ে পালানোর পথ করে দেন, রাজনৈতিক নেতাদের পুকুর চুরি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, সে দেশে চুরির দায় সর্বদা গরিবের ঘাড়ে দেওয়া ব্রাহ্মণ্যবাদী বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমাদের দেশে কর্মিবাহিনীতে মেয়েদের অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনাও চলছে। অথচ প্রতিকারের পথে জাতপাত, শ্রেণি, ধর্ম ও লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদকে এক সঙ্গে দূর করার চেষ্টা খুব কমই দেখা যায়। ফলে প্রান্তিক গোষ্ঠীর মেয়েদের, শ্রমবাহিনীতে অংশগ্রহণে বৃদ্ধির গতি ধীর। বাৎসরিক ‘দ্য পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’ (পিএলএফএস)-র জুলাই ২০২৩ থেকে জুন ২০২৪ রিপোর্ট অনুসারে ২০১৭-১৮’তে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব মেয়েদের শ্রমবাহিনীতে অংশগ্রহণ ছিল ২৩% এবং ২০২৩-২৪’এ এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১.৭%-এ। মেয়েদের কর্মিবাহিনীতে অংশগ্রহণের এই বৃদ্ধিকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতিফলন হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। যে মেয়েরা পারিবারিক ক্ষুদ্র ব্যবসা, চাষের কাজে শ্রম দেন, এই সমীক্ষা তাঁদের কর্মী হিসাবে নথিভুক্ত করেছে, কিন্তু পারিবারিক অর্থকরী কাজ করলে মেয়েরা যে কোনও টাকা উপার্জন করেন না, সে বিষয়ে আলোকপাত করেনি। উল্লেখযোগ্য যে, এই সংখ্যাবৃদ্ধি মূলত গ্রামাঞ্চলেই ঘটেছে। গ্রামে ২৪.৬% থেকে ৪৮% এবং শহরে ২০.৪% থেকে ২৮%— মেয়েদের কর্মিবাহিনীতে অংশগ্রহণ বেড়েছে এই সময়কালে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, এই মেয়েদের অধিকাংশই (৮১.৮%) অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। আর অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় ৭০% আসেন প্রান্তিক গোষ্ঠী থেকে এবং ৩২.৫% মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত।

তার মানে আমাদের দেশের উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের কাজ প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষের, বিশেষ ভাবে মেয়েদের উপর প্রভূত ভাবে নির্ভরশীল। অথচ তাঁরাই ‘অকুপেশন’ অর্থাৎ পেশার ভিত্তিতে কর্মক্ষেত্রে নানা বৈষম্যের মুখোমুখি হন। যে বাবুবিবিরা পেশার ভিত্তিতে গার্হস্থ শ্রমিকদের, পরিষেবা কর্মীদের অথবা গিগ শ্রমিকদের জন্য আলাদা লিফ্‌ট-এর অথবা আলাদা শৌচালয়ের ব্যবস্থা করেন, অপমানজনক ভাবে আবাসনে ঢোকা-বেরোনোর সময় তল্লাশি নেন, তাঁরা বোধ হয় ভুলে যান যে এক দিন যদি এঁরা পরিষেবা বন্ধ রাখেন, তা হলে তাঁদের সংসার এবং সারা দেশ অচল হয়ে পড়বে। আসলে প্রান্তিক মানুষের শ্রম সস্তায় কেনা যায়, কিন্তু তাঁদের কর্মীর মর্যাদা দিতে বড় আপত্তি বাবু সম্প্রদায়ের! কী নিলাজ দ্বিচারিতা!

অথচ গার্হস্থ শ্রমিকরা, আয়ারা বাড়ির ভিতর রান্না থেকে শুরু করে শিশু অথবা অসুস্থ মানুষের সেবা করেন, আমাদের ঘরদোর পরিষ্কার রাখেন, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, আজও তাঁরাই আমাদের স্নানঘর পরিষ্কার করেন, যা কোনও ভাবেই কাম্য নয়, কিন্তু তাঁদের লিফ্‌ট অথবা শৌচালয় ব্যবহার করতে দিলেই বাবুসমাজ ‘পরিচ্ছন্নতা’ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে! অপরিচ্ছন্নতার দোহাই দিয়ে যাঁদের ছোঁয়া আমরা লিফ্‌ট-এ এড়িয়ে যেতে চাই, তাঁরাই কিন্তু আমাদের সংসারে পরিচ্ছন্নতার কান্ডারি!

একটা কথা এখানে সরাসরি বলা প্রয়োজন। ‘পরিচ্ছন্নতা’ এবং তৎসংলগ্ন ‘সুস্বাস্থ্য’-এর ধারণাটি আমাদের দেশে কিন্তু বর্ণবিদ্বেষের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। আসলে এই সব উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত, ‘উঁচু’ জাতের বাবুদের নিজেদের বর্ণবিদ্বেষী বলে স্বীকার করতে মানে লাগে। তাই তাঁরা পরিচ্ছন্নতার গল্প ফাঁদেন। এবং পেশার সঙ্গে অনায়াসে ‘পরিচ্ছন্নতা’-কে জুড়ে দেন। গাড়িচালক অথবা গার্হস্থ শ্রমিক নোংরা, কিন্তু সরকার অথবা কর্পোরেটে উচ্চপদস্থ কর্মী, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এঁরা সবাই খুব ‘পরিষ্কার’ এবং এঁদের কোনও ছোঁয়াচে রোগ নেই! কারণ, তাঁরা বিলাসবহুল আবাসনের বাড়ির মালিক, তাঁরা উচ্চবর্ণের! কী অকপট বৈষম্য!

প্রসঙ্গত, ভারতের সংবিধান-প্রণেতা ভীমরাও রামজি আম্বেডকরের সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে— জাতিভেদ প্রথা শুধুই শ্রমের বিভাজন নয়, এই প্রথা শ্রমিকেরও ভেদাভেদের ভিত্তি। যখন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের, যাঁদের অধিকাংশই প্রান্তিক গোষ্ঠীর, তাঁদের বড়লোকদের আবাসনে স্থানবিশেষে অস্পৃশ্য করে রাখা হয়, তখন তাকে বর্ণবৈষম্যই বলে। চিন্তার কথা হল, আমাদের দেশে জাতপাত, ধর্ম ও লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদ ব্যক্তিগত স্তরে সীমিত নয়, এটি একটি কাঠামোগত বৈষম্য এবং এই বৈষম্য দেশের সংবিধান প্রণয়নের ৭৬ বছর পরও কটু ভাবে দৃশ্যমান।

অথচ ভারতীয় সংবিধানের ১৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, জাতপাতের ভিত্তিতে অস্পৃশ্যতা এবং ১৫ নম্বর ধারা অনুসারে ধর্ম, জাত, বর্ণ, লিঙ্গ এবং জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু কে তার পরোয়া করে? বিশেষত, আইন প্রয়োগ যখন বাবু সম্প্রদায়েরই হাতে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Caste Employees

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}