—প্রতীকী ছবি।
সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতার এক বৈদ্যুতিন মাধ্যমের টিভি সঞ্চালিকার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে, তাঁর অজানতে, তাঁরই আধার নম্বর ব্যবহার করে বেশ কিছু টাকা তোলার খবর পাওয়া গিয়েছে। তিনি নিজেই বিষয়টি নিয়ে ব্যাঙ্কের আধিকারিক থেকে শুরু করে কলকাতা পুলিশের সাইবার সেল-এ পর্যন্ত যোগাযোগ করেন। কিন্তু তাতেও খুব বেশি লাভ হয়নি। ওই টাকা আর হয়তো ফেরত পাওয়া যাবে না, কিন্তু ঘটনাটা যে-হেতু শহরের একটি নামী টিভি চ্যানেলের সঞ্চালিকার, তাই আধারের মাধ্যমে টাকা চুরির বিষয়টি পুনরায় চর্চায় ফিরেছে।
প্রথমে জেনে নেওয়া দরকার, শুধুমাত্র আধার নম্বর দিয়ে কি টাকা তোলা সম্ভব? তুললেও, সেটা কি ব্যাঙ্ক থেকেই করা হয়? করলেও কী ভাবে? যে-হেতু গত কয়েক বছরে ব্যাঙ্কের শাখা ক্রমশ কমছে অথচ ব্যাঙ্কের পরিষেবা নেওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, তাই এই প্রয়োজন মেটাতে বেশ কিছু ‘কাস্টমার সার্ভিস পয়েন্ট’ (সিএসপি) খোলা হয়েছে। শুধু শহরে নয়, গ্রামেগঞ্জেও এই ছোট ছোট সিএসপি দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা দেওয়া যায় কোনও আধার ছাড়াই। তবে, যদি কোনও ব্যক্তি টাকা তুলতে চান, সে ক্ষেত্রে তাঁকে আধার নম্বর জমা করতে এবং আঙুলের ছাপ মেলাতে হবে। এই ব্যবস্থা আপাতদৃষ্টিতে সুরক্ষিত মনে হলেও তা যে একেবারেই নয়, তারই উদাহরণ ওই সঞ্চালিকার টাকা চুরি। উনি নাহয় ওঁর ক্ষমতার ফলে ব্যাঙ্কের আধিকারিক বা পুলিশের উপরমহল পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন। কিন্তু কত জন তা পারেন?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘আপাত’ সুরক্ষিত ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে টাকা তোলা হচ্ছে এবং এর থেকে বাঁচার উপায়ই বা কী? যদি কেউ কোনও নতুন মোবাইল সংযোগ নিতে যান, বা রেশন দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তুলতে যান, তা হলে তাঁকে আঙুলের ছাপ জমা দিতে হয় ‘পার্চেস অন সেল’ বা পিওএস মেশিনে। জমি বাড়ি নিবদ্ধীকরণের সময়েও ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়কেই তাঁদের দু’হাতের আঙুলের ছাপ দিতে হয়। সেই হাতের ছাপই অতি সহজে এই ধরনের পিওএস মেশিন থেকে নকল করা যায়। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের কানপুরে এই ধরনের একটি চক্রের হদিস পাওয়া গিয়েছিল, যারা আঙুলের ছাপ এবং চোখের মণি নকল করে রেশন দোকানের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। বিভিন্ন সংবাদপত্রে যখন এই সংক্রান্ত খবর করা হয়, তখন চিরাচরিত ভাবেই আধার কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, যখন সমস্ত ক্ষেত্রে আধার বাধ্যতামূলক হয়নি, তখন কিন্তু এই ধরনের আঙুলের ছাপ দিতে হত না। সেই সময়ে কি তবে জমি, বাড়ি কেনাবেচা হয়নি? না কি মানুষজন ব্যাঙ্কের লেনদেন করতেন না? তখন তা হলে এই কাজগুলি সম্পন্ন হত কী প্রক্রিয়ায়? আসলে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তি-নির্ভরতা যত বেড়েছে, তত মানুষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। যে মানুষটিকে এক সময় ব্যাঙ্কের আধিকারিক কিংবা রেশন দোকানের মালিক চিনতে পারতেন, তাঁকেই আধার নম্বর এবং হাতের ছাপ বা চোখের মণি না মিললে চিনতে পারছে না প্রযুক্তি। তা হলে সেই উপভোক্তাকে কি বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে হবে?
এ ক্ষেত্রে অনেকে বলতে পারেন, আগের ব্যবস্থাপনায় প্রচুর দুর্নীতি হচ্ছিল। সেই দুর্নীতি কি বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল না? কিন্তু সেই দুর্নীতি রুখতে গিয়ে এমন প্রযুক্তি আনা হল যে, কোনও ব্যক্তি রেশনে তাঁর প্রাপ্য জিনিস না পেলে বা নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা চুরি গেলেও, কোথাও অভিযোগ পর্যন্ত জানাতে পারবেন না। এতে পরোক্ষে দুর্নীতিকেই মান্যতা দিয়ে দেওয়া হল না কি? অনেকে এখন নিদান দিচ্ছেন যে প্রত্যেকে তাঁর নিজস্ব বায়োমেট্রিক তথ্য যদি লক করে রাখেন, তা হলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতেও কি সমাধান মিলবে? আমরা নানা ক্ষেত্রে যে ভাবে আধার এবং মোবাইল নম্বর দিতে বাধ্য হই, সেখানে যদি কারও ডেমোগ্রাফিক তথ্য আধার আপডেটের নাম করে বদলে অন্য বায়োমেট্রিক তথ্য যুক্ত করা হয়, তা হলেই তো নতুন একটি দুর্নীতির সম্ভাবনা খুলে যায়। মানুষেরই সরকারকে প্রশ্ন করার দরকার ছিল, যদি আধারকে তাদের তরফ থেকে একটি অভিনব পরিচয়পত্র বলা হয়, তা হলে কী করে তা নকল করা যাচ্ছে? সময়ে সে প্রশ্ন আমরা করিনি। বরং, সরকারের কথা মেনে সব কিছুর সঙ্গে আধারকে যুক্ত করেছি। এবং অদ্ভুত ভাবে, সরকারও সব দুর্নীতি রোধে আধারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
দুঃখের বিষয়, সরকারের উপরে ভরসা করে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় দুর্ভোগের মোকাবিলা করতে হচ্ছে জনসাধারণকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy