কায়ক্লিষ্ট: ১৯৭৭-এর পর এ বারই সবচেয়ে ভয়াবহ খরা হয়েছে ক্যালিফর্নিয়ায়। প্রায় শুকিয়ে যেতে বসেছে প্রদেশের বৃহত্তম হ্রদ সালটন সি। রয়টার্স ।
দাবানল, অতিবৃষ্টি, বন্যায় যখন পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ বিধ্বস্ত, তখনই আর একটা খারাপ খবর এল। জানা গেল, যা হিসেব করা গিয়েছিল, তার চেয়েও অনেক দ্রুত গরম হয়ে উঠছে পৃথিবী, এবং চলতি দশক শেষ হওয়ার আগেই তা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বিপদসীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তঃসরকার সংগঠন ‘আইপিসিসি’-র সাম্প্রতিক রিপোর্টে বিপর্যয়ের আঁচ দেওয়া হয়েছে। তিন হাজার পৃষ্ঠারও বেশি দীর্ঘ এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন ২৩৪ জন বিজ্ঞানী। তাঁরা দেখিয়েছেন, ক্রমশ দ্রুততর হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, যার ফলে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয়ের ঘটনা বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে একই সঙ্গে ঘটে গিয়েছে দাবানল, খরা ও তাপপ্রবাহ। এবং, এই ধরনের ঘটনা এখন বাড়তে থাকবে বলেই অনুমান। মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন যত বাড়বে, তত বৃদ্ধি পাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, গলে যাবে মেরু অঞ্চলে বরফের আবরণ, আর বেড়ে চলবে তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা ও ঝড়ের মতো আবহাওয়ার চরম আচরণ। রিপোর্ট জানাচ্ছে, যে ধরনের তাপপ্রবাহ অর্ধশতকে এক বার হত, তা এখন প্রতি দশকেই দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের তাপমাত্রা আর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই এমন ঘটনা প্রতি সাত বছরে দু’বারও ঘটতে পারে। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রমের (ইউএনইপি) কার্যনির্বাহী অধিকর্তা ইঙ্গার অ্যান্ডারসন আক্ষেপ করে বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তন এখন ঘোর বাস্তব। কেউই নিরাপদ নন। এত বছর ধরে সতর্কতার পরেও কেউ কথা শোনেননি। এ বার নড়েচড়ে বসতেই হবে।” বিশ্ব জুড়েই বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী শোনা যাচ্ছে। আগামী জলবায়ু সম্মেলন ২৬তম কনফারেন্স অব পার্টিজ় বা ‘সিওপি ২৬’-এর সভাপতি অলোক শর্মা রিপোর্ট প্রসঙ্গে বলেছেন, “জলবায়ুর ড্যাশবোর্ডে লাল আলো জ্বলে গিয়েছে।... এখানে বিজ্ঞানটা স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সারা পৃথিবীতেই দেখা যাচ্ছে। এখনও উদ্যোগী না হলে ফল হবে মারাত্মক। ভয়ানক ক্ষতি হবে জীবন, জীবিকা ও জীবজগতের।”
সভ্যতার উপরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে এখনও তেমন আলোচনা হয় না। এই প্রভাব পৃথিবীর সব অংশ বা সব দেশের উপর একই রকম হবে না। কিছু অঞ্চল এবং দেশের বিপদ বেশি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়লে নিচু এলাকা তো অংশত বা সম্পূর্ণ প্লাবিত হবেই, অন্য বহু এলাকাও ছাড় পাবে না। আইপিসিসি-র পর্যবেক্ষণ হল, ১৯৫০ থেকে পৃথিবীতে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু সমান ভাবে নয়। কিছু অঞ্চল বেশি আর্দ্র হয়ে উঠেছে, কিছু শুষ্কতর। বস্তুত, কিছু দেশ অন্যদের চেয়ে বেশিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং, এর ফলে পৃথিবী জুড়েই ভূ-রাজনীতির হিসেব অনেকখানি পাল্টে যাবে। যেমন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চিনকে একেবারেই সুরক্ষিত বলা যায় না। গতিপথ পাল্টে এবং বড় বাঁধ দিয়ে তারা যে ভাবে নদীকে নিজের মতো করে গড়েপিটে নিয়েছে, তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। খরস্রোতা ইয়াংৎসে নদীর উপর বিখ্যাত থ্রি গর্জেস ড্যাম এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই বাঁধগুলো এখনও পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম, এতে বিপুল পরিমাণ জল ধরা থাকে। হিসেব-বহির্ভূত অতিবৃষ্টি তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। গত মাসেই এক মহাপ্লাবনে থ্রি গর্জেস ড্যামের কাঠামো নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, ভেসে গিয়েছিল হেনান প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। রিপোর্টের অন্যতম প্রণেতা নানচিং ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়াং ওয়েন সতর্ক করেছেন— “জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে প্রবল বন্যা এবং খরা চিনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।”
আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনার সঙ্গে সভ্যতার অবস্থার একটা সরাসরি যোগ আছে। বিজ্ঞানীরা এখন জানেন যে, ১১ হাজার বছর ধরে সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সুস্থিত ও অনুমানযোগ্য আবহাওয়া পরিস্থিতির সম্পর্ক আছে। আবহাওয়া বিষয়টা যত বাঁধাধরা হিসেবের মধ্যে এসেছে, মানবজাতি ততই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পেরেছে। তারা মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে কৃষিব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে, নির্ভরতা দিতে পেরেছে বৃহৎ সংখ্যক গোষ্ঠীকে। আবার, আবহাওয়ার আচমকা বদলের ফলে বহু সভ্যতার পতন ঘটেছে, সেগুলি সময়ের সঙ্গে মুছেও গিয়েছে। এই ধরনের বিপর্যয় যদিও বিরল, বিচ্ছিন্ন। ৯০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাদের দর্শনীয় নগরগুলি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতার মানুষেরা। এ সময় সেখানে প্রবল ও দীর্ঘকালীন খরা দেখা দিয়েছিল। আজ বহু মায়ান এই পৃথিবীতে বাস করলেও তাঁদের প্রাচীন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই। সেই সাম্রাজ্য কিন্তু টিকেছিল ৩,০০০ বছর। এখনকার কাম্বোডিয়ায় অবস্থিত আঙ্কোর ভাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সভ্যতার দশাও হয় ঠিক তেমনই। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক প্রবল খরা-পর্বের পরে ক্রমশ ভেঙে পড়ে এই সভ্যতা। একই কাহিনি পাওয়া যাবে প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, মহেঞ্জোদরো-সহ পৃথিবীর অন্যান্য অংশেও। এমন নয় যে, মানবসভ্যতা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চায় না। আসলে, অনেক সময়েই তাদের চেষ্টাটা ঠিকঠাক হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই পাকাপাকি আবহাওয়া বদলের প্রভাব সামলানোর জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল উদ্যোগ হয়ে ওঠে না।
আজও নানা কারণে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে সব রাষ্ট্র সমান ভাবে সহায়তা করছে না। অ্যান্ডারসন জানিয়েছেন, আসন্ন ‘সিওপি ২৬’-এর আগে ‘ইউনাইটেড নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর (ইউএনএফসিসিসি) সদস্য ১৯১টি দেশের মধ্যে মাত্র ১১০টি দেশ নতুন বা যথাযথ ভাবে গোছানো ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইনড কন্ট্রিবিউশনস’ (এনডিসি) জমা দিয়েছে। তাঁর কথায়, “আগের ভুল সারিয়ে আর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু এই প্রজন্মের রাজনীতি ও বাণিজ্যের নেতৃস্থানীয় এবং সচেতন নাগরিকেরা ঠিক কাজটা তো করতেই পারেন।” নাসার চিত্র ব্যবহার করে পশ্চিম এশিয়ায় হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা খুঁজে বার করছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ জেসন উর। তিনি বলছেন, “আমরা যখন প্রাচীন সভ্যতার অবশেষ খুঁড়ে বার করি, প্রায় কখনওই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কোনও প্রমাণ দেখতে পাই না। এই অনমনীয় মনোভাবই পতনের মূল কারণ বলে মনে হয়।” ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া কেমন হবে, তার এক রকমের অনিবার্যতা আছে। মানবজাতি সামগ্রিক ভাবে বদলের ব্যাপারে একেবারেই স্বচ্ছন্দ নয়। কয়েকশো কোটি মানুষের যৌথ গতিপথ পাল্টে দেওয়াও কঠিন কাজ— প্রায় অসম্ভব। পরিচিত পরিসরে থাকতে, চেনা কাজ করতেই মানুষ ভালবাসে।
এমনকি, যে ভয়াল অতিমারি বিশ্ব জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তা-ও মানুষের আচরণে কোনও মৌলিক বদল আনতে পারেনি। জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপারটা দুর্বোধ্য, খুব তাড়াতাড়ি তার ফলাফলও দেখা যায় না। এই সব ঘটনা কেবল শিক্ষিত ও পরিবেশ-সচেতন মানুষকেই উদ্বেল করে। জনসাধারণ চিন্তিত নন, যদি না তাঁর নিজের বাড়িতে আঘাত আসে। যেমন— এ বছরের দাবানল, প্রবল গ্রীষ্ম, বন্যা ও অভূতপূর্ব বৃষ্টি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যাঁরা এতটুকুও ভাবিত ছিলেন না, এই প্রথম বার তাঁরা একটু একটু জানার চেষ্টা করছেন। আইপিসিসি-র প্রণেতারা দেখাচ্ছেন যে, সমস্ত রাষ্ট্র এক সঙ্গে হাত মেলালে আসন্ন বিপর্যয় রুখে দেওয়া যেতেও পারে। কিন্তু পৃথিবী কি পাল্টাবে? মানুষ কি তার ভোগ কমিয়ে সংরক্ষণ বাড়াবে? তারা কি প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকার চেষ্টা করবে? সম্ভবত না। সহজ-সরল জীবনযাপনে কেউই রাজি হবে না। প্রগতির ধারণাই হল ক্রমবর্ধমান ঐশ্বর্য— আরও বেশি ভোজন-ভ্রমণ-পরিধান-অর্থব্যয়। প্রাণিজাত প্রোটিন, ভ্রমণ, বিলাস ও ভোগের চাহিদা বজায় রাখতে আরও আরও শক্তি খরচ করবে মানুষ। কোনও রাজনীতিবিদ তাঁর ভোটারদের ভোগবিলাস কাটিয়ে নির্লোভ জীবনযাপনের কথা বলবেন না। তা হবে রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। বরং, আগের পথেই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হবে, দেখানো হবে বস্তুগত চাহিদা পূরণের স্বপ্ন।
সুতরাং পৃথিবী গরম হবে, আবহাওয়া হবে চরম, ডাঙার ভাগ কমবে। অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী আরও জনবহুল হয়ে উঠবে। তা আরও উষ্ণ হবে, সম্ভবত আরও হিংস্রও। এই নিউ নর্ম্যালে স্বাগত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy