Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪
Election Campaigns

ভোট-কৌশলের ভিত্তি হল ভয়

আর ঠিক এইখানেই সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির তুলনায় এগিয়ে গিয়েছে বহু গুণ। ভোট প্রস্তুতির বিষয়টিকে গোটা দেশে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তারা।

দিব্যেন্দু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:২৯
Share: Save:

এক ভোটের ফল প্রকাশের পরের দিন থেকে পরবর্তী ভোটের প্রস্তুতি। এ রাজ্যে সিপিএমের সাড়ে তিন দশকের একটানা রাজ্যপাট চালানোর ‘চাবিকাঠি’ বলতে এক সময় এই অঙ্কটাকেই বোঝানো হত। ক্ষমতা হারানোর পরে সিপিএমের সেই অঙ্কের অভ্যাস প্রায় উবে গিয়েছে।

আর ঠিক এইখানেই সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি তার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলির তুলনায় এগিয়ে গিয়েছে বহু গুণ। ভোট প্রস্তুতির বিষয়টিকে গোটা দেশে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তারা। এমনিতেই কেন্দ্রে টানা দশ বছর ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে। অভাব নেই টাকারও। আর আছে সঙ্ঘের কৌশল। তাই এ বার লোকসভা ভোটে ধাক্কা খেলেও পরের চার মাসের মধ্যে কৌশলে ভর করে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে তারা। হরিয়ানায় হারা ম্যাচ জেতা তারই ফসল।

সব রাজ্যেরই আছে আলাদা সমস্যা, দাবি-দাওয়া। ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, রুচিপছন্দ এমনকি ধর্মাচরণেও বৈচিত্র বিপুল। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসা ইস্তক সঙ্ঘ-বিজেপি অতি-কৌশলে এই পুরো বিষয়টিই গুলিয়ে দিয়েছে। সব কিছুর সঙ্গে হিন্দু ধর্মকে জুড়ে এক বিপুল জগাখিচুড়ি পাকিয়ে সব বিষয়কেই এক ছাতার তলায় এনে ফেলেছে। ‘উগ্র হিন্দুত্ববাদ’ নামক সেই ছাতার ভিত্তি হল ভয়, যে ভয়ের ধর্মীয়-রাজনৈতিক স্লোগান, ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান-বিরোধিতার মতো বিষয়। মশলাদার এই খিচুড়ির সামনে এ দেশের বিপুল বৈচিত্রময় ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসের মতো বিষয় তো বটেই, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের বিগত ভোটের মূল বিষয় ‘রোটি-কাপড়া-মকান’-ও ধামাচাপা পড়ে যায়।

এই মাসে ঘটছে দু’-দুটো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ড। দুই রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। খনিসমৃদ্ধ এবং জনজাতি অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ড দেশের দরিদ্রতম রাজ্যগুলির তালিকায় উপরের সারিতে। সেখানে জেএমএম-কংগ্রেস-আরজেডিকে নিয়ে গড়া শাসক জোট বিজেপি-বিরোধী। অন্য দিকে মহারাষ্ট্র— কৃষির পাশাপাশি শিল্পে ভর করে দেশের ধনী রাজ্যগুলির তালিকায়। বিজেপির জোট সরকারে রয়েছে গত আড়াই বছর ধরে। হরিয়ানা জয়ের পরে দুই রাজ্যেই হিন্দুত্বকে অস্ত্র করে ঝাঁপিয়েছে বিজেপি, তবে তার প্রয়োগ ভিন্ন।

জঙ্গল-খনি সমৃদ্ধ এবং জনজাতি অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডে এ বছর জানুয়ারিতে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে যে ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থা গ্রেফতার করেছিল, তা ভাল ভাবে নেননি রাজ্যের বহু মানুষ। হেমন্ত-পত্নী কল্পনা সোরেন সেই বিষয়টাকে কাজে লাগিয়ে ভোটের ময়দানে প্রচার করে কিছুটা সুফলও কুড়িয়েছেন। হেমন্ত এখন জামিনে মুক্ত। নিজের জেলযাত্রার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন জনজাতি আবেগ। এই অবস্থায় এ রাজ্যে বিজেপি অনুপ্রবেশকারী বা ‘ঘুসপেটিয়া’-কে অস্ত্র করে ভোট চাইতে ময়দানে নেমেছে। ‘অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয়দের রুটির পাশাপাশি বেটিও কেড়ে নিচ্ছে’ বলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সুর চড়িয়েছেন। লক্ষ্য— জনজাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যদের বিরোধ বাধিয়ে দেওয়া। ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘রুটি-বেটি চুরি’র মতো শব্দবন্ধ ঝাড়খণ্ডের মতো দরিদ্র রাজ্যে ভয়ঙ্কর হতে পারে। সে রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিরা বিপন্ন হতে পারেন। এমনিতেই ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় গোমাংস পাচারকারী সন্দেহে মুসলিমদের পিটিয়ে মারা হয়েছে গত দশকে অনেক বার। কিন্তু ভোটে জেতাই তো লক্ষ্য, পরে কী হবে, সে ভাবনা তাঁরা ভাবেন না।

বিপরীতে দেশের অন্যতম দরিদ্র রাজ্যের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার উন্নতি বা জনজাতি গোষ্ঠীর মূল মন্ত্র ‘জল-জঙ্গল-জমিন’ নিয়ে একটি কথাও বলেননি মোদী-শাহ’সহ বিজেপির নেতারা। শিক্ষা-স্বাস্থ্য বা কর্মসংস্থানের প্রসঙ্গও এড়িয়ে যাচ্ছেন। রাজ্যের খনির সিংহভাগই তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। জঙ্গল দ্রুত সাফ হচ্ছে ‘উন্নয়ন’-এর দাপটে। ভোট ময়দানে এ নিয়ে নাড়াচাড়া হলে বিপদ হবে বুঝেই ধর্মের জুজু দেখানোর কৌশল। প্রসঙ্গত, রাজ্যের ২৬ শতাংশ জনজাতি সম্প্রদায়ের ধর্ম (মূলত সারনা ধর্ম)-কে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় আনার কাজটা কয়েক দশক ধরে নীরবে করে গেছে সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠনগুলি।

মহারাষ্ট্রে আবার সঙ্ঘ-বিজেপির অন্য কৌশল। ২০২২ সালে প্রথমে শিবসেনাকে ভাঙিয়ে উদ্ধব ঠাকরের এমভিএ সরকার ফেলে দিয়ে বিজেপি ও বিক্ষুব্ধ শিবসেনার জোট নিজেদের সরকার গড়ে। পরে শরদ পওয়ারের এনসিপি-কে ভাঙিয়ে সেই জোটে এনে অঙ্কের হিসাবে সরকারকে মজবুত করেছে তারা। কিন্তু বিজেপি ও তার সঙ্গীদের এই কাজকে মরাঠাবাসী ভাল ভাবে নেননি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজ্য থেকে প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ কোটির বিনিয়োগ মোদী-শাহের গুজরাতে সরে যাওয়ার ক্ষোভ। বিষয়টিকে নিয়ে মরাঠা আবেগ উস্কে দিতে ছাড়ছেন না উদ্ধব ঠাকরেরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধারাভি বস্তির জমি মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতির হাতে তুলে দিতে গিয়ে নিয়ম ভাঙার অভিযোগ। লোকসভা ভোটের আগে রাহুল গান্ধীর পদযাত্রা, বিরোধী জোটে ঐক্যের ছবি, শিন্দে-অজিতদের ‘বেইমানি’ ছাপ ফেলেছিল ভোটারদের মধ্যে, ধাক্কা খেয়েছিল বিজেপি। সেই আবেগ এখন অনেকটাই স্তিমিত। পুরনো ছকে আবার ফিরেছে তারা। তা ছাড়া, লোকসভা ভোটের আগে সঙ্ঘ ও বিজেপির কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সেই বিভেদ ঘুচিয়ে এ বার এক সঙ্গে ঝাঁপিয়েছে দু’পক্ষই।

এত কিছু সত্ত্বেও, দু’রাজ্যেই লড়াই কঠিন। ঝাড়খণ্ডে যেমন ‘ঘুসপেটিয়া’র ভয় বনাম জনজাতি ও জল-জঙ্গল-জমিন আবেগ, মহারাষ্ট্রে তেমনই লড়াইটা হিন্দুত্ববাদ বনাম মরাঠা অস্মিতার।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Political Campaign Political parties
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy