Advertisement
E-Paper
BB_2025_Lead Zero Banner

অন্তঃসত্ত্বা যক্ষিণী থেকে গিঁটবাঁধা প্রেতাত্মা, অচেনা ভয়ের দেশ তৈরি করছে এশিয়ারই এক দ্বীপরাষ্ট্র

সে দেশে ইসলামি জগতের নিজস্ব রহস্যময়তার সমান্তরালে থেকে গিয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির রেশ আর জনজাতি-বৈশিষ্ট্যের জিন মানচিত্রে ছেয়ে থাকা আদিম ভয়ের উপাদান।

A journey through Indonesian horror movies

ভয়ের ভিন্ন ব্যাকরণ উঁকি দিচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার হরর সিনেমায়। ছবি: সংগৃহীত।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০০
Share
Save

আজ ভূত চতুর্দশী। এমন দিনে রসিক বঙ্গজন চৌদ্দ শাক দিয়ে ভাত খেয়ে ভরদুপ্পুর বেলা ভৌতিক ঢেলাতাড়িত হয়ে ঢুকে পড়তেই পারেন ‘তেনাদের’ রাজত্বে। অর্থাৎ, সুড়ুৎ করে প্রবেশ করতেই পারেন ‘হরর’ সিনেমার জগতে। হলিউড, বলিউড বা দক্ষিণী ফিলিমের ভয়ের চত্বর ভূতপ্রেমীদের অনেক দিনই চেনা হয়ে গিয়েছে। অচেনা ভয়ের সন্ধানে জাপানি বা কোরিয়ান হররের শরণাপন্ন হচ্ছেন এই প্রজন্মের ভূতান্বেষীরা। সে সব দেশের হরর ছবি বাজার কাঁপালেও এই মুহূর্তে যে দেশটি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে, তার নাম ইন্দোনেশিয়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রটি এই মুহূর্তে তার একান্ত নিজস্ব ভয়ের ব্যাকরণকে নতুন মাত্রায় মেলে ধরেছে।

হলিউডের দৌলতে খ্রিস্টধর্ম-শাসিত ভয়ের জগৎ বা আলো-আঁধারির গথিক গলিঘুঁজিতে অশরীরীদের স্যাঁৎ করে সরে যাওয়া ছায়া আর প্রেতাবিষ্ট নারী কিংবা শিশুর মণিহীন চোখ দেখতে দেখতে হরর-বিলাসীদের যখন অরুচি ধরে গিয়েছে, তখনই ‘এশিয়ান হরর’ বাজার দখল করে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইল্যান্ডের মতো দেশের সংস্কৃতির শিকড়েই যে সব ভয়ের উপাদান ছিল, সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে তারা পর্দায় এমন এক ভয়ের ভুবন গড়ে নেয়, যা হলিউডকেও বিচলিত করে। কিন্তু সেখানেও যখন এই বিশেষ ধারাটি কিছু নির্দিষ্ট ফর্মুলায় আটকে গেল, তখন অন্য এক দেশের হরর ছবিতে নতুন কিছুর খোঁজ মিলল।

দেশটির নাম ইন্দোনেশিয়া।

দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার অতীত হিন্দু-বৌদ্ধ এবং ইসলামি প্রভাবাচ্ছন্ন। দেশের সংস্কৃতির তলা দিয়ে ফল্গুধারায় বইছে জনজাতি অতীতের আচার-আচরণ-কিংবদন্তি। এমন এক পাঁচমিশেলি জটিলতায় সে দেশের ভয়ের ব্যাকরণও অন্য খাতে বইতে শুরু করে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার এই ব্যাকরণ যে ভাবে পর্দায় উঠে এল, তা বেশ চমকপ্রদ! দেশটির রাজনীতি বেশ বড় সময় ধরেই অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। দেশের আনাচকানাচে ধর্মীয় মৌলবাদেরও প্রসার হয়েছে। কিন্তু ইসলামি জগতের নিজস্ব রহস্যময়তার সমান্তরালে থেকে গিয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির রেশ আর জনজাতি-বৈশিষ্ট্যের জিন মানচিত্রে ছেয়ে থাকা আদিম ভয়ের উপাদান।

সম্প্রতি ‘হিদায়াহ্‌’ নামে একটি ছবি রসিকজনের নজর কেড়েছে। মন্টি তিওয়া পরিচালিত এই ছবির কেন্দ্রে রয়েছে ‘বাহরি’ নামে একটি চরিত্র। বাহরি কোনও রহস্যময় কারণে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে রয়েছে। একদিন হঠাৎই সে খবর পায়, গ্রামবাসীরা আতঙ্কের প্রহর কাটাচ্ছে। সেই ভয়ের কেন্দ্রে রয়েছে অতিপ্রাকৃত অশুভের কবলে-পড়া এক তরুণী। সেখান থেকেই যাবতীয় গন্ডগোলের সূত্রপাত বলে তাদের ধারণা। বাহরি গ্রামে ফিরে দেখতে পায়, মেয়েটি বিপুল যন্ত্রণা ভোগ করে মারা গেলেও গ্রামের উপর অমঙ্গলের ছায়া কিছুতেই দূর হচ্ছে না। একে একে বেশ কিছু মৃত্যু ঘটতেই থাকে। এর পর শুরু হয় অপশক্তির সঙ্গে বাহরির লড়াই।

‘হিদায়াহ্‌’র নির্মাণে যে জিনিসটি সর্বাগ্রে নজরে আসে, তা এর দেশজ চরিত্র। কোনও ভাবেই পশ্চিমি হরর সিনেমার বৈশিষ্ট্য এতে নেই। ‘এগজ়রসিজ়ম’ বা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পন্থাও একান্ত ভাবে সে দেশের মাটির। ‘হিদায়াহ্‌’ শব্দটি পবিত্র কোরান থেকেই নেওয়া। এর অর্থ ‘পথ প্রদর্শন’। অবশ্যই এর মধ্যে আদি ইসলামিক বিশ্বাস জুড়ে রয়েছে। কিন্তু তার উপর প্রলেপ পড়েছে ইন্দোনেশীয় সংস্কার ও আচারের।

২০২৩-এর ‘হিদায়াহ্‌’ থেকে যদি একটু পিছিয়ে যাওয়া যায়, ২০০৬ সালের ‘কুন্তিলানক’ বা ২০০৭-এর ‘আংকেরবাটু’ ছবিগুলিতে ভয় আসে প্রাচীন কোনও অপশক্তির সূত্র ধরে। অরণ্য ধ্বংস করে নাগরিক সংস্কৃতির প্রসারের সামনে বাধা হিসেবে দাঁড়ায় প্রাচীন কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তি, যাকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ বা তারাদাস বন্দ্যপাধ্যায়ের ‘অলাতচক্র’ পড়া বাঙালি পাঠকের আদৌ অচেনা বলে মনে হবে না।

প্রেত ছাড়াও অন্য যে উপাদানটি ইন্দোনেশিয়ার ভয়ের ছবির অনন্য চরিত্রকে তৈরি করে, সেটি সে দেশের কিংবদন্তি এবং জনশ্রুতির অন্তর্লীন জাদুবাস্তবতা। যেমন, ‘কুন্তিলানক’ আসলে অতিপ্রাকৃত নারীশক্তি, যার সঙ্গে যক্ষিণীদের তুলনা করা যায়। ইন্দোনেশিয়ার জনশ্রুতি, সে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী, যার সন্তান কখনওই ভূমিষ্ঠ হয় না। লক্ষণীয়, ইন্দোনেশীয় হরর ছবিতে বার বার দেখা গিয়েছে কুন্তিলানককে। প্রত্যক্ষ না হলেও ২০০৯-এর ছবি ‘দ্য ফরবিডন ডোর’-এ অন্য ভাবে ছায়া ফেলে কুন্তিলানকের মিথ। গোটা ছবি জুড়ে চোরাস্রোতে বইতে থাকে অজাত সন্তানের অরব উপস্থিতির মতো অস্বস্তিকর ব্যাপার। জাদুবাস্তবতা, ভয় আর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার মিশেলের এক পরত নীচেই এখানে থমকে রয়েছে রহস্যময় অতীত, যা এক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক শিকড়। এই অতীতের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা এক দিকে প্রতিহত করে পশ্চিমি ঔপনিবেশিকতাকে, অন্য দিকে জন্ম দেয় জাতিসত্তার আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের অগণিত সূত্রের।

 ‘নিছক ভূতের গল্প’ নয়, ইন্দোনেশিয়ার পরিচালকরা তার চাইতে কিছু বেশিই উপহার দিচ্ছেন তাঁদের হরর ছবিগুলিতে।

‘নিছক ভূতের গল্প’ নয়, ইন্দোনেশিয়ার পরিচালকরা তার চাইতে কিছু বেশিই উপহার দিচ্ছেন তাঁদের হরর ছবিগুলিতে। ছবি: সংগৃহীত।

জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকেই ইন্দোনেশিয়ায় হরর ছবি তোলা শুরু হলেও সুহার্তো জমানায় (১৯৬৬-১৯৯৮) সেন্সরশিপ ভয়ঙ্কর আকার নেওয়ায় এ ধরনের ছবি তোলা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর উদ্যোগ শুরু হয়। এবং এই পর্যায়েই নতুন করে শুরু হয় হরর ছবি তৈরি।

ইন্দোনেশীয় হরর ছবির পরিধিতে যাঁর নাম বার বার উঠে আসে, তিনি জোকো আনওয়ার। ‘দ্য ফরবিডন ডোর’ তাঁরই নির্মাণ। প্রথম জীবনে কিছু অন্য ধারার ছবি বানালেও পরে ভয়ের ছবিতেই তাঁর সিদ্ধিলাভ বলে জানান আলোচকেরা। ২০১৭-এ ‘স্যাটান্‌স স্লেভস’ ও ২০১৯-এ তার সিক্যুয়েল পরিচালনা করে হরর ছবির জগতে সাড়া ফেলেছেন জোকো। ইন্দোনেশিয়ায় শয়তান উপাসক এক গুপ্ত সম্প্রদায়ের কিছু অতিপ্রাকৃত কর্মকাণ্ড নিয়ে তৈরি এই ছবিতে যে শয়তান উপাসনাকে দেখানো হয়েছে, তা চরিত্রগত ভাবে খ্রিস্টীয় ‘স্যাটানিজ়ম’ নয়। তার শিকড় ইন্দোনেশিয়ার ইসলামি বিশ্বাসে।

২০০৬-এ ‘পোকং’ নামের একটি হরর ছবিকে ঘিরে ইন্দোনেশিয়ায় রীতিমতো তোলপাড় হয়। ১৯৯৮ সালের জাতিদাঙ্গার উপর আধারিত এই ছবিতে ইন্দোনেশীয় সংস্কৃতির চেনা ভূত পোকংকে নিয়ে আসা হয়। পোকং আদতে চাদরে গিঁট বেঁধে আটকে রাখা আত্মা। ‘পোকং’-এ এমন কিছু আপত্তিকর ব্যাপারস্যাপার ছিল যে, শেষমেশ এটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যুক্তি হিসেবে অবশ্য জাতিগত সংঘাতের বিষয়টিকেই দেখানো হয়। কিন্তু ‘পোকং’-এর প্রিক্যুয়েল এবং সিক্যুয়েল রমরমিয়ে ব্যবসা করে।

‘পোকং’-এর মূল ছবি নিষিদ্ধ হলেও তার সিক্যুয়েল কিন্তু দারুণ ব্যবসা করে।

‘পোকং’-এর মূল ছবি নিষিদ্ধ হলেও তার সিক্যুয়েল কিন্তু দারুণ ব্যবসা করে। ছবি: সংগৃহীত।

২০১৯-এ ‘ইম্পেটিগোর’ নামে জোকোর একটি ছবি মুক্তি পায়। এই ছবিতেও শয়তান উপাসনার বিষয়টি ছিল প্রধান। জোকো ছবির এক বড় অংশ জুড়ে রাখেন ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী ছায়াপুতুলের নাচ ‘ডালাং’কে। এ হেন শৈলীর প্রয়োগের কারণে এ ছবি আন্তর্জাতিক মহলেও নজর কাড়ে। ‘হরর’-এর তকমা পেরিয়ে ‘ইম্পেটিগোর’ আদায় করে নেয় অন্য সমীহ।

‘ইম্পেটিগোর’-এর ভিত্তি ছিল সে দেশের পরম্পরাগত সংস্কৃতি।

‘ইম্পেটিগোর’-এর ভিত্তি ছিল সে দেশের পরম্পরাগত সংস্কৃতি। ছবি: সংগৃহীত।

ভয়ের ভূগোলে কোথাও একটা তোলপাড় চলছে মনে হয়।হলিউড যেখানে এখনও ‘এগজ়রসিস্ট’ আর ‘অ্যানাবেল’-এর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না, সেখানে এশিয়ার এই দেশগুলিতে একের পর এক ভয়ের ছবি নির্মিত হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিসিমে। জোকো আনওয়ার বা মন্টি তিওয়ার মতো পরিচালকেরা উপনিবেশোত্তর এক পরিসরকে নিয়ে আসতে চাইছেন তাঁদের ছবিতে।এখানে ভয় একটা আঙিনা। যেখানে মানব জীবনের সব থেকে আদিম অনুভূতিকে ব্যবহার করেই সন্ধান চলে আত্মপরিচয়ের। ‘নিছক ভূতের গল্প’-এর চাইতে খানিক বেশিই দিতে চাইছেন এঁরা। ফলে বক্স অফিসের দিকে তাক করে তোলা ফর্মুলা-হররের চৌহদ্দি থেকে খেলা ঘুরছে। হয়তো জন্ম হচ্ছে নতুন ফিল্ম ভাষার, যা পশ্চিমের অঙ্গুলিনির্দেশের তোয়াক্কা রাখে না।

Horror Film Indonesian Horror Movies Joko Anwar Pococng Impetigore Hidayah Horror Movies

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।