বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি।/ আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে: পূর্ণেন্দু পত্রী।
আসবাবপত্রে ঘরের মানুষটিকে চেনা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যোগাযোগ উপন্যাসের কুমু অভিজাত, শালীন। আর নব্য ধনী মধুসূদন স্বভাবে, আসবাবের রুচিতে আলাদা। কুমুর আসবাবপত্র বেশি কিছু ছিল না। “ছোটো খাট, আলনায় গুটি-দুয়েক পাকানো শাড়ি আর চাঁপা-রঙের গামছা। কোণে কাঁঠাল-কাঠের সিন্দুক... দেয়ালের খাঁজের মধ্যে কাঠের থাকে কিছু বই, দোয়াতকলম,... দেয়ালের কোণে ঠেসানো একটা এসরাজ।”
মধুসূদনের বাইরের মহল, গৃহসজ্জা কেনা, সাজানোর ভার তার ইংরেজ অ্যাসিস্ট্যান্টের। সেখানে “মার্বলের মেজে, বিলিতি কার্পেট, দেয়ালে চিত্রিত কাগজ মারা এবং তাতে ঝুলছে নানারকমের ছবি,... হরিণকে তাড়া করেছে শিকারী কুকুর,... বিখ্যাত ঘোড়া... স্নানরত নগ্নদেহ নারী... দেয়ালে কোথাও বা চীনে বাসন, মোরাদাবাদি পিতলের থালা, জাপানি পাখা, তিব্বতি চামর ইত্যাদি যতপ্রকার অসংগত পদার্থের অস্থানে অযথা সমাবেশ।”
এক তলার ঘরগুলো স্যাঁতসেঁতে, ধোঁয়ায় ঝুলে কালো হলেও মধুসূদন কুমুকে তাক লাগাতে চেয়েছিল তেতলায় শোয়ার ঘরে। “মস্ত বড়ো খাট মেহগনি কাঠের; ফ্রেমে নেটের মশারি,... সিল্কের ঝালর।... পায়ের দিকে পুরো বহরের একটা নিরাবরণ মেয়ের ছবি, বুকের উপর দুই হাত চেপে লজ্জার ভান করছে। শিয়রের দিকে মধুসূদনের নিজের অয়েলপেন্টিং, তাতে তার কাশ্মীরি শালের কারুকার্যটাই সব চেয়ে প্রকাশমান।... আয়নার দু দিকে দুটো চীনেমাটির শামাদান, সামনে চীনেমাটির থলির উপর পাউডারের কৌটো, রুপো-বাঁধানো চিরুনি, তিন-চার রকমের এসেন্স, এসেন্স ছিটোবার পিচকারি এবং আরো নানা রকমের প্রসাধনের সামগ্রী”, ঘরটি যেন “ময়লা-কাঁথা-গায়ে-দেওয়া ভিখিরির মাথায় জরিজহরাত-দেওয়া পাগড়ি।”
অন্দরসজ্জা, আসবাবের বৈষম্য ভিন্ন মেরুর মানুষের অসুখী দাম্পত্যের অশনি সঙ্কেত দেয়। আবার শরৎকুমারী চৌধুরানীর শুভ বিবাহ-এ দেখি স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী পরিবারের অন্দরসজ্জা মেয়েদের রুচি, সুবিধা অনুযায়ী একটু হলেও পাল্টাচ্ছে। বসবার ঘরটি সাজানো নানা গঠনের চেয়ার, সোফা, ফুলদানি, ছবিতে। রয়েছে হারমোনিয়াম। সাহেবসুবোর মেয়েরা বৌমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাই “ঘর সাহেবি ধরনে সাজানো। বউমারা সবাই বেশ ইংরেজী কথা কইতে, গান বাজনা করতে জানেন।” একটি ছবি বড় বৌমার হাতের, বালিশ মেজো বৌমার করা, টি-পাই ঢাকা নাতনির হাতের। বৌদের স্বাধীন ঘরকন্নার সুযোগ দিতে আলাদা রান্নাঘর, জালের আলমারিতে তরিতরকারি, ফল, অ্যারারুট সব মজুত।
সরলা দেবী চৌধুরানীর জীবনের ঝরাপাতায় বইছে খোলা হাওয়া। ঘরের কেন্দ্রীয় চরিত্র খাট, জমে উঠেছে মেয়েদের আড্ডা। “ভিতরের দিকের সিঁড়ি উঠেই মায়ের শোবার ঘর। ...পালঙ্কের উপর যোড়াসাঁকো থেকে সমাগত মাসি, মামী ও দিদিদের প্রায় নিত্যই মধ্যাহ্ন থেকে গড়ান পার্টি জমত। ...পালঙ্ক সম্মিলনী দেখে আমার মনে মনে একটা ধারণা বসে গিয়েছিল পালঙ্কই হল প্রত্যেক মায়ের স্বাভাবিক বসবার জায়গা, মায়েরা কখনো মাটিতে বসে না। দাসীরা যখন তাদের দেশে তাদের মায়ের কথা বলত, আমি কল্পনার চক্ষে দেখতুম, মেমারি গ্রামে বা বঁইচিতে বা গুপ্তিপাড়ায় তাদের মায়েরাও এই রকম বৃহৎ পালঙ্কে পা ছড়িয়ে বসে আছে।”
খাট বা পালঙ্ক দেশভাগের বেদনা বুকে নিয়ে পড়ে থাকে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে।চোখের বালির বিনোদিনী নিজের ঘরে নয়, পরের ঘরেই শিল্পীসত্তা উজাড় করেছিল। কলেজ থেকে ফিরে নিজের ঘর দেখে অবাক মহেন্দ্র। মশারিতে গোলাপি রেশমের ঝালর, বিছানায় ঝকঝকে শুভ্র জাজিম, পুরনো তাকিয়ার বদলে বিলিতি চৌকো বালিশ। বালিশের মধ্যে তুলোর সঙ্গে নাগকেশর ফুলের রেণু আর আতর মেশানো। ঘরটিকে রাতের খাট আর সারাদিনের ব্যবহার্য অংশে ভাগ করা। পুরনো ইতিহাসের সব চিহ্ন মুছে দিয়েছে নতুন হাতের নতুন অন্দরসজ্জা।
সময় এগিয়েছে, আসবাব কেনার সিদ্ধান্ত না হোক, তাড়না এসেছে মেয়েদের থেকেই। ‘ডাইনিং টেবিল’, ‘ড্রেসিং টেবিল’, ‘ফ্রিজ’— রমাপদ চৌধুরীর গল্পগুলিতে মেয়েদের সুবিধের জন্যেই মধ্যবিত্ত সংসারে নতুন আসবাবের অনুপ্রবেশের শুরুটা। তার জন্যে নারীকে পণ্যলোভী প্রতিপন্ন হতে হয়েছে সংসারে, কিন্তু নতুন জিনিসটির সুফল পুরুষও ভোগ করেছেন। ‘মক্ষিরানী’ আপাত অনর্থক জিনিস কিনলেই বুদ্ধদেব বসু আপত্তি করেছেন, কিন্তু সেই জিনিসটিই এনেছে সূক্ষ্ম সুখ। নীল রঙের ছাইদানে লেখার টেবিল যেন হেসে উঠেছে।
অন্দরসজ্জার জিনিস, আসবাব কেনার ৯৪% ক্ষমতা নাকি মেয়েদের হাতে, কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা আসবাবশিল্পের সিংহভাগই পুরুষের দখলে। নারী পরিকল্পক, নকশাকার হাতে গোনা। তাই ‘ভোগ’ পত্রিকা যখন সামনে আনল অসাধারণ নারী নকশাকারদের নাম, একটি ‘আয়রনি’ও চোখে পড়ল। শতাব্দীর পর শতাব্দী যাঁদের করে রাখা হয়েছে গৃহের শোভা, শো পিস, তাঁরাই তৈরি করেছেন বোল চেয়ার, পন্ড মিরর, বায়োমর্ফিক ভাস্কর্য! অনেকেরই কাজ প্রকৃতিবান্ধব, উত্তর-আধুনিক। তালিকাটিতে বাংলার বিনোদিনীরা কি থাকতে পারতেন না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy