যখন দু’টি কোনও বিবদমান গোষ্ঠী বা পক্ষের মধ্যে বিদ্বেষ তুঙ্গে উঠে বিবাদ বাগ্বিতণ্ডা ছাড়িয়ে যুদ্ধের হুমকির দিকে এগোতে চায়, তখন শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষ অনেকেই সম্পর্কের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য সংলাপ বা কথোপকথনের— দ্বিপাক্ষিক ডায়ালগের— গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বলা বাহুল্য, আমিও সংলাপের পক্ষে। কিন্তু বিদ্বিষ্ট দু’টি পক্ষের মধ্যে সংলাপ নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হয়, সংলাপের সাফল্য বা সার্থকতার জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ হওয়া প্রয়োজন। আজ দুই বাংলার দিকে তাকিয়ে সেই শর্তগুলোর কথাই আবার মনে হচ্ছে। একে একে বলা যাক।
সংলাপের প্রাসঙ্গিকতা: ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, বা সাংস্কৃতিক কারণে যাকে এড়িয়ে চলা যায় না, তার সঙ্গে সংলাপ সব সময়েই প্রাসঙ্গিক। একটু বড় প্রেক্ষাপটে যেমন বলা যায়, গত চার-পাঁচশো বছরে পাশ্চাত্য এমনই একটি জোরালো ও আগ্রাসী সভ্যতা হয়ে উঠেছে যে পৃথিবীর যে-কোনও কোণে থাকা মানুষের জন্যই, তা তাঁদের ভাষা, ধর্ম, সভ্যতা যা-ই হোক, পাশ্চাত্যের সঙ্গে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংলাপ প্রায় অবশ্যম্ভাবী। অন্য দিকে, বলতেই পারি, ভারতীয় মানুষদের সঙ্গে গুয়াতেমালার অধিবাসীদের সংলাপ জমে উঠলে তা হবে মূলত কৌতূহল ও সদিচ্ছাপ্রণীত। আবার একই কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সংলাপ সব সময়েই প্রাসঙ্গিক।
সংলাপের ইচ্ছে: সম্প্রতি কলকাতা ও ঢাকায় অনেক বিদ্বেষ ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা শুনে আমার মা’র একটি ঢাকাইয়া উক্তি প্রায়ই মনে পড়ে। যে কলহ অনায়াসে এড়ানো যেত কিন্তু ইচ্ছের অভাবে যায়নি, তা দেখে মা বলতেন, “ধইরা বাইন্ধা কি আর প্রেম হয়?” বলা বাহুল্য, হয় না। সংলাপের জন্যও ইচ্ছে বা গরজ থাকা প্রয়োজন। যখন কেউ বলেন চার দিনের মধ্যে কলকাতা বা চট্টগ্রাম জিতে নেব, তাঁর সেই উক্তিকে সংলাপের আমন্ত্রণ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। মিথ্যে বা বিভ্রান্তিকর খবর— যেমন কলকাতায় বসে এক দিন শুনলাম ওপার বাংলায় কারও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে, আর পরের দিনই শুনলাম, না, তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়নি কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের নথিপত্রই তৈরি হয়নি এখনও— সংলাপী মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। তখন যেন মনে হয় সংলাপের নয়, সংগ্রামের ইচ্ছেটাই বুঝি প্রবল হয়ে উঠছে। যেমন প্রেমের ক্ষেত্রে, তেমনই সংলাপের ক্ষেত্রেও— ধরে বেঁধে সংলাপ হয় না। গরজ খুব দরকার।
সংলাপের ধরন: কার সঙ্গে কী ভাবে কথা বললে কথাটা অন্য পক্ষের কাছে পৌঁছবে, এই সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ অপরের সংস্কৃতি, ভদ্রতার, আচার-বিচার সম্বন্ধে একটু জানা না থাকলে চিন্তার আদানপ্রদান হয় না। ঠিক কথা ঠিক জায়গায় পৌঁছয় না। আমার ইতিহাস গবেষণার অভিজ্ঞতায় প্রাপ্ত দু’টি ভিন্ন উদাহরণ দিয়ে কথাটা বোঝাই। দু’টি উদাহরণই স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করছি, স্মৃতির ভুল হলে পাঠক মাপ করবেন। একটি উদাহরণ চিন্তার সফল আদান প্রদানের। প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ হোরেস হেম্যান উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০) সাহেবের কাগজপত্র ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে পড়তে গিয়ে তাঁকে লেখা রাধাকান্ত দেবের একটি চিঠি পাই। যত দূর মনে পড়ে ১৮৪০-এর দশকে লেখা চিঠি, ততদিনে উইলসন সাহেব বিলেতে ফিরে গেছেন। চিঠিটির শেষ লাইনটি পড়ে চমকে উঠি, রাধাকান্ত দেব জিজ্ঞেস করছেন, “হাউ ইজ় ইয়োর ওয়াইফ?” ভাবলাম, বাপ রে, ১৮৪০-এর দশকে কি কোনও বাঙালি ভদ্রলোক চিঠিতে অন্য এক জন বাঙালি পুরুষকে তাঁর অন্দরমহলবাসিনী গিন্নি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে পারতেন, “আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?” করলে হয়তো অন্য জন বাড়ি বয়ে এসে লাঠালাঠি করে যেতেন! বোঝা যায়, রাধাকান্ত দেব ইংরেজের ভদ্রতাবোধ বা আদবকায়দা জানতেন। জানতেন যে, যে-কথা এক জন বাঙালি পুরুষকে তখনও জিজ্ঞেস করা যায় না, তা সাহেবকে জিজ্ঞেস করা যায়। এরই ঠিক উল্টোটা দেখেছিলাম, কলকাতার ডাকসাইটে সাহেব ও বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের এক কর্ণধার বেন্থল সাহেবের কাগজপত্রে। ১৯৩০-এর অর্থনীতির মন্দার দিনগুলোতে বেহালার এক তরুণ যুবক, কী যেন ‘রায়’, তাঁকে ইংরেজিতে লিখছেন, “স্যর, আমি আপনার সঙ্গে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক পাতাতে চাই।” তার পরের লাইন, “পিতা, আপনার পুত্র বেকার। অবিলম্বে তার চাকরির ব্যবস্থা করুন দয়া করে।” সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম শেষ লাইনটি পড়ে, লাইনটি আমার স্মৃতিতে আজও হাসির উদ্রেক করে: “ফাদার, হাও ইজ় মাদার?” বলা নিষ্প্রয়োজন যে বেন্থল সাহেবের কাগজপত্রে এই চিঠির উনি আদৌ কোনও উত্তর দিয়েছিলেন কি না, তার কোনও হদিস নেই। এ ক্ষেত্রে বলাই যায় যে, রায়মশাই ইংরেজি জানলেও আলাপের ‘তরিকা’ বা ধরন জানতেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তাঁর কাঙ্ক্ষিত পিতা-পুত্র সম্বাদও মোটেই জমেনি!
সংলাপের ভিত্তি আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। অপরের আস্থাভাজন না হতে পারলে সংলাপ এগোয় না। আস্থা অর্জন করতে হয়, এবং একটি বিদ্বেষ ও সন্দেহের বিষে বিষায়িত অবস্থায়, আস্থা অর্জন করা খুব শক্ত। আমি যদি আমার সঙ্গে সংলাপেচ্ছু ব্যক্তিটিকে মতলবি মনে করি বা তাঁর ইচ্ছের পিছনে কোনও অবাঞ্ছিত বা চতুর উদ্দেশ্য দেখতে পাই তা হলেও সংলাপ মার খাবে। অর্থাৎ, আস্থা অর্জন করা, বিশ্বাসভাজন হওয়া, এগুলো একটা প্রক্রিয়া, এবং প্রক্রিয়াটি যে সফল হবেই তার কোনও গ্যারান্টি নেই। বৈরি অবস্থার মধ্যেও যিনি সংলাপেচ্ছু, তাঁকে ধরেই নিতে হবে সংলাপের মধ্যে যে কোনও সময় ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কাটি থেকেই যাবে। সংলাপ শুরু করা মানেই এই ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি নেওয়া। এই ঝুঁকি নিতে না পারলে সংলাপ হয় না। সংলাপ কোনও নিরাপদ প্রক্রিয়া নয়।
সংলাপে প্রয়োজন খোলা মন ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা। মন খোলা রাখা কথাটি শুনতে সহজ কিন্তু বাস্তবে খুবই শক্ত। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের একটি উক্তি মনে পড়ে। স্মৃতি থেকে উদ্ধার করছি, কিছু ভুল হলে মার্জনা চেয়ে রাখি। হাইডেগার সাহেব বলেছিলেন, যথার্থ কথোপকথন শ্রোতার কাছে একটি দাবি রাখে: “to hear that which I do not already understand.” হাইডেগার সাহেব ওই ক’টি মাত্র কথা খরচা করেই খালাস, কিন্তু কী ভাবে আমি সেই কথাটা শোনার জন্য কানকে প্রস্তুত করব যে কথা আমার কাছে আপাত-পরিচিত হলেও আদতে অপরিচিত? ঠিক ভাষার উদাহরণ দিয়ে নয়, বরং কথালাপের প্রসঙ্গেই বাঙালি মুসলমানের কথায় আমার কান এক বার কী ভাবে খুলেছিল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিই। আমি যখন শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছিলাম ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে, তখন ঢাকার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাহেব সেখানেই প্রাচীন বাংলা গদ্য নিয়ে গবেষণারত। প্রায়ই আমার তাঁর সঙ্গে গল্প হত। কিন্তু মাঝেমাঝেই দেখতাম যে গল্পের বিষয় হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী (অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৬-এর দাঙ্গার সময় যিনি মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) হলে আমাদের পরস্পরের কথা পরস্পরের কাছে পৌঁছয় না। আমি তাঁকে যতই বলি, “জানেন, বেন্থল সাহেবের কাগজপত্রে পরিষ্কার দেখছি, সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব মিল মালিকদের মদতে সাদা ফ্ল্যাগের, অর্থাৎ কমিউনিস্ট-বিরোধী ইউনিয়ন তৈরি করতেন”, অর্থাৎ, প্রকারান্তরে আমি তাঁর নিন্দেই করছিলাম, আনিসুজ্জামান সাহেব ততই বলেন, “হ্যাঁ, দীপেশ, ওইখানে মানুষটা খুব কনসিস্টেন্ট, তিনি সারা জীবন কমিউনিস্টদের বিরোধী ছিলেন।” আমি বুঝতে পারি, সুর মিলছে না। আমার অনেক দিন লেগেছিল বুঝতে যে, বাংলার বিভাজিত রাজনৈতিক ইতিহাসে দুই সোহ্রাওয়ার্দী আছেন। এক জন হিন্দুর দৃষ্টিতে কলঙ্কিত, অন্য জন মুসলমানের দৃষ্টিতে এক স্বার্থহীন নেতা যিনি মুসলিম-স্বার্থে আপসহীন ভাবে লড়াই করেন। এই দ্বিতীয় জন সেই সোহ্রাওয়ার্দী যিনি আমার পরিচিত থেকেও ছিলেন অপরিচিত। বাঙালি মুসলমানের চোখ দিয়ে না-দেখলে যাঁকে আমি দেখতেই পেতাম না।
শেষ কথা, ‘বিদ্বেষ বিষ নাশো’: সংলাপী পক্ষদের পরস্পরের প্রতি অভিযোগ, অভিমান থাকতেই পারে, কিন্তু বিদ্বেষ বিষই। যুগে যুগে পাঠানো ভগবানের দূতেদের বলা এই বাণীটিই সার্থক সংলাপের সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে কঠিন শর্ত। কারণ এই বিষ ঝাড়তে গেলে দৃষ্টি নিজের অন্তরের দিকে ফেরাতে হয়।
সে কাজ আমরা ক’জন পারি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy