স্বপ্নস্বদেশ: ‘সকলের সমান অধিকার’ ভেবে সে দিনের উৎফুল্ল রাজপথ, কলকাতা, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭
ছোলেমান আর গোপাল। দুজনে ছিল দুটো মানুষ। দুটো সুস্পষ্ট অবয়ব ছিল তাদের। তাদের ধরা যেত, ছোঁওয়া যেত। কথা বলা তাদের সঙ্গে। বলা যেত, গোপাল, ছোলেমান অপমান করেনি। তোমার বোঝার ভুল হয়েছে।... ছোলেমান অমনি দোষ স্বীকার করত। অমনি হাত দুটো জোড় করে বলত, হুজুর, কসুর হয়ে গিয়েছে, মাপ করে দিন। মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। ঘরে উপোশ চলছে। ছোলেমানের চোখে জল টলটল করে উঠত। ওরা যে এই স্বভাবের লোক। গোপাল, ওই কথা শুনে তোমার বুক টনটন করে উঠত। ব্যাপারটা ওখানেই চুকে যেত। মানুষের দুঃখ মোচন করতে মানুষের আর কতটুকু সময় লাগে।”
কিন্তু তা তো আর হয় না। সেই ১৯৩০-এর দশকেও হয়নি, প্রেম নেই উপন্যাসে যে সময়ের এই কাহিনি লিখছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। এখনকার দিনেও হয় না, যখন ২০২০-র দশকে গোটা দেশজোড়া জতুগৃহের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
আসলে মানুষের সঙ্গে যদি মানুষ নিজের মতো করে কথা বলতে পারত, অনেক কিছুই মিটে যেতে পারত তাড়াতাড়ি। এক মানুষের দুঃখ, কষ্ট, সমস্যা অন্য মানুষের কাছেও চেনা-চেনা ঠেকত। মনে হত, ‘তাই তো’। কিন্তু এক জন অন্য জনকে যদি মানুষ না ভেবে অন্য কিছু ভাবে, তখন তার দুঃখ বা সঙ্কটকে আর ছুঁতেই পারা মুশকিল। একটা অবয়বের জটিলতার মধ্যে হারিয়ে যায় তখন পুরো চেতনা।
এই জটিল বিষয় ভারী সহজে ফুটে ওঠে গৌরকিশোরের ভাষায়, “মানুষ যে মানুষ থাকতে চায় না। ভালবাসে নুনের পুতুল হতে। সমুদ্রের নোনা জলে মিলিয়ে যেতেই তার আগ্রহ প্রবল। তাতে প্রবল গর্জন সহজেই তোলা যায়। ঢেউয়ের গুঁতোয় অস্থির করে দেওয়া যায়। এই নিরবয়ব সমষ্টি সম্পর্কে একটা নিদারুণ সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তোলা যায় সকলের মনে। তাই গোপাল আর গোপাল থাকল না। সে হিন্দু সমাজের বিস্তীর্ণ জলে নুনের পুতুলের মতোই গলে গেল। ছোলেমানও মিলিয়ে গেল মুসলমান সমাজের মধ্যে।” প্রেম নেই-এর মেজোকর্তা দেখেছিলেন, নুনের পুতুলকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না। এই বিশালব্যাপ্ত না-বোঝা না-শোনার সামনে তাই তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন— একা।
মেজোকর্তার মতো আমরাও অনেকেই আজ নুনের পুতুলদের সামনে ‘একা’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। একা, হতোদ্যম, হতভম্ব। দেশ, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, অধিকার— যে কোনও কিছু নিয়ে কথা বলতে যাওয়াই আজ বড় দুরূহ। কেননা এই সবের মূলে যে মানুষ, তারই চেতনার চৌহদ্দি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে ‘মানুষ’ কথাটা। সে কেবলই বোঝে পরিচয়, আর খোঁজে পরিচয় দিয়ে তৈরি হওয়া একটা কৃত্রিম অবয়ব। আর অমর্ত্য সেন তো আমাদের সচেতন করেই দিয়েছেন যে পরিচয় বলতেও আমরা বুঝতে চাই কেবল ‘একটি’মাত্র পরিচয়: ‘দি ইলিউশন অব ইউনিক আইডেন্টিটি’, যা ‘প্লুরাল আইডেন্টিটি’-র থেকে অনেক বেশি ‘ডিভিসিভ’ বা বিভাজক। চার দিকে অমৃত উৎসবের জোয়ারের মাঝখানে পঁচাত্তর বছরের দেশে তাই বজ্র আঁটুনি দিয়ে চেপে বসছে মানুষকে মানুষ বলে না চিনতে পারার পরিব্যাপ্ত ক্ষমতা ও অধিকার। চোখের সামনে মানুষগুলো নুনের পুতুলে পরিণত হচ্ছে। চাঁদের মতো অলখ টানে সমাজসমুদ্রের বিদ্বেষগর্জন আছড়ে পড়ছে দেশতটে, ঢেউয়ের ঝাপ্টায় মানুষকে গলিয়ে মিশিয়ে দিচ্ছে। সে গর্জন এমনই, যার সামনে দাঁড়িয়ে ‘দেশ’ শব্দটা উচ্চারণ করতে বুক কাঁপে: কে জানে কার দেশ, কে জানে কে বাদ পড়ল দেশ থেকে। ত্রিবর্ণকেতন উড়তে দেখলে ঠান্ডা ভয় খেলে যায় শরীর জুড়ে: কে জানে কাকে চরম আঘাত করে, অপমান করে উড়ল ওই তেরঙা।
ক’দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গিয়েছিলেন গোদাবরীর ভীমাবরম-এ সীতারামন রাজুর জন্মোৎসব পালনে। বলছিলেন, আমাদের নতুন ভারত হল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্নের ভারত, “যেখানে দরিদ্র, কৃষক, শ্রমিক, পিছিয়ে-থাকা মানুষ, আদিবাসী, সকলের সমান অধিকার।” ঠিক তো, কত বার এই কথাটা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারা বলেছিলেন, শুনেছি, পড়েছি। কিন্তু আজকের মতো শূন্যগর্ভ লাগেনি কথাগুলো, এত অর্থহীন, আশাহীন। পঁচাত্তর বছর আগে ভারতের মানুষ যেমন নুনের পুতুল ছিল, আজ প্রতি দিন তার চেয়ে অনেক বেশি। অনেক বেশি লবণাক্ত হয়ে গিয়েছে আমাদের দেশ। তখন যদি-বা ছিল ভেসে ওঠার আশা, আজ লবণপাথারের উল্টো পারকে আমরা চিনে গেছি— অধরা বলে।
লন্ডন গিয়েছিলেন গান্ধী ১৯৩১ সালে। বক্তৃতায়, আলোচনায় খুলে বলছিলেন কেমন ভারতবর্ষ তৈরি হতে চলেছে অদূর সময়ে, কী মনে হয় তাঁর। শুনতে বিরাট ভিড় জমেছিল লন্ডনের চ্যাটাম হাউসে। গান্ধী বলছিলেন, “রাজারা আসবেন, যাবেন, সাম্রাজ্য তৈরি হবে, ভেঙে পড়বে, কিন্তু ভারতবর্ষের দরিদ্র মানুষরা থেকে যাবেন,” আর তাই তাঁদের জন্য, সব বিভেদ-বিচ্ছেদ-দারিদ্র দূর করে তাঁদের ভাল রাখার জন্য সকলকে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। স্বাধীন ভারতবর্ষ হবে অন্য রকম, কেননা “দ্য মাসেস ইন ইন্ডিয়া আর অ্যাওয়েকেনিং”।
শেষ নিঃশ্বাস ফেলার আগে অবশ্য তিনি জেনে গিয়েছিলেন, কী গতি হয়েছিল তাঁর স্বপ্নের। কোন জাগরণের কথা ভেবেছিলেন তাঁরা, কোন রকমটা ঘটল। মানুষের দুঃখ মোচন করতেও যেমন মানুষের এতটুকু সময় লাগে, মানুষকে কেটে রক্তাক্ত করে দিতে লাগে তার চেয়েও কম সময়। জেনেছিলেন বলেই ১৯৪৭ সালের এই মাসটিতে কলকাতায় বসে মূকপ্রায় গান্ধী যেন দূর থেকে লক্ষ করছিলেন তাঁর স্বপ্নের মৃত্যুকে— একা। অন্য নেতারা তখন যে যার মতো ব্যস্ত অন্যতর কাজে। কলকাতা থেকে দিল্লিতে ফিরে পরের মাসেই হরিজন বস্তিতে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি, একাই। সেখানে তখন সদ্য-পাকিস্তান হয়ে যাওয়া মাটি থেকে উৎক্ষিপ্ত পঞ্জাবি মানুষের স্রোত। নিরাপত্তার জন্য তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হল। অনির্দিষ্ট কালের জন্য অনশনে বসলেন তিনি, আবার। কোনও দেখানেপনা নয়, ক্যামেরার সামনে নয়। অসংখ্য মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে নিজে কিছু করার চেষ্টা ছিল তাঁর, তাঁর একার।
নুনসমুদ্রে মিশে না গিয়ে এই যে একা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা, কী কঠিন পরীক্ষা তা, বুঝতে পারি কি আমরা? কত আক্রমণ পেরিয়েছেন তাঁরা, কত অমনোযোগ আর উপহাসের আঘাত সয়েছেন, কত হতাশা বয়েছেন। এমনই একা হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও— বার বার বিভিন্ন বক্তৃতায়, আলোচনায় একই প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। ‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “বস্তুত আজ ভারতবর্ষে যেটুকু ঐক্য দেখিয়া আমরা সিদ্ধিলাভকে আসন্ন জ্ঞান করিতেছি,... ভারতবর্ষের ভিন্ন জাতির মধ্যে তার ঐক্য জীবনধর্মবশত ঘটে নাই, পরজাতির এক শাসনই আমাদিগকে বাহিরের বন্ধনে একত্র জোড়া দিয়া রাখিয়াছে। ইংরেজ যখনই এদেশ ত্যাগকরিবে, তখনই কৃত্রিম ঐক্যসূত্রটি এক মুহূর্তে ছিন্ন হইয়া যাইবে। তখন আর দূরে খুঁজিতে হইবে না, বাহিরে যাইতে হইবে না, রক্তপিপাসু বিদ্বেষবুদ্ধির দ্বারা আমরা পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিতে থাকিব।” কত জন সেই সময় মন দিয়েপড়েছিলেন এ কথা? নিজেই লিখে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, কত একা বোধ করতেন তিনি, প্রায় কেউ মনোযোগ দিয়ে শোনেননি তাঁর কথা— বিশেষত রাজনীতি-জগতের কেউ।
অথচ যে আশঙ্কাপ্রশ্ন রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল, তাঁর মৃত্যুর পরের কয়েকটি বছরেই তাকে অক্ষরে অক্ষরের চেয়েও বেশি সত্যি প্রমাণিত করে কত কী ঘটে গেল দ্রুত। সে ইতিহাস আমাদের পড়া, জানা। আজ বলার কেবল এটুকুই, কিছু যে শিখিনি আমরা তার থেকে, সম্ভবত তার কারণ— বইয়ের ইতিহাসে থাকে কেবল সমাজের কথা, সকলের কথা। আর তাই ও-সব আমাদের মনকে পুরোপুরি ছুঁতে পারে না, কেননা তার মধ্যে লুকিয়ে-থাকা মানুষগুলোর কথা সাধারণত আমরা আলাদা করে ভাবি না।
আজ মনে হয়, মানুষকে মানুষ বলে ভাবার জন্য ইতিহাস, অন্তত পাঠ্য ইতিহাস, হয়তো সত্যিই তত সাহায্য করে না। পাঠ্য ইতিহাসের থেকে সাহিত্য হয়তো মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারে বেশি করে। কিংবদন্তি ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলতেন, “ইতিহাস শিখতে হলে সাহিত্যের কাছে যাও, সাহিত্য পড়ো।” আর তাই, গৌরকিশোর ঘোষের প্রেম নেই-এর মেজোকর্তা কিংবা কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের উজানতলীর উপকথা-য় বিধু মণ্ডলকে দেখে রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কা ও হতাশাটা আমরা হয়তো বেশি করে অনুভব করতে পারি। ধর্মভেদ আর জাতভেদের প্রবহমান আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে দলিত বিধু মণ্ডলের সেই আর্তনাদ, “কালীবাবু, এই হল ভারতবর্ষ। এদেরই স্বাধীনতার জন্য আপনি লড়াই করেন।... যদি এ সমাজ এই ভাবেই থাকে, ইংরেজ থাক আর যাক, আমরা কোনও দিন স্বাধীন হব না।” অনেক বড় সামূহিক পরিবর্তনের সামনে তিনি দেখছিলেন, ধ্বংস। কেননা মানুষ আর অন্যকে মানুষ বলে ভাবে না। তিনি শোক করছিলেন, একা।
আজ সব উৎসবের মধ্যে আমাদের এমনই একা করে রাখছে এমন এক আর্তনাদ— ‘আমরা কোনও দিন স্বাধীন হব না।’ আমাদের বিধ্বস্ত বিশ্বাস, বিস্রস্ত চেতনা জুড়ে এই কথাটাই আজ ঝনঝন করে বাজছে: পঁচাত্তর বছর পর, এই আমাদের ভারতবর্ষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy