নিত্য নাহিলে হরি যদি মিলে
জলজন্তু তো আছে,
ফলমূল খেলে হরি যদি মেলে,
বানর রয়েছে গাছে।
তৃণ দাঁতে ধরি যদি মিলে হরি
তবে হরি হরিণের,
কামিনী ত্যজিলে হরি যদি মিলে
খোজা তো রয়েছে ঢের।
শুধু দুধ খেলে হরি যদি মেলে,
কত আছে কচি ছেলে,
কহে মীরাবাই বিনা প্রেম, ভাই
সে ধন কভু না মেলে।
(মীরার ভজন,অনুবাদ: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, তীর্থরেণু সঙ্কলন)
মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ গল্পের (কৃষণ চন্দর) কথা। স্বাধীনতা আর দেশভাগের অব্যবহিত পরেই যে ট্রেনটি পেশোয়ার থেকে ভারতে আসছিল, এক-এক স্টেশনে যাত্রীদের ধর্ম পরিচয় খুঁচিয়ে তাঁদের খুন করা হচ্ছিল, তাঁদের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল পেশোয়ার এক্সপ্রেস, লুট হচ্ছিল অন্য ধর্মের নারীর ইজ্জত, ট্রেনটি যখন এ দেশে এল, ভ্রাতৃহত্যার রক্ত আর নারী ধর্ষণের কলুষ তাতে লেগে আছে।
সেই ট্রেনের সঙ্গে মিল তো থাকার কথা নয় আজকের বিকানের-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের। এত বছরে দেশভাগ ও দাঙ্গার স্মৃতি কাটিয়ে তো হয়ে গিয়েছে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’। সেই যে বিভূতিভূষণের গল্পে এক মা যেমন ভেবেছিলেন ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন আর আগের মতো অবিচার হবে না, আমাদের ছেলেরা ভাল ভাল চাকরি পাবে’। অথচ ওই কাহিনির কথাই মনে হচ্ছিল, যখন সেই দেশের উপর দিয়ে একটি দীর্ঘ যাত্রার ট্রেন ২৩ ঘণ্টার যাত্রা শেষ করল ৪২ ঘণ্টায়। তবে, দেরি হলেও শেষ তো করল তার যাত্রা। না, কোনও তুলনা চলে না, কোনও রক্ত লেগে নেই তার কামরায়, হতাহতের খবর নেই।
নেই, কিন্তু ভয় ছিল। রাজস্থান সফর শেষে যখন ট্রেনে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই, তখন মাথায় এক বারও আসেনি ১৪৪ বছর পর আবার যে কুম্ভস্নানের যোগ, তার উত্তেজনা তুঙ্গে চলে যাওয়ার কথা। রাষ্ট্র থেকে ব্লগার, উত্তেজনার পারদ বাড়াতে কসুর করেনি কেউই। নিউ দিল্লির মতো স্টেশনে এত জন পদপিষ্ট হওয়ার পরেও হুঁশ ফেরেনি কারও। গ্রাম থেকে গ্রামে প্রচার করা হয়েছে এই কুম্ভস্নান ছুটে গেলেই মহাপাপ, তাই ঝেঁটিয়ে এসেছেন মানুষজন গাড়ি ভাড়া করে। ফেরার পথে সে গাড়ি খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানুষগুলি স্টেশনে ভিড় জমিয়েছেন। প্যাসেজে গাদাগাদি শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে তাঁরা বলছিলেন কী ভাবে ‘কর্তব্যরত’ পুলিশ তাঁদের এসি কামরাগুলিতে ঠেলে তুলে দিয়েছে, যাতে প্রয়াগরাজ দ্রুত ফাঁকা হয়ে যায়, আর নতুন স্নানার্থীরা আসতে পারেন। এত বড় স্নানের পুণ্যের কাছে টিকিট না কাটা, অন্যের চূড়ান্ত অসুবিধা, এমনকি ভয়ের কারণ হওয়ার ছোট ছোট পাপ, এ সব কিছুই না।
এই ট্রেনে কাচের জানলা ভেঙে ঢোকেনি কেউ, কিন্তু মাঝরাতে যখন শয়ে শয়ে লোক প্রায় বুকের উপর এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, সঙ্গে তরুণী কন্যা যখন ভয়ে কাঁটা, যখন চোদ্দো ঘণ্টা অত্যন্ত দরকার হলেও শৌচালয়ে যাওয়া অসম্ভব, যখন সারা ক্ষণ বাধ্যতামূলক নামগান শুনতেই হয়, যখন মাংস-রুটি খেতে হয় চোরের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে (কারণ এই ভারতবর্ষে পাতাললোক সিরিজ়ের মতোই যা খুশি হয়ে যেতে পারে যখন তখন), তখন বড় ভয় করে। ফিরাক সিনেমার মতো দমবন্ধ ভয়।
ভয় শুধু এই গ্রামীণ, নিরক্ষর ভারতবর্ষের জন্যে নয়, ভয় শাইনিং ইন্ডিয়ার জন্যেও। কত উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীও এই মহাকুম্ভে স্নানের জন্যে মরিয়া, এমনকি তাঁরা নিজেরা উপস্থিত থাকতে না পারলেও তাঁদের বাবা-মা যেন এই পুণ্য থেকে বঞ্চিত না হন, তা নিশ্চিত করছেন। তাই বিদেশে বিজ্ঞানে গবেষণারত কন্যা মাউস ঘুরিয়ে ব্যবস্থা করছেন তাঁদের যাত্রার। প্রয়াগরাজ স্টেশন আসার প্রায় ঘণ্টা ছয় আগে থেকে দরজার সামনে বাক্সপ্যাঁটরা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বয়স্ক অসহায় দম্পতির জন্যেও ভয় লাগে। এত ভিড় সামলে নড়বড়ে দুই জন কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন, শুধু সেই ভয়ই নয়, আরও ভয়, এ এমন এক সময়, যখন আমার পরকালের ভাবনা আমি ভাবার আগেই পরিবার, পরিজন, সমাজ, রাষ্ট্র, ব্লগাররা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে!
কয়েক দিন আগেই একটি অন্য ধর্মতীর্থস্থলেও গিয়েছিলাম। ভোরের আলো ফোটার আগেই নরম আলোয় মন ভরে যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ল একটি সর্বজনীন জলাশয় ঘিরে সবাই অজু করছেন। যেখানে কুলকুচি করে ফেলছেন, সেই জলেই গাত্র মুখ প্রক্ষালন। দেখেই উদ্বেগ হল। ধর্মাচার কি প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধিকেও ভুলিয়ে দেয়? এত বড় করোনা অভিজ্ঞতার পরও?
মনের মধ্যে যে সাতেপাঁচে না জড়ানো বুদ্ধিমান লোকটি বসে থাকেন, তিনি বলে ওঠেন ‘তোমার কী তাতে? এই জলে অজু করে বা দূষিত জলে স্নান করে কোটি কোটি মানুষ যদি মুক্তি পাচ্ছেন ভাবেন, তাতে তোমার কিসের আপত্তি?’ প্রশ্ন একটাই। তাঁদের সেই আনন্দের দায় ট্রেনের অন্য ভ্রমণার্থীরা কেন নেবেন? ভিন ধর্মী বা ধর্মহীন বা প্রকাশ্য ধর্মাচারী নন যাঁরা, তাঁদের কি আর কোনও জায়গা রইল না এ দেশে? আগে কিন্তু ধর্মকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া মানুষরা ছিলেন। আজ কেন ধর্মহীন বা ধর্ম-উদাসীন, কিংবা যাঁরা কেবল ব্যক্তিগত পরিসরেই ধর্মাচরণে বিশ্বাসী— তাঁদের এত দুর্ভোগ পোহাতে হবে?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)