Advertisement
E-Paper

প্রেমের মাস, ঘৃণার জীবন

দুই ‘ট্রান্স-ম্যান’কে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানিয়েছিলাম, পড়শি নীলের আরশিনগর। সেইখানে এক শিউরে ওঠা দৃশ্য আছে, সম্পাদনার সময় যা প্রথম প্রথম একা দেখতে পারতাম না।

দেবলীনা

শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:১৬
Share
Save

ফেব্রুয়ারি নাকি প্রেমের মাস? কাদের প্রেম? অবশ্যই এই সমাজের সংখ্যাগুরুর মঞ্জুরি-কমিশনে যা জায়েজ় মনে করা হবে, তাদের। নারী-পুরুষ, ধর্ম-জাতের নিয়মনীতির আইন সব মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। সেই লক্ষ্মণের গণ্ডির বাইরে যদি এক কণাও উপচে পড়েছ, তা হলেই আঘাত। যেমন, প্রেম দিবসের দিনকতক আগে প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার অন্তত পাঁচ জন মানুষকে দক্ষিণ কলকাতার এক বিপণিতে দিনের আলোয় যে ভাবে অকথ্য কুকথা, গালি, মারধর, যৌন হেনস্থা, ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হল।

২০১৮ সালে যখন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা আংশিক ভাবে রদ করা হয়, তখন বিচারপতি ইন্দু মলহোত্র বলেছিলেন, “শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সম্প্রদায়ের মানুষ এবং তাদের পরিবার যে অপমান এবং বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে, তার প্রতিকারে দেরির জন্য ইতিহাস ক্ষমাপ্রার্থী।” ফেব্রুয়ারির বসন্ত দিনে দক্ষিণ কলকাতার জনতার বিচারসভায় কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং ক্ষমাপ্রার্থনার কোনও প্রভাব ছিল না। কখনও কি থাকে? অভিজ্ঞতা বলছে, ২০১৮ সালের পর থেকে যৌন-সংখ্যালঘু মানুষের উপরে অত্যাচারের বিষবৃক্ষ আরও ডালপালা মেলেছে। সংখ্যাগুরুর প্রেম বা শরীর-মনের ধারণার যে মানচিত্র, তার বাইরে আর যা কিছু আছে, সবই তাদের কাছে ‘বিকৃত’, ‘অস্বাভাবিক’। সুতরাং, তাকে ‘স্বাভাবিক’ করার মহান সামাজিক টহলদারিতে আমরা সাক্ষী থেকেছি নিজের ভাই বা দাদার কাছেও ধর্ষিত হওয়ার ঘটনার— পরিবার বিশ্বাস করেছে, পুরুষের স্বাদ পেলে ‘লেসবিয়ান’ মেয়ে শুধরে যাবে। শহর-গ্রাম-জাতধর্ম-রাজপথ থেকে গলিপথ, পরিবার থেকে বৃহত্তর সমাজ, সর্বত্রই আকছার ঘটেছে এমন ঘটনা।

দুই ‘ট্রান্স-ম্যান’কে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানিয়েছিলাম, পড়শি নীলের আরশিনগর। সেইখানে এক শিউরে ওঠা দৃশ্য আছে, সম্পাদনার সময় যা প্রথম প্রথম একা দেখতে পারতাম না। এক ট্রান্স-ম্যান এবং তাঁর বান্ধবী এক সঙ্গে থাকতেন, দু’জনেই প্রাপ্তবয়স্ক। পরিবারের অত্যাচারে ঘরছাড়া। কিন্তু মেয়েটির পরিবার এক দিন তাদের খোঁজ পেয়ে যায়। এক বিশাল গাড়ি নিয়ে এসে চরম পিটুনি দিতে দিতে মেয়েটিকে পরিবার গাড়িতে তুলছে। হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, এক সময় সে নর্দমায় পড়ে যাচ্ছে। তার পরে মাল ঠুসে তোলার মতো করে তাকে গাড়িতে তোলা হল। তার সঙ্গী অসহায়ের মতো সকলের কাছে সাহায্য চাইছে। দিনের আলোয় সমাজ সব দেখছে আর বলছে, বাবা-মা যখন নিয়ে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই ভালর জন্যই করছে। পুলিশেরও সেই সময় একই বক্তব্য ছিল।

কত ঘটনাই না ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত আমাদের নজরের আড়ালে, গ্রামে-গঞ্জে-মফস্‌সলে। সংবাদমাধ্যম অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় তো সব খবর পৌঁছে উঠতে পারে না। শহরের এক নামী স্কুলের এক ঝাঁক ছাত্রীর বিরুদ্ধে এক ছাত্রী প্রধান শিক্ষিকার কাছে লিখিত অভিযোগ করে যে, তার সহপাঠীরা আপত্তিকর আচরণ করে, তারা হয়তো ‘লেসবিয়ান’। প্রধান শিক্ষিকা অভিযুক্ত ছাত্রীদের থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেন যে, তারা কখনও এমন কোনও কাজ করবে না। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ যা ব্যবস্থা করার করছে।” এই ঘটনা নিয়ে সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ তোলপাড় হয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত এমন কত ঘটনা নিশ্চয়ই আমাদের গ্রামগঞ্জের অনেক ইস্কুল-কলেজে ঘটে চলেছে, কে তার খবর রাখে? সন্তানের যৌন পছন্দের কথা/যৌনতার কথা জানতে পেরে কোনও এক গ্রামের পরিবার সন্তানকে গাছে বেঁধে বেধড়ক মার মেরেছিল। মফস্‌সলের এক ট্রান্স-ম্যানকে তার পরিবার শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল দিনের পর দিন। সময় তার মতো বয়ে যাচ্ছে, সমাজের কি আদৌ ভঙ্গি বদল হচ্ছে?

২০১১ সালে, ঘটনাচক্রে এই প্রেমের মাসেই নন্দীগ্রামের স্বপ্না-সুচেতা যুগলে আত্মহত্যা করেন। তাঁদের পরিবার বা সমাজ সেই মৃতদেহ দু’টি নিতে অস্বীকার করে। তাঁরা বেওয়ারিশ লাশ হয়ে পুড়ে ছাই হয়। সেই ঘটনা নিয়ে আমরা নির্মাণ করলাম তথ্যচিত্র …এবং বেওয়ারিশ। সেই সময়ে গ্রামবাসী কিছু পুরুষ হুমকি দিয়ে আমাদের গ্রামের বাইরে বার করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আপনারা শহরে যান, আমাদের এখানে এ সব নেই।” তখন কি ভেবেছিলাম, আজ এই ২০২৫ সালের কলকাতার রাজপথেও জনতার এমন ব্যবহার, এমন অকুণ্ঠ প্রহার শরীর-মনে ঘা দিয়ে যাবে?

জামাইকার গায়ক এলিফ্যান্ট ম্যান সেই কবেই ঘৃণায় বিষিয়ে যাওয়া সুর তুলে গেয়েছিলেন, “যদি শোনো যে কোনও সমকামী নারী ধর্ষিতা হয়েছে, জেনো সেটা আমাদের দোষ নয়— দুই নারী পরস্পরের শয্যাসঙ্গিনী হলে মৃত্যুই তাদের প্রাপ্য।” এমন অনেক জনপ্রিয় ‘গান’ আছে, যেখানে সমকামীদের জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়া, গুলি করা, মুখে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়ার কথা ছন্দে-গীতিতে বলা হয়। মানুষ তাতে গলা মেলায়, আর সেই ঘৃণার সুর ছড়িয়ে পড়ে দেশে-দেশে, কালে-সময়ে, শহরে-গ্রামে, এই প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে। হাওয়ায় কান পাতলেই শুনতে পাব তেমন কোনও গানের সুর। আমাদের এই শহরেও।

তথ্যচিত্রনির্মাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

love Sexual abuse rape threats documentary film

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}