Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

হায় চিন

‘আশা’টির মধ্যেই যে তাহার ভাঙিবার কারণটি লুকাইয়া ছিল, ভক্তরা স্বভাবতই বুঝেন নাই। আশঙ্কা হয়, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীও বুঝেন নাই।

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১১:৩১
Share: Save:

চিন সফরের ব্যস্ততার মধ্যেও কি নরেন্দ্র মোদীকে একটি প্রশ্ন বিব্রত করিবে না— বহু-বিজ্ঞাপিত কঠোর নেতা হইবার পরও কেন তাঁহার শি চিনফিং হইয়া উঠিবার স্বপ্ন অধরাই থাকিয়া গেল? অথবা, কেন (সিঙ্গাপুরের নায়ক) লি কুয়ান ইউ হইয়া উঠা গেল না? কেন তাঁহার বজ্রমুষ্টি দেশে বিনিয়োগ ধরিয়া আনিতে পারিল না? তিনি চিনের পথে বিমানে সওয়ার হইবার আগের দিন দশ জন বিশিষ্ট লগ্নিকারী বৈঠক করিলেন রাহুল গাঁধীর সহিত। মোদীর শাসনের চার বৎসরেও ভারতীয় অর্থনীতিতে কেন পরিবর্তন আসিল না, কংগ্রেস সভাপতির নিকট তাঁহারা সেই খেদ প্রকাশ করিয়া গেলেন। ভক্তরা বলিতে পারেন, এ হেন বৈঠকের কোনও বিশেষ মাহাত্ম্য নাই। বিদেশি লগ্নিকারীরা যেমন দেশের শাসক পক্ষের সহিত আলোচনা করেন, তেমনই বৈঠকে বসেন বিরোধী নেতাদের সহিতও। দ্বিতীয় ইউপিএ-র আমলে এমনই কিছু লগ্নিকারী নরেন্দ্র মোদীর সহিতও বৈঠক করিয়া গিয়াছিলেন। সত্য। তবে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি বিষয়ে লগ্নিকারীদের উদ্বেগও সমান সত্য। আরও বেশি সত্য একটি ‘স্বপ্ন’ভঙ্গ— গণতন্ত্রের হরেক হাঙ্গামাকে দূরে ঠেলিয়া দৃঢ় প্রশাসক মোদী ভারতীয় অর্থনীতিকে নূতনতর উচ্চতায় লইয়া যাইবেন। একদা যে কাজটি করিতে পারিয়াছিলেন দেং জিয়াওপিং বা লি কুয়ান ইউ। ভক্তজনের ‘আশা’ ছিল, একনায়কের উত্থানে ভারতে গণতন্ত্রের প্রাবল্য কমিয়া আর্থিক উন্নতির ঝড় উঠিবে। বিদেশি লগ্নিকারীদের সংশয়ে স্পষ্ট— মোদীর চার বৎসরে তাহা হইয়া উঠে নাই। গণতন্ত্রের শ্বাস রুদ্ধ হইয়াছে, অর্থনীতির দিন বদলায় নাই।

‘আশা’টির মধ্যেই যে তাহার ভাঙিবার কারণটি লুকাইয়া ছিল, ভক্তরা স্বভাবতই বুঝেন নাই। আশঙ্কা হয়, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদীও বুঝেন নাই। তিনি ছাপ্পান্ন ইঞ্চির গৌরবে মুগ্ধ ছিলেন। দেং জিয়াওপিং বা লি কুয়ান ইউ-এর পাশাপাশি যদি তাঁহারা ইদি আমিন, রবার্ট মুগাবে বা মুয়াম্মর গদ্দাফির কথাও ভাবিতেন, তবে হয়তো বুঝিতেন, গণতন্ত্রের সহিত আর্থিক সমৃদ্ধির সম্পর্কটি ব্যস্তানুপাতিক নহে। চিনের সমৃদ্ধি গণতন্ত্রহীনতার ফলে নহে, গণতন্ত্রহীনতা সত্ত্বেও। কারণ, কমিউনিস্ট চিন মানুষের স্বাধীনতা কাড়িয়া লইলেও শিক্ষা আর স্বাস্থ্য দিয়াছিল। ভারতকে চিনের পদচিহ্নে চালনা করিতে যাঁহাদের আগ্রহ অদম্য, তাঁহারা দুই দেশের এই প্রাথমিক ফারাকটির কথা ভুলিয়া যান। গণতন্ত্রের মূল্যে বিনিয়োগ যদি আসেও, তাহাকে স্বাগত জানানো উচিত কি না, তাহা বৃহত্তর প্রশ্ন। কিন্তু, গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিলেই, বিরুদ্ধ স্বরের কণ্ঠ রোধ করিলেই যে বিনিয়োগ আসে না, এই কথাটিও বুঝিতে না পারিবার ফলই আজিকার আশাভঙ্গ।

‘বেনেভলেন্ট ডিক্টেটরশিপ’ বা হিতৈষী একনায়কতন্ত্র বস্তুটি সোনার পাথরবাটি। তর্কের খাতিরে যদি একনায়কের পরার্থপর সদিচ্ছার অস্তিত্ব স্বীকার করিয়াও লওয়া যায়, তবুও কি তাহা শেষ অবধি সর্বজনীন উন্নয়নে, বা অন্তত বিনিয়োগের প্রাচুর্যে, পৌঁছাইতে পারে? নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেই এই প্রশ্নের উত্তর রহিয়াছে। দুইটি উদাহরণ আলোচনা করিলেই যথেষ্ট হইবে। এক, গণতন্ত্রকে যদি তাহার প্রাপ্য পরিসরটি ছাড়িতেন, তবে মাত্র চার বৎসরে দেশের সংখ্যালঘু, দলিতদের এমন অবস্থা হইত না। তাহাতে রাজনৈতিক সুস্থিরতাও বজায় থাকিত। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সেই সুস্থিরতার দাম অসীম। দুই, আলোচনাভিত্তিক গণতন্ত্রের পরিসরে নোটবন্দির ন্যায় বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত সম্ভবত রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হইত না। তাহার বিপদের দিকটি পূর্বেই চিহ্নিত হইত। সিদ্ধান্তটি ভারতের কতখানি ক্ষতি করিয়াছে, লগ্নিকারীদের উদ্বেগই তাহার প্রমাণ। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিই যে দেশের পক্ষে যথেষ্ট নহে, তাহা যে গণতন্ত্রের বিকল্প হইতে পারে না, ভক্তরা বুঝিতেছেন কি?

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Economy Diplomacy democr
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE