Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
নারী নির্যাতন বিরোধী পক্ষ পালন কি কেবলই এক অনুষ্ঠান

ব্যতিক্রম নয়

কাগজ খুললেই, টিভির চ্যানেল ঘোরালেই, বউয়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের, এমনকী খুনের খবর নিত্য চোখে পড়ে। আর শুধু খবরেই বা কেন?

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সারা পৃথিবী জুড়ে ২৫ নভেম্বর পালিত হচ্ছিল নারী নির্যাতন বিরোধী দিবস। সেই দিনেই কলকাতার উপান্তে অনন্যা কোনার প্রাণ দিলেন। অনন্যার মাত্র ন’মাস বিয়ে হয়েছিল। অভিযোগ, বিয়ের পর থেকেই স্বামী রোজগারের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। চাকরি পাচ্ছিলেন না বলে নিত্যনৈমিত্তিক হেনস্তা চলত শ্বশুরবাড়িতে। মনে পড়ে, এক মাস আগেই পারমিতা বক্সীকেও আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। পারমিতা চাকরি করতেন পুণেতে আর তাঁর স্বামীর কাজ ছিল বেঙ্গালুরুতে। স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য পারমিতা চাকরি ছেড়ে বেঙ্গালুরু যেতে চেয়েছিলেন। অভিযোগ, সেই অপরাধে স্বামী এমন মানসিক অত্যাচার করেন যে তিনি আত্মহত্যায় বাধ্য হন।

কাগজ খুললেই, টিভির চ্যানেল ঘোরালেই, বউয়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের, এমনকী খুনের খবর নিত্য চোখে পড়ে। আর শুধু খবরেই বা কেন? নিজেদের গেরস্থালিতে, পড়শির বাড়িতে চোখ মেলে তাকালেই আকছার চোখে পড়ে বাড়ির বউয়ের ওপর অত্যাচার। ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে বা পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে এ দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে ২৮.৮% অর্থাৎ প্রায় তিন জনের মধ্যে এক জন বধূ জীবনে কখনও না কখনও স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আমাদের রাজ্য এবং শহরেও একই হাল।

কেন ঘটে বউয়ের ওপর অত্যাচার? ঘটবে না কেন? স্ত্রী যে স্বামীর জ্যান্ত সম্পত্তি! তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে গেলে তো একটু আধটু ‘শাসন’ করতেই হবে! মেয়েজন্মই যে স্বামীকে, শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে খুশি করার জন্য! বউয়ের নিজের খুশি? ছি! একটা সময় ছিল যখন বউয়ের ঘরের বাইরে চাকরি করা অপরাধ ছিল। সে চিত্র আজও বদলায়নি। এখনও অনেক পরিবারে চাকুরিরতা বউদের ‘মহানগর’-এর আরতির মতো স্বামীর সন্দেহপরায়ণতা সামলাতে জানলা দিয়ে লিপস্টিক ফেলে দিতে হয়। কাজের জায়গায় মোবাইলের চার্জ চলে গেলে অনেক মেয়েকে বাড়ি ফিরে স্বামীর হুমকি শুনতে হয়, ‘চাকরি ছাড়িয়ে দেব’! আবার বউ যখন স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিতে চান তখন স্বামীর নির্যাতন সইতে হয় কাউকে কাউকে। অর্থাৎ মোদ্দা কথাটি হল, স্বামী যখন চাইবে, যে ভাবে চাইবে, সে ভাবেই উৎপাদনের সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক নির্ধারিত হবে। স্বামী যখন খুশি স্ত্রীর কাজ ‘ছাড়িয়ে দিতে’ পারেন, যখন খুশি তাকে কাজে ‘পাঠাতে’ পারেন। কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম আর কী!

আসল কথা হল, বউয়ের রোজগারের ক্ষমতার ওপর স্বামীর নিরঙ্কুশ দখলদারি চাই। বউ চাকরি করবে কি করবে না, সেখানেই এই নিয়ন্ত্রণের শেষ নয়। এখনও বহু পরিবারে বউ কী ধরনের চাকরি করবেন, সে কাজ আংশিক না পুরো সময়ের, সবই ঠিক করেন কর্তামশাই! এমন অনেক স্ত্রী আছেন, সে তিনি উচ্চশিক্ষিতও হতে পারেন, স্কুলের গণ্ডিও তাঁর পেরোনো হয়ে উঠতে না পারে, যাঁর মাসের শেষে রোজগারের পাইপয়সা গুনে স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়। আর তার পর তাঁদেরই উপার্জিত অর্থ থেকে স্বামীরা গাড়িভাড়া, টিফিন খরচ হিসেব করে তাঁদের হাতে মাসের হাতখরচা তুলে দেন।

অথচ উল্টো পিঠের গল্পটি কেমন? কর্তামশাইয়ের শুধু চাকরি বা আয়ের পরিমাণই নয়, তাঁর কাজে যাওয়া, অথবা না যাওয়া, চাকরি করা অথবা ছাড়া, সবই চলে তাঁর নিজের মরজি মতো। আজ গা ম্যাজম্যাজ করছে, কাল একটু বেশি পান হয়েছে, অতএব কাজে গেলুম না। সে জন্য যদি চাকরি চলে যায়? বস রেগে যায়? টাকা কাটা যায়? যাক গে! আমি পুরুষসিংহ! তার পর যখন সত্যি সত্যিই সিংহমশাই বেরোজগেরে হয়ে পড়েন, তখন? তখন আবার কি? সর্বংসহা বউ আছে না? এত দিন সে শুধু হেঁসেল ঠেলেছে, লেখাপড়া কিংবা হাতের কাজ যা শিখেছিল, সে সব কবে শিকেয় উঠেছে, সে এখন কি কাজ পাবে? সে সব জানেন না কর্তামশাই। তাঁর আদেশ, চাকরি বউকে পেতেই হবে। শুধু চাকরি খোয়ালেই নয়, স্বামী যথেষ্ট রোজগার করলেও, তিনি চাইলে স্ত্রীকে যেন তেন প্রকারেণ চাকরি জোগাড় করতে হবে। এমএ বিএ পাশ বউ আনা তা হলে কিসের জন্য? স্ত্রীর ডিগ্রির উপরও স্বামীর নিঃশর্ত অধিকার কিনা!

অনন্যা বা পারমিতার ঘটনা কিন্তু ব্যতিক্রম নয়। খবরের কাগজে বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখলেই বোঝা যায়, চাকুরিরতা মেয়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। গত কয়েক দশকে পরিবারগুলিতে বউ সম্পর্কিত চিন্তায় একটি বড় বদল হয়েছে। অনেকেই চাইছে বউ চাকরি করুক। প্রাথমিক ভাবে শুনলে মনে হয়, সমাজ বুঝি বদলাচ্ছে। কিন্তু অনন্যাদের ঘটনায় প্রমাণ হয়, ভিতরের কথাটি অন্য। এত দিন পর্যন্ত আমাদের সমাজ বউয়ের রিপ্রোডাকশন অর্থাৎ পুনরুৎপাদনের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেই খুশি ছিল। বউদের ঘরের কাজ এবং সন্তানধারণ ও বাচ্চার দেখাশোনার যন্ত্র হিসেবে পেয়ে তৃপ্ত ছিল সংসার। কিন্তু পিতৃতন্ত্র চরিত্র বদলাচ্ছে। এ যুগে স্ত্রীর উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদন, দুই ক্ষমতার ওপরই পূর্ণ দখল চায় স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ি। অর্থাৎ স্ত্রীর ঘরে বাইরে সর্বত্র খাটুনির সুফল ভোগ করবে তার স্বামী, অথচ খেটে মরবে স্ত্রী।

এ অন্যায় শুধু পরিবারের চৌহদ্দিতেই আটকে নেই। আমাদের দেশচালকরাও এই নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখতে চান। মেয়েদের জন্য বেশির ভাগ অর্থনৈতিক প্রকল্পের প্রচারে বলা হয়, মেয়েরা রোজগার করলে পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে। অর্থাৎ মেয়ে অথবা বউয়ের উপার্জন পরিবারের জন্য, তার নিজের জন্য নয়। সে জন্যই যে বউ কাজের বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্ত কায়েম করতে যায়, তাকে মরতে হয়। এই মরণে রাষ্ট্রের পরোক্ষ মদতও আছে, কারণ রাষ্ট্রও মনে করে, পরিবারের উন্নতির জন্যই মেয়েদের রোজগার প্রয়োজন। মেয়ের নিজের উন্নতি অথবা ইচ্ছার প্রশ্নটি রাষ্ট্রের কাছে গৌণ।

এই নিয়ন্ত্রণেই কিন্তু গার্হস্থ্য অত্যাচারের সূত্রপাত হয়। আমাদের দেশে গার্হস্থ্য অত্যাচার আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ আইনব্যবস্থার সুপারিশ অনুযায়ী গার্হস্থ্য নির্যাতনের ক্ষেত্রে বউদের রক্ষাকবচ ৪৯৮এ শিথিল করার প্রস্তাব বিবেচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ আইন নাকি স্ত্রীরা অপব্যবহার করছেন। অথচ ২০১৫-র ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে মোট ৭৬৩৪ জন মহিলার পণের দাবিতে, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে মৃত্যু হয় এবং মাত্র ৩৪.৭% অভিযোগের রায় ঘোষণা হয়েছে। ৪৯৮এ অপব্যবহারের ভিত্তিহীন প্রচারের ফলে রায় ঘোষণা আরও ঢিলেঢালা হয়ে যাবে এবং সুবিচারের আশাও কমে যাবে। কার্যত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের পথ সুগম হবে এবং সামাজিক ভাবে গার্হস্থ্য হিংসা এক ধরনের মান্যতা পাবে। আশ্চর্য কথা হল, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির কড়া শাস্তি প্রাপ্য। অর্থাৎ নির্যাতনের সুবিচার পাওয়ার জন্য বউকে আত্মহননের পথ বাছতে হবে! বেঁচে থাকাকালীন অত্যাচারের সুরাহার সম্ভাবনা কম।

অনন্যাদের মৃত্যুর দায় শুধু্মাত্র রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে চলবে না। স্বীকার করা দরকার, এ দায় আমাদেরও। আমাদের চার পাশে যখন বাড়ির বউদের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ চলে, আমরা দেখেও দেখি না। নিয়ন্ত্রণকে, কখনও কখনও নির্যাতনকেও, আমরা বলি, ভালবাসা। আমরা সম্ভবত ইচ্ছে করেই ভুলে যাই যে, ভালবাসার ভিত্তি হওয়া উচিত সাম্য, দখলদারি নয়। আরও দুর্ভাবনার বিষয় হল, আমরা মনে করি, এ সব আমার পরিবারে ঘটে না। আমরা ধোয়া তুলসী পাতাটি। কেউ কেউ মনে করেন, এ সব গরিবের ঘরে হয়, কেউ মনে করেন, এ সব অশিক্ষিত পরিবারে হয়, কখনও কখনও বলিউডের (লিপস্টিক আন্ডার দ্য বুর্খা, সিক্রেট সুপারস্টার ইত্যাদি) ছবিতে, কেউ বা ভাবেন, মুসলমান পুরুষরা বউ পেটানো এবং বউকে ধর্ষণে মাস্টার, কেউ আবার ভাবেন, ‘ছোট জাতের’ মধ্যে ও-সব হয়। এ রকম নানা কিছু ভেবে আমরা জেগে ঘুমোই।

আর এখানেই আমরা ভুল করি। স্বীকার করা দরকার, বউদের নিয়ন্ত্রণ সব ধরনের পরিবারে কমবেশি হয়, আমাদের যার যা-ই সামাজিক-অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত অবস্থান হোক না কেন, আমরা সবাই এ পাপের ভাগীদার। আমরা সবাই অনন্যাদের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এই দায় স্বীকারই অন্যায়ের প্রতিকারের, নিজেদের এবং সমাজ বদলের প্রথম পদক্ষেপ। আজ যদি নিজেদের দিকে আমরা তাকাতে না পারি, তা হলে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর, নারী নির্যাতন বিরোধী পক্ষকাল পালন, আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Domestic Violence Women Abuse
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE