Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

‘ঋতুকালীন ছুটি’ সত্যিই চাই?

প্রথমেই বলে রাখা দরকার ঋতুকালীন কষ্ট প্রাত্যহিক জীবনে নানা অসুবিধা সৃষ্টি করে। স্কুলের ছাত্রীরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে অনেক ধরনের সমস্যায় পড়ে

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৫
Share: Save:

প্রথমেই বলে রাখা দরকার ঋতুকালীন কষ্ট প্রাত্যহিক জীবনে নানা অসুবিধা সৃষ্টি করে। স্কুলের ছাত্রীরা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে অনেক ধরনের সমস্যায় পড়ে। কর্মস্থলেও মেয়েদের হয়রানি হয়। কাজেই ‘ঋতুকালীন ছুটি’র সপক্ষে যুক্তির অভাব নেই। তবু ভারতে এই জাতীয় ছুটি মহিলাদের কতখানি স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেবে, তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন জাগে।

শোনা যায়, ২০১৭ সালেই ভারতের একটি ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানি এবং মুম্বইয়ের অপর এক কোম্পানি মহিলাদের ‘ঋতুকালীন ছুটি’র কথা ঘোষণা করেছিল। বিহার সরকার অন্য নামে ১৯৯২ সাল থেকেই এই ছুটি দিচ্ছে। গত বছর জানুয়ারি মাসে নিনং এরিং নাম্নী অরুণাচলের এক জনপ্রতিনিধি (কংগ্রেস) লোকসভায় এই মর্মে একটি ‘প্রাইভেট মেম্বার বিল’ আনার ব্যাপারে সক্রিয় হন। বিলে কর্মরতা মহিলাদের এবং স্কুলে অষ্টম শ্রেণি থেকে শুরু করে উচ্চতর শ্রেণির ছাত্রীদের মাসে দু’দিন ‘ঋতুকালীন ছুটি’ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। এই বিল নিয়ে বিশদ ভাবে আলোচনা হয়নি। তবু শোনা যাচ্ছে, আমাদের রাজ্যের কোনও এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাও এই ছুটি দেওয়ার পথে হাঁটছে। এই দৃষ্টান্ত কিন্তু অন্যদেরও প্রভাবিত করতে পারে।

ভারতে শ্রমের বাজারে বিশ্বের সবচেয়ে কমসংখ্যক মহিলা অংশগ্রহণ করেন। গত কয়েক বছরে এই সংখ্যা আরও কমেছে। দেশের কর্মস্থলে ছাব্বিশ শতাংশও মহিলা নেই। সেনাবাহিনীতে তো দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করেও নারী সৈনিক পাওয়া কঠিন। প্রশাসনেও নারী প্রতিনিধিত্ব নামমাত্র। সরকারি ক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকদের পাঁচ শতাংশও কাজ করেন না। বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি স্বভাবতই মুনাফাদর্শী। ভারতের প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ কর্মী কাজ করেন বেসরকারি ক্ষেত্রেই। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে, এই প্রচণ্ড বেকারত্বের অন্ধকারে পুরুষের কর্মজীবনই সঙ্কটে। সেখানে যে মহিলারা প্রথম থেকেই পারিবারিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অসাম্যের শিকার, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কর্মস্থলে তাঁদের যোগ দেওয়ার সুযোগ আরও কম। একটি বেসরকারি সংস্থা কেন নিজের ক্ষতি মেনে নিয়ে মহিলাদের কাজ দেবে? তাঁদের দরজার সামনে তো একটি চেয়ারের জন্য কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের লাইন! কিছু বিশেষ ছুটি মেয়েদের না দিলেই নয়। আবার প্রতি মাসে একাধিক দিন ছুটি? মেয়েদের কাজ দেওয়াই কি তারা কমিয়ে দেবে না? দু’একটি কোম্পানির ‘কল্যাণ করার’ গিমিকে এই চরম প্রশ্নটি কিন্তু ঢাকা পড়ে যায় না। মেয়েরা যদি কাজের ফাঁকে অবকাশ পেতে গিয়ে কাজের সুযোগ থেকেই বঞ্চিত হন, এ দেশের নারীর স্বাবলম্বন তা হলে সুদূরপরাহত। কর্মস্থলের যে অতিসামান্য অংশ তাঁরা অধিকার করে আছেন, সেখান থেকেও তাঁদের বিতাড়িত হতে হবে সকলের অজান্তেই।

এ কথা বলে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করছি না, যে এত কাল তো মেয়েরা ঋতুকালীন সময়েও কর্মস্থলে এসেছেন। আগে হয়নি, তাই এখনও হবে না— এটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। তবু প্রশ্ন, প্রত্যহ বাড়ির যে মহিলারা আমাদের সুখের সরঞ্জাম জোটাতে গিয়ে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যস্ত থাকেন, তাঁদের ‘ঋতুকালীন ছুটি’ দেওয়া হবে তো? যে নারী মাথায় ইট নিয়ে টলতে টলতে এগিয়ে এসে আমাদের ঘর তৈরির পথ সুগম করে দিচ্ছেন, তাঁদের এই অবকাশ প্রাপ্য হবে তো? না কি ‘ঋতুকালীন’ সময়ে

তাঁদের কোনও শারীরিক কষ্ট হয় না? ভারতের মহিলা খেলোয়াড়রা কী করবেন? সেনাবাহিনীর প্রধান তো এই ক’দিন আগেই মেয়েদের ‘মাতৃত্বকালীন ছুটি’র প্রতি কটাক্ষ করে তাঁদের ক্ষমতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। প্রতি মাসে মেয়েদের ‘ঋতুকালীন ছুটি’র দাবি সেনাবাহিনীকে নারীশূন্য করে ফেলবে না তো?

শুধু রুক্ষ বাস্তবে নয়, বেশ কিছু মেয়ের কাছে ‘ঋতুকালীন ছুটি’ বেশ অসম্মানজনক এক দাবি। শারীরিক ভাবে মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ নন। কিন্তু তাঁরা শক্তিতে পুরুষের চেয়ে আরও অনেক এগিয়ে এই কারণে যে, যন্ত্রণাকে তাঁরা জয় করতে জানেন। স্কুলজীবন থেকেই মেয়েরা এই লড়াই অভ্যাস করেন। সংসারে সবচেয়ে বেশি কষ্ট তাঁরাই সহ্য করেন, মা হওয়ার সময় তাঁরাই ঈশ্বরের মতো সহিষ্ণু হয়ে ওঠেন, বাড়ির বাইরেও প্রতিটি কাজ পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁরাই করে চলেন। ঋতুমতী হয়েছেন বলে অবকাশ চাই, এমন চাওয়ায় তাঁরা সহমত নাও হতে পারেন। এটা তাঁদের কাছে ‘দুর্বলতা’র নজির মনে হতে পারে। তার পরও ‘ঋতুকালীন ছুটি’র দাবি পুরোপুরি নস্যাৎ করা যায় না। কিন্তু পরিস্থিতি তো সব সময়ে সুস্থ নিয়মকেও কার্যকর করার উপযুক্ত থাকে না। তার উপর রয়েছে অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা। ‘চাইল্ড কেয়ার লিভ’ মায়েদের কাছে একটি অতি প্রয়োজনীয় ছুটি; অধিকারও বটে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কী ভাবে তার ব্যবহার হয়, তাঁদের ক্লান্ত সহকর্মী এবং বিপর্যস্ত বিভাগীয় প্রধানদের সকরুণ দৃষ্টিতেই তা স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয়। অবশ্যই সততার সঙ্গেও অনেকেই ছুটি নিয়ে থাকেন। তবু বাকিদের সংখ্যাও কম নয়!

কিছু দেশে ঋতুকালীন ছুটি আছে, যেমন ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, চিনের কিছু অংশে। আবার অনেক দেশেই এই ছুটি নেই। এক এক দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এক এক রকম, আইনকানুনও ভিন্ন। ‘ঋতুমতী’ অবস্থায় কারও বিশেষ অসুস্থতা ঘটলে তাঁর জন্য ব্যবস্থা নিশ্চয় রাখা উচিত। কিন্তু সেই সাময়িক ‘অসহায়তা’ যেন ‘নিয়মসিদ্ধ প্রাপ্তি’র আকাঙ্ক্ষা হয়ে না ওঠে। শবরীমালার দেবমন্দিরে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় থাকা সত্ত্বেও ঋতুমতী নারীদের প্রবেশ করাতে সরকারের কালঘাম ছুটে যায়। স্যানিটারি ন্যাপকিন হাতে নায়ককে দাঁড়াতে হয় টেলিভিশনের পর্দায়। আজও ঋতুমতী নারী মানেই ব্রাত্য; তার সংস্পর্শে মানুষ তো কোন ছাড়, দেবতাও ‘অপবিত্র’ হয়ে যান। এর পর ‘ঋতুকালীন ছুটি’ দিয়ে কর্মস্থলেও ব্রাত্য করে দিলে বেকার মেয়েদের রুদ্ধ সঙ্গীতে অন্দরমহল কেঁপে উঠবে না তো?

অন্য বিষয়গুলি:

Gender Woman Civic Issues Society Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE