দলীয় প্রচারে নরেন্দ্র মোদী।—ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালের আড়াই বছর অতিক্রান্ত। আড়াই বছর মধুচন্দ্রিমার জন্য যথেষ্ট। আড়াই বছর আগে ভোট জিতে যখন মোদী এসেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর এক চূড়ান্ত হতাশার অবসান ঘটাতে আবির্ভূত হয়েছেন জেমস বন্ড। সুপারম্যান-অরণ্যদেব অথবা এ হেন কোনও কাল্পনিক চরিত্র।
প্রয়াত প্রধান সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত একদা আমাকে বলেছিলেন, কল থেকে প্রবল বেগে জল পড়ছে। জল পড়ছে পাথরের ওপর। মনে হয় পাথর তো পাথর, জলের এই আঘাতে কী হবে? কিন্তু এক দিন জল পড়তে পড়তে হঠাৎ দেখা যায় পাথরও ফুটো হয়ে গেছে।
মোদী সরকারের আড়াই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ মনে হচ্ছে অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান। আর অসন্তোষ যত বাড়ছে, সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ততই কমছে। আর ততই কর্তৃত্ব দুর্বল হচ্ছে। যতই দুর্বল হচ্ছে কর্তৃত্ব ততই সংবাদমাধ্যমের উপর আঘাত আসছে।
প্লেটোবাবু বলেন, শাসকের একটা মস্ত বড় সমস্যা হয় যখন সে তার নিজের শাসনেরই প্রেমে পড়ে যায়। একে বলা যায়, রাজনৈতিক নার্সিসিজম। নার্সিস-কে ভালবাসতে চেয়েছিল ইকো। নার্সিস তাকে প্রত্যাখ্যান করে অভিশাপ কুড়িয়েছিল। সে জলে নিজের ছায়া দেখে তারই প্রেমে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার ভালবাসার অন্য মানুষজন থেকে।
প্লেটোবাবু: ‘‘মিতাচার মিতাচার। বার বার আমি বলেছি মিতাচার। আমি আমার শাসক আবার আমিই আমার ভৃত্য। সেটাই তো সার্বভৌমত্ব, সেটাই তো গণতন্ত্র!’’
শ্রী কৌটিল্য চুপ করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘‘ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন রাজাকে জনপ্রিয় হওয়ার প্রয়োজন নেই। রাজাকে দেশ শাসন করার জন্য কঠোর হতে হবে। নির্দয় হতে হবে। ক্ষমতায় থাকার জন্য তাকে অসৎ পথ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমার অর্থশাস্ত্রে কৌশলের কথা বলা হলেও চাণক্যর ন্যায়শাস্ত্রও আছে। সেখানে রাজধর্মে নৈতিকতার কথাও তো বলা হয়েছে।’’
এই যে এনডি টিভি চ্যানেলের প্রদর্শন এক দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ। এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে সরকার বাধ্য হলেও মূল প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, সেটা হল মোদী সরকারের মানসিকতা! এ ভাবে গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো কি রাজধর্ম?
সমস্যা হচ্ছে, আজকাল সাংবাদিকদেরও ভূমিকা প্রশ্নাতীত নয়। যেন সাংবাদিককে গায়ে একটা জার্সি দিতেই হবে। হয় তুমি বিজেপি না হয় তুমি কংগ্রেস। তোমাকে মোদী-বিরোধী হতে হবে আর তা না হলে তুমি মোদী-ভক্ত। কেন এক একটা ইস্যুতে আমি এক এক রকমের অবস্থান নিতে পারি না? ভাল কাজ করলে ভাল বলব, খারাপ কাজ করলে বলব তুমি খারাপ।
ম্যাকবেথের শাসনাধীন স্কটল্যান্ডের কথা মনে করুন পাঠক। শাসকের চরিত্র একই। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি হল। সেই ঘোর অমানিশায় কী ভয়াবহ সেন্সর ব্যবস্থা। তবু সেই দুঃসময়ে নাট্যকার নির্দেশক উৎপল দত্ত শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে ফিরে যান। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস-নিষেধাজ্ঞা-কারারোধে নিপীড়িত ভারতের সঙ্গে স্কটল্যান্ডের সেই শাসনের ভাবনায় কী অদ্ভুত ভাবে অনুষঙ্গ হয়। সংগ্রাম হয় গণতন্ত্রকামী ভাবনায়। ম্যাকবেথ বলেছিল, “ দাসখতে বাঁধব নিয়তিকে!” কিন্তু তা কি হয়? বার বার সবশেষে জয় হয় মানুষের। মোদী গত দু’বছরে অনেক বেশি ব্যস্ত তাঁর অপটিকস নিয়ে। নানা ইভেন্টে তাঁকে ঠিক কেমন লাগছে জনগণের সামনে সেই পারসেপশনই যেন আজ সবচেয়ে বড় সত্য।
কিন্তু প্লেটোবাবু বলে উঠলেন, ‘‘ওহে বালকের দল, আমরা গুহার ভিতর ছায়া দেখে তাকে সত্য বলি। কিন্তু সে তো ছায়া। সে তো অবভাস। সে কথা তো সেই কবে আমিই বলেছিলাম। কিন্তু আজ আমিও এ কথা মানছি যে দার্শনিক রাজার কথা বলেছিলাম আজকের বাস্তবের পটভূমিতে সেই দার্শনিক রাজাকে অবাস্তব মনে হতে পারে। আমার রাজা আজ তাই যেন এক প্রতীক। আমার রাজা যেন সমস্ত শুভ, সমস্ত মঙ্গলবোধের বিমূর্ত রূপ। আমি কোনও দিন কৌটিল্যের মতো কৌশল করে রাজ্যলাভ ও তাকে রক্ষা করার কথা বলিনি। আজও মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদী যদি সফল হন তবে সেটা তাঁর কৃতকর্মে, তাঁর তৈরি করা মিডিয়া-পারসেপশনে নয়, অপটিকস অবভাস, সত্য নয়।’’
কৌটিল্য: ‘‘কালের ব্যবধান মশাই। সেটা ভুললে চলবে কী করে! আপনি বলেছেন, রাষ্ট্র আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। আমি তো রাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্গতি গড়ে তোলার কথা বলেছি। আমার সময়ে ভারতবর্ষ অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। মূলত তারই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় সেই ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে একত্রিত করে একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠন করে এক কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনা সম্ভব হল। তখন এই রাষ্ট্রকে আর্যাবর্ত বলা হত। তবে যে হিংসা ও হত্যার কথা আমি বলেছি তা কিন্তু মূলত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এবং খুবই বিশেষ ক্ষেত্রে। সাধারণ নাগরিক জীবনে ম্যাকিয়াভেলি ধর্মকে নস্যাৎ করে দিলেও আমি তা করিনি। ব্রিটিশ যুগে, এমনকী মোগল শাসনেও আমার অর্থশাস্ত্রের কদর দেওয়া হয়নি, তবু বলব আজও আমার গ্রন্থেই আছে ভারতের নিজস্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপর গড়ে ওঠা রাষ্ট্রনীতি।’’
জয়ন্ত: নরেন্দ্র মোদী অবশ্য অতীতকে, বিশেষত ভারতীয় ঐতিহ্যকে বার বার স্মরণ করেন।
কৌটিল্যবাবু এবং প্লেটোবাবু দু’জনেই গণতন্ত্রকে নৈরাজ্য বলে মনে করলেও সেই একনায়কতন্ত্রের দিনেও মানুষের ইচ্ছাই যে শেষ কথা বলে তা স্বীকার করেছিলেন। আজকের সরকারকেও মনে রাখতে হবে যে কৌটিল্য বলেছিলেন, ‘প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়হিতম/নাত্মাপ্রিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়হিতম।’
‘প্রজার সুখ উপস্থিত হইলেই রাজার সুখ হয় এবং প্রজার হিত হইলেই রাজার সুখ হয় এবং প্রজার হিত হইলেই তাহা রাজার হিত বলে বিবেচ্য। যাহা রাজার নিজের প্রিয় বলে বিবেচ্য, তাহা তাঁহার হিত নহে, কিন্তু প্রজাবর্গের যাহা প্রিয়, সেটাই রাজার হিত।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy