Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

পোকায় কাটা

আন্দোলনের নামে গুরুঙ্গরা সেই অর্থনীতির বহু ক্ষতি করিয়াছেন। আরও করিতেছেন। তাঁহাদের সাম্প্রতিক বন্‌ধ-এ মার খাইতেছে চা শিল্প। যখন সেকেন্ড ফ্লাশ চা বাজারজাত হওয়ার কথা, ঠিক তখনই চা শিল্প স্তব্ধ।

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

মহম্মদ আলি জিন্নাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিলেন, এই পোকায় কাটা পাকিস্তান লইয়া আমি কী করিব? তাঁহার তবু একটি সান্ত্বনা ছিল— তিনি যাহা পাইয়াছিলেন, তাহা স্বসৃষ্ট নহে, সিরিল র‌্যাডক্লিফ নামক এক ব্রিটিশ আইনজীবীর ছুরির ডগায় তৈরি। বিমল গুরুঙ্গরা যে সলিলে, অথবা খানায়, ডুবিতেছেন, তাহা স্বখাত। পৃথক গোর্খাল্যান্ড তৈরি হউক অথবা না হউক, দার্জিলিং নামক জনপদটি থাকিবে, সেখানকার মানুষরাও থাকিবেন। বাঁচিয়া থাকিতে হইলে জল এবং অক্সিজেনের পরেই যাহার গুরুত্ব, তাহার নাম অর্থনীতি। আন্দোলনের নামে গুরুঙ্গরা সেই অর্থনীতির বহু ক্ষতি করিয়াছেন। আরও করিতেছেন। তাঁহাদের সাম্প্রতিক বন্‌ধ-এ মার খাইতেছে চা শিল্প। যখন সেকেন্ড ফ্লাশ চা বাজারজাত হওয়ার কথা, ঠিক তখনই চা শিল্প স্তব্ধ। এই একটি উদাহরণ বলিয়া দেয়, সাধারণ মানুষের জীবন হইতে তাঁহাদের রাজনীতি ঠিক কতখানি বিচ্ছিন্ন হইয়াছে। ভারতের, এমনকী বাংলার অর্থনীতিতেও দার্জিলিং চা আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ নহে। কিন্তু, পাহাড়ের জন্য এই শিল্পের গুরুত্ব বিপুল। বিশ্ববাজারে দার্জিলিং চায়ের চাহিদা প্রবল। এবং, এই চায়ের জুড়ি নাই। ফলে, শুধুমাত্র এই শিল্পটির প্রতি যথেষ্ট যত্নবান হইলেই পাহাড়ের— এবং তাঁহাদের কল্পিত গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের— অর্থনীতির ছবিটি বদলাইতে পারিত। চা-বাগানকে কেন্দ্র করিয়াও সদর্থক রাজনীতি সম্ভব। বাগানের শ্রমিকরা যে ভাবে বাঁচেন, তাহাকে বাঁচিয়া থাকা বলে না। গোর্খাল্যান্ড যদি তৈরিও হয়, এই মানুষগুলির অবস্থা ফিরিবে কি? না কি, রাজনীতির দ্বন্দ্বে অসহায় বোড়ে হওয়াই তাঁহাদের নিয়তি?

জেলার অর্থনীতি দাঁড়াইয়া আছে মূলত চা শিল্প এবং পর্যটনের উপর। কারণ, বিবিধ কারণে কৃষি একে অনুৎপাদনশীল, তাহার উপর কৃষি-উদ্বৃত্তকে বাজারজাত করা দুষ্কর। ফলে, দীর্ঘমেয়াদে কৃষির দিকে নজর ফেরানো যেমন জরুরি, তেমনই মূল দুইটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের প্রতি যত্নবান হওয়াও জরুরি। এই ক্ষেত্র দুইটিই জেলার কর্মসংস্থানের বৃহত্তম উৎস। ক্ষেত্রগুলিতে শ্রমিকদের অবস্থার উন্নয়ন অবশ্যই রাজনৈতিক দাবি হইবে, কিন্তু তাহার পূর্বে ক্ষেত্রগুলির জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা প্রয়োজন। গোড়ায় প্রয়োজন স্থিতির নিশ্চয়তা। রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকিলে ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে যেমন তাহার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, চা শিল্পের ক্ষেত্রেও পড়িতেছে। জোগানের নিশ্চয়তা না থাকিলে এক সময় চাহিদাও মরিয়া যায়। বাজার বিকল্প খুঁজিয়া লয়। দার্জিলিং চা সেই বিপদের মুখে দাঁড়াইয়া আছে। পাহাড়ের এই সম্পদটি তুলনাহীন— কিন্তু, এক বার বাজার চলিয়া গেলে তাহার আর দাম থাকিবে না। বিমল গুরুঙ্গরা নিজেদের রাজনীতির এই আত্মঘাতী পরিমাণ কি দেখিতে পাইতেছেন না?

দার্জিলিঙের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ছিল। শিক্ষা। কার্সিয়াং হইতে দার্জিলিং অবধি বেশ কিছু স্কুলকলেজ এক কালে উত্তর-পূর্ব ভারতের অগ্রগণ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় পড়িত। সমতল হইতেও অনেকেই সন্তানকে সেই স্কুলে পাঠাইতেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই সম্পদটিকেও ধ্বংস করিতেছে। খাবারের অভাবে অসহায় যে স্কুলপড়ুয়ারা কোনও মতে শিলিগুড়িতে নামিয়া আসিল, তাহাদের মুখ বলিতেছে, শিক্ষা-শিল্পের যেটুকু বাঁচিয়া ছিল, মোর্চার রাজনীতি তাহাকেও শেষ করিল। তবে আর প়ড়িয়া থাকিল কী? রাজনৈতিক ক্ষমতা যদি আন্দোলনের কারিগররা অর্জন করেনও, অর্থনীতির ভিত না থাকিলে সেই ক্ষমতার মাহাত্ম্য কী? যে রাজনীতি মানুষের পাতে খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারে না, তাহাকে সদর্থক রাজনীতি বলিবার কোনও কারণ নাই। বিপন্ন বিপর্যস্ত হতাশ্বাস অর্থনীতি লইয়া গুরুঙ্গরা কী করিবেন?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE