গ্রাফিক: সন্দীপন রুইদাস।
মেয়েকে কলেজে পড়ানোর খরচ মেটাতে পারছি না। প্রথম লকডাউনের পর থেকেই কাজ নেই। এটি লিঙ্কডইনের একটি সাম্প্রতিক পোস্ট।
লিঙ্কডইন পেশাদারদের যোগাযোগের সামাজিক মাধ্যম। এখানে সবাই পেশা নিয়েই কথা বলেন। তার মধ্যে এ রকম আর্তি এর আগে কখনও চোখে পড়েনি। আর আর্তির উৎস যে মানুষটি তিনি কিন্তু তাঁর কাজের ক্ষেত্রে আদৃত। তবুও তাঁর কোনও কাজ নেই শুধু নয়, তিনি আর্থিক ক্ষমতার সীমায় পৌঁছে গিয়েছেন।
এই সব অসহায়তার ছবিই কিন্তু পরিসংখ্যানের অর্থ আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে দিতে থাকে। যে মানুষটির কাছ থেকে এই অসহায় আবেদনটি এসেছে তিনি একজন সফল উপদেষ্টা। কিন্তু তাঁর কোনও কাজ নেই। তার মানে তিনি অদক্ষ নন। কিন্তু ব্যবসার যা হাল, তাতে সংস্থাগুলি ক্রমাগত খরচ কমিয়ে আপাতত টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আর ব্যবসার অঙ্কে তাই বলি হচ্ছেন প্রয়োজনীয় কিন্তু সীমান্তবর্তী সহযোগীরাই।
তার মানে কি প্রত্যক্ষ কর্মীদের পেটে টান পড়ছে না? ভারতে আর্থিক ক্ষেত্রের একটা বড় অংশই ক্ষুদ্র আর অতি ক্ষুদ্র সংস্থার হাতে। আর এই সব সংস্থার অনেকেই কোভিডের প্রথম ঢেউয়ে ঝাঁপ বন্ধ রাখলেও কর্মীদের বেতন দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে। কিন্তু প্রথম ঢেউয়ের ধাক্কা সামলানোর আগেই দ্বিতীয় ঢেউ এদের একটা বড় অংশকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। কারখানা চলছে কিন্তু দোকান বন্ধ। যাঁদের নিজেদের দোকান আছে বিভিন্ন মলে তাঁরা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। কোটি কোটি টাকা যাচ্ছে এ সব দোকানের রক্ষণাবেক্ষণে, কিন্তু আয়ের ঘর শূন্য। গত বছরের জন্য করা বর্ষাতি লাট ধরে ফেলে দিতে হচ্ছে। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য তৈরি ব্যাগ-সহ নানান সরঞ্জামের ভাগ্যও একই।
তবে অনেকের কাছেই এখন মৃতদেহ ভরার ব্যাগই বাঁচার রাস্তা! গতবার যেমন টিঁকিয়ে দেয়েছিল পিপিই। যাঁরা মৃত্যুতেও বাঁচার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না, তাঁরা ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন। বাড়ছে বেকার ও দরিদ্রের সংখ্যা। পিউ রিসার্চ সেন্টারের পরিসংখ্যান বলছে ২০২০ সালে বিশ্ব জুড়ে বর্ধিত দরিদ্রের সংখ্যার ৬০ শতাংশই ভারতের অবদান। এ বারের অঙ্ক এখনও হাতে আসেনি।
কিন্তু সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি-র (সিএমআইই) পরিসংখ্যান বলছে ১৬ মে-তে যে সপ্তাহ শেষ হয়েছে সেই সপ্তাহে বেকারিত্ব বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪.৪৫ শতাংশে। গত বছর প্রায় একই সময়ে (৯ মে) এই হার ছিল ৮.৬৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য এই পরিসংখ্যান মানতে নারাজ। চারিদিকের নীতি পঙ্গুত্বের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিরোধ স্বাভাবিক।
পাশাপাশি, প্রথম ঢেউয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বিতর্কিত হলেও ব্যবসা বাঁচাতে কিছু ত্রাণের কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু এ বার তো শ্মশানের স্তব্ধতা! এরই পরিপ্রেক্ষিতে গোটা বিশ্বই কিন্তু ভারতকে নিয়ে চিন্তিত। কারণ ভারতের মতো এত বড় বাজার যদি একটুও টলে তা হলে তার কাঁপুনি বিশ্বের সকলেরই গায়ে কম বেশি লাগবে। তাই তাঁরা সবাই ভারতের নীতি পঙ্গুত্ব নিয়ে চিন্তিত। বাংলাদেশে যখন মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাপিয়ে গিয়েছে, তখনই কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মোড়কে প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের নীতি নির্ধারকদের ভাবনা নিয়েই। চলতি মাসের ৬ তারিখে অর্থ ভাণ্ডারের যোগাযোগ বিভাগের নির্দেশক, জেরি রাইস, সাংবাদিকদের কাছে ভারত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কোভিড মোকাবিলায় ভারতের নীতির উপর নজর রাখছেন তাঁরা। সুসংহত নীতিই ভারতকে কোভিডের ছোবল থেকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে। তাঁর ইঙ্গিত পরিষ্কার। ভারতের নীতি এই বিপদের মোকাবিলায় এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
তা যে হচ্ছে না তা তো স্পষ্ট বেসরকারি পরিসংখ্যানগুলো থেকেই। কেন্দ্রীয় সরকার বেকারির হার নিয়ে ন্যাশনাল সাম্পেল সার্ভের নিয়মিত পরিসংখ্যান নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক নানান তথ্য বলছে ভারতে দারিদ্র বাড়ছে, বাড়ছে আর্থিক বৈষম্য আর কোভিড তাতে ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। আর সেটাই কিন্তু ভয়ানক চিন্তার।
আরও চিন্তার কারণ গ্রামীণ অর্থনীতি। প্রথম ঢেউয়ে ভারতের গ্রাম বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু এ বার যে ভাবে কোভিড গ্রামাঞ্চলে ঢুকছে তাতেই কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ গভীর হতে শুরু করেছে। এ বারের ঢেউয়ে মৃত্যুর হার অত্যন্ত বেশি। ভারতের গড় উৎপাদনের ০.৩৬ শতাংশ হল স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে খরচ। যে পরিকাঠামো আছে তাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোভিডের মোকাবিলার উপযোগী কি না, তা নিয়ে সংশয় ও প্রশ্ন নতুন নয়। আর নতুন কোভিডে এই বর্ধিত মৃত্যুর হার ছোবল বসিয়েছে দেশের শ্রম শক্তির উপর। প্রথম ঢেউয়ের আঘাতটা মনে করা হয়েছিল বাজার খুললেই কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের অভিঘাত বলছে এই ক্ষত দীর্ঘকালীন। প্রথমবার বাজারের সমস্যা ছিল জোগানের। এই বার কিন্তু চাপ আসছে চাহিদার দিক থেকেই।
পরিসংখ্যান এখনও সেই ভাবে ছবিটা স্পষ্ট করেনি। কিন্তু বুড়ো আঙুলের অঙ্ক এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনাক্রম বলছে, যাঁরা কাজ ফিরে পেয়েছেন তাঁরা পুরনো আয় ফিরে পাননি। একে তো রোজগার কমার চাপ, তার উপর রয়েছে কোভিডের ভয়। তাই মানুষ খরচ কমাচ্ছেন, বাজারে চাহিদা কমছে। স্মার্ট ফোনের বাজারে মাত্র ১ শতাংশ বৃদ্ধি হবে বলে মনে করছে বিভিন্ন পরিসংখ্যান সংস্থা।
যে ভয়ানক জায়গাটি উঠে আসতে পারে, এবং যা নিয়ে এখনও কোনও পরিসংখ্যান সামনে আসেনি, তা হল অনাথ পরিবারের সংখ্যা। বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কোভিডের বলি হয়েছেন পরিবারকে অনাথ করে। শুধু পরিবার নয় তাঁর মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে কর্মীদের পেটের ভাতও। এই অভিঘাত কতটা তীব্র তা নিয়ে এখনও কেউ ভাবতে শুরু করেনি। আগামী দিনে যদি এই অভিঘাত মাপা হয়, তার পরিসর কিন্তু ব্যাপক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
আর চিন্তাটা এখানেই। নীতি নির্ধারকরা যতটা ব্যস্ত সমালোচনা এড়াতে, ঠিক ততটাই, আপাতদৃষ্টিতে, দ্বিধায় কোভিড মোকাবিলায় স্বচ্ছ পদক্ষেপে। নাহলে প্রথম ঢেউয়ের অভিজ্ঞতা, ও অন্যদেশের দ্বিতীয় ঢেউয়ের নিদর্শন সামনে থাকতেও আমরা কোভিড মোকাবিলার যুদ্ধে এত সহজেই হার মেনে নিলাম কী করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy