Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
জনসেবা থেকে রাজনীতি
CPIM

ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খোঁজা শুরু হোক জনপরিসরে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কথা শোনাটাও অভ্যাস করতে হবে।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২১ ০৬:৪৮
Share: Save:

রেড ভলান্টিয়ারদের সমাজসেবার কোনও সুফল সিপিআইএম বিধানসভার ভোটে পেল না, এই নিয়ে কিছু দিন ধরে নানা কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ল এক শতাব্দী আগের কথা। ১৯২০-র দশকে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী দেখিয়েছিলেন, সমাজসেবা সংগঠনের সেবাসমিতিগুলিও রাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ! তিনি হরিদ্বার কুম্ভে গিয়ে সেবাসমিতির কাজে সাহায্য করছেন, চম্পারণ এবং খেড়ায় সত্যাগ্রহের আগে সেবাসমিতিগুলিকেও তাঁর পাশে দাঁড়ানোর জন্য ডাক দিচ্ছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে পাবলিক পরিসর তখন তৈরি হচ্ছিল আর্যসমাজ, ইলাহাবাদ সেবাসমিতি, গোখলের ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া, টিলকের হোমরুল লিগ বা বা অ্যানি বেসান্তের থিয়োসফিকাল সোসাইটির মাধ্যমে। বিদেশি শাসক যখন দেশের লোকের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকার করার মতো সংস্কারটুকুও করতে নারাজ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ওই সেবাসমিতিই ছিল উপায়।

এই সেবাসমিতিগুলিই হিন্দি বলয়ে প্রথম জাতপাতের বেড়া ভাঙতে থাকে। বিশের দশকে সুলতানপুরের কায়স্থ রামচন্দ্র দারোয়ান ও চাপরাশির কাজ করেন, তাঁর উদ্যোগেই রায়বরেলীতে কৃষক বিদ্রোহ। তাঁর সেই বিদ্রোহে অন্যতম কমরেড কে? ইলাহাবাদের ব্রাহ্মণ, ছোট জোতদার পণ্ডিত ইন্দ্রনারায়ণ দ্বিবেদী। সেবাসমিতির হাত ধরেই গোড়ার দিকে গাঁধী-নেহরুরা সবচেয়ে বড় ধর্মীয় বিভাজনটি ভেঙেছিলেন। ১৯১৫ সালের হরিদ্বার কুম্ভ। সেখানে ইলাহাবাদ সেবাসমিতি ও সার্ভেন্টস অব ইন্ডিয়া সোসাইটি একযোগে আঞ্জুমান-ই-ইসলামিয়ার মতো সংগঠনকে ইউনানি চিকিৎসালয় খোলার ডাক দিল। কিন্তু সেবাসমিতি, ইসলামি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীদের পোশাক আলাদা। কারও স্বস্তিক আঁকা ব্যাজ, কারও বা চাঁদ-তারা। পতাকাও আলাদা। হিন্দুর কুম্ভমেলার তাঁবুতে চাঁদ-তারা আঁকা ইসলামি পতাকা উড়বে? গাঁধীর ছোট্ট পরামর্শ, ‘দুটো পতাকা পাশাপাশি থাকুক। ক্ষতি কী?’ পথ চলতে চলতে এই আলাদা প্রতীকও উড়ে গেল। কয়েক বছর পর তরুণ জওহরলাল নেহরু ও কামালউদ্দিন জাফরির উদ্যোগে ইলাহাবাদে তৈরি হল ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার কোর। তাঁদের পরনে চাঁদ-তারা, স্বস্তিক, কোনও বিশেষ ধর্মীয় চিহ্ন থাকল না। সকলের মাথায় গাঁধী টুপি। তার এক দিকে ইসলামের সবুজ, অন্য দিকে হিন্দুর গেরুয়া রং। স্বাধীন ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু জিন্না ও পাকিস্তানের বিরোধিতার জন্য সৃষ্টি হয়নি। তার পিছনে ছিল গাঁধী, নেহরুদের সেবাসমিতিতে যুক্ত থাকার ইতিহাসও।

কোভিড পরিস্থিতিতে ‘আত্মনির্ভর’ কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থ অনুপস্থিতিতে সেই সেবাসমিতি আবার ফিরে এল। এঁদের মধ্যে সিপিএমের রেড ভলান্টিয়ারদের সক্রিয়তা উল্লেখ্য। খবর, এঁদের সংখ্যা ইতিমধ্যে ৮০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞ রোগীর আত্মীয়েরা অনেকে ধন্যবাদ পোস্ট করছেন। কিন্তু ওই যে মহাকবি কালিদাস বলে গিয়েছিলেন, লোকের রুচি ভিন্ন। অতএব কেউ কেউ হাসছেন— তা হলে ওরা রাস্তাতেই থাকুক! স্বেচ্ছাসেবকরাও অনেকে অভিমানভরে সমাজমাধ্যমে জানাচ্ছেন, মন্ত্রী বা জনপ্রতিনিধিরা না থাকলেও, ভোটের অনুপাত যৎসামান্য হলেও, আমরা আছি। নিশ্চয়ই। হাসিতামাশা, মান-অভিমান যা-ই হোক না কেন, অতিমারি পরিস্থিতিতে স্বেচ্ছাসেবকদের এই ভাবেই থাকতে হবে। রাতবিরেতে পোস্ট আসে, নৈহাটিতে অক্সিজেন লাগবে। বালিগঞ্জ ঘুমচোখে মোবাইলে সেটা দেখে টিটাগড়, কাঁকিনাড়াকে ট্যাগ করে। কেউ কাউকে বিশেষ চেনে না, একদা এসএফআই সম্মেলনে এক সঙ্গে চা, সিগারেট খাওয়া হয়েছিল এমন নয়। স্বেচ্ছাসেবীরাই ভেঙে দিয়েছেন গ্রাম-শহর, জাতপাত, ধর্মের, এমনকি দলের ব্যবধান। অতিমারির মধ্যেও মুসলিমরা ইদের নমাজ সেরেই হিন্দু প্রতিবেশীর মৃতদেহ ঘাড়ে নিয়ে সৎকারে ছোটেন। ভলান্টিয়াররা বিপক্ষের কোভিড-আক্রান্ত নেতার বাড়িতে অক্সিজেন, খাবার পৌঁছে দেন, লাল রঙের শরিক না হয়েও এই সব পোস্ট দেখে মন্ত্রীর কন্যা অসুস্থের জন্য হাসপাতাল খুঁজে বার করেন।

এটা বাংলার ঐতিহ্যে আছে। স্বামী বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী সঙ্ঘ গড়ে প্লেগ মহামারিতে লোকের সেবা করেন। তাঁর বিশ্বাস, এই মানুষগুলি অনন্ত শক্তির আধার, স্বয়ং ব্রহ্ম। সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শী সন্ন্যাসী অহংবর্জিত। তিনি বলেন, “অন্যকে আহত না করে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারি না, আমাদের খাবারের প্রতিটি গ্রাসই অন্যের থেকে নেওয়া।” সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী মানুষের জন্য কাজ করবেন, কিন্তু ‘সাহায্য করছি’ এই ভাবনা মনে ঠাঁই দেওয়া যাবে না। কর্মযোগের কথায় বলেন: বি গ্রেটফুল টু দ্য ম্যান ইউ হেল্প। যে মানুষকে সাহায্য করছ, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থেকো। অতিমারিতেও যিনি সেন্ট্রাল ভিস্টার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকেন, তিনি আর যা-ই হোক, বিবেকানন্দের কানাকড়িও বোঝেননি।

ভুললে চলবে না দেবী চৌধুরানিকেও। দেবী ডাকাতি করে, কিন্তু নিজের সুখের জন্য নয়। সে নিষ্কাম কর্মে বিশ্বাসী, ডাকাতির ধন দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। নিষ্কাম কর্ম কী? বঙ্কিম তাঁর ধর্ম্মতত্ত্বে বিশদ বুঝিয়েছেন, “কর্ম্মের ফলার্থী হইও না।... তোমার যত দূর কর্ত্তব্য, তাহা করিবে। তাতে তোমার কর্ম্ম সিদ্ধ হয় আর নাই হয়, তুল্য জ্ঞান করিবে। দেশোদ্ধার তোমার অনুষ্ঠেয়, চৌর্য্যবৃত্তি নহে।” বাঙালির সেবাধর্মের ধারণা আজকের নয়।

রেড ভলান্টিয়াররা বাম রাজনীতির সমর্থক। কিন্তু রাজনীতি তো শুধু সংসদ, জনপ্রতিনিধিত্ব, গণতন্ত্র, পার্টি ইত্যাদি কাঠামোতে গড়ে ওঠে না। তার রীতি, প্রকরণ সমাজ থেকে উঠে আসে। এবং সেখানে সব রকম কর্মীই থাকে। আলোর নীচে অন্ধকারও। সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী উপন্যাসে জেলে বসে অগস্ট আন্দোলনের কর্মী, কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির বিলু আন্দোলনের দিনগুলির কথা ভাবে, “মনে পড়িল আর্থকোয়েক রিলিফ কমিটির কথা। কংগ্রেস ভলান্টিয়ার বিরিঞ্চি মধুসূদন সিং-এর নিকট হইতে পাঁচ টাকা ঘুষ লইয়া তাহার কামতে কূপটি তৈয়ারি করাইয়া দিবার কথা দেয়।” ধর্মনিরপেক্ষতা, পঞ্চশীল নীতি না বুঝেও, স্বাধীন ভারতে বড় জমিদার আর জোতদারদের দল কংগ্রেসকে যে গ্রাম-ভারত হাত উজাড় করে ভোট দিত, তার পিছনেও এই স্বেচ্ছাসেবীদের অবদান।

১৯৪৩-এর মন্বন্তরে জনসেবায় বড় ভূমিকা নিল কমিউনিস্ট পার্টি। গাঁধী ও অগস্ট আন্দোলনের বিরোধিতা করে যারা দেশদ্রোহী হিসেবে নাম কিনেছে, তারাই ফুড কমিটি তৈরি করে কলোবাজারি ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করল, গণবণ্টন ব্যবস্থার দাবি তুলল। এই প্রতিরোধী ফুড কমিটিগুলি জনচেতনা বাড়াতে কাজ করল। একটা গ্রামে সবাই জনযুদ্ধের স্লোগানে বিশ্বাসী পার্টি ক্যাডার, এমন নয়, তবু মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হারানের নাতজামাই’ গল্পের শেষে পুলিশ জোতদারকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে বিপ্লবীদের ধরতে এসে দেখে, কাতারে কাতারে মানুষের মিছিল। “মানুষের সমুদ্রের, ঝড়ের উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে লড়া যায় না।”

বাকি থাকে আন্দোলনকে রাজনৈতিক দিশা দেওয়া। সবাইকে টিকা দেওয়া, গরিবদের বিনামূল্যে রেশন, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি। জনপরিসরে এই স্বেচ্ছাসেবকরাই রাজনীতিকে নতুন দিশা দেখাবেন। এই জায়গাটা সবচেয়ে গুরুত্বের। নির্বাচনে সবাই কি বাঙালি বনাম বহিরাগত আখ্যানে ভেসে গিয়ে ভোট দিয়েছেন? অভিজ্ঞতায় বলতে পারি। পরিচিত বাম প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলাম, তিনি হেরে গিয়েছেন। তবু দুঃখ হল না। কারণ, তার কয়েক মাস আগে থেকে জনপরিসরে আর একটি উদ্যোগকে সমর্থন করছিলাম। নো ভোট টু বিজেপি! উনিশ শতকের সেবাসমিতির মতোই পাবলিক পরিসরে এক নমনীয় সংগঠন। তৃণমূল, সিপিএম যাকেই ভোট দাও, বিজেপিকে নয়! কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা এ নিয়ে অনেকে অনুযোগও করেছেন, ভোট টু সিপিএম নয় কেন! শুনে মনে মনে হেসেছি। একই সঙ্গে যে হারব জেনেও এলাকার কমিউনিস্ট প্রার্থীকে ভোট দেওয়া যায় এবং নো ভোট টু বিজেপি করা যায়, এই বহু-পরিচিতিতে সিপিএম এখনও বিশ্বাসী নয়। রেড ভলান্টিয়ারেরা কিন্তু সেই বহু-পরিচিতিকে মর্যাদা দিচ্ছেন। এখানেই বুঝি উজ্জ্বল উদ্ধার। উপর থেকে নীচে চারিয়ে দেওয়া লোকাল কমিটি, জ়োনাল কমিটির পার্টিতন্ত্রের বাইরে এই জনপরিসরে।

আর একটা কথা। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কথা শোনাটাও অভ্যাস করতে হবে। সিপিএম অনেক দিন লোকের কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছে। তার ঘুরে দাঁড়ানোর পথ নিয়ে তর্কবিতর্ক এ বার তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের জনপরিসর থেকেই শুরু হোক না কেন!

অন্য বিষয়গুলি:

CPIM COVID-19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy