Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
বিজ্ঞান? এই সমাজে?
science

গণপরিসরে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করবে, সে রাজনীতি কোথায়?

সত্য ঘটনা অবলম্বনে নাটক ইনহেরিট দ্য উইন্ড। কাহিনির প্রয়োজনে ঘটনা এখানে কিঞ্চিৎ কল্পনাশ্রয়ী। যেমন, জন টমাস স্কোপস এখানে বারট্রাম কেটস।

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২১ ০৪:৪২
Share: Save:

নাটকের নাম অ-পবিত্র। পবিত্র শব্দটির আগে অ উপসর্গ যোগে। সে ক্ষেত্রে শব্দটা সোজাসুজি অপবিত্র হতে পারত। ‘নাট্য আনন’ গোষ্ঠীর চন্দন সেন উপসর্গটিকে আলাদা করে চিহ্নিত করেছেন জোর দিয়ে বোঝানোর জন্য। নাটক আসলে জেরোম লরেন্স এবং রবার্ট এডওয়ার্ড লি রচিত ইনহেরিট দ্য উইন্ড-এর ভাবানুবাদ। কিছু কথা বলতে হয় মূল নাটক নিয়ে। আখ্যান বিখ্যাত স্কোপস ট্রায়াল নিয়ে। যাকে বলা হয় ‘ট্রায়াল অব দ্য সেঞ্চুরি’। হ্যাঁ, সে বিচার সত্যিই বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাততম মামলাগুলোর অন্যতম। ধর্ম বনাম বিজ্ঞানের এক যুদ্ধ। ১৯২৫ সালে আমেরিকার টেনেসি প্রদেশে আইন চালু হয় যে, বাইবেলে বর্ণিত মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব ভিন্ন আর কিছু স্কুল-কলেজে পড়ানো যাবে না। ও দিকে, স্কুল টিচার জন টমাস স্কোপস ছাত্রদের পড়াচ্ছেন চার্লস রবার্ট ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব। রাজ্যের আইন (পড়ুন বাইবেল) মানেন না সামান্য এক শিক্ষক। এত স্পর্ধা! অগত্যা, আদালত।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে নাটক ইনহেরিট দ্য উইন্ড। কাহিনির প্রয়োজনে ঘটনা এখানে কিঞ্চিৎ কল্পনাশ্রয়ী। যেমন, জন টমাস স্কোপস এখানে বারট্রাম কেটস। উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান, যিনি আদালতে বাইবেলের পক্ষে লড়াই করেন, সেই তিন-তিন বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মানুষটি এখানে ম্যাথিউ হ্যারিসন ব্র্যাডি। স্কোপসের উকিল ক্ল্যারেন্স ড্যারো এখানে হেনরি ড্রামন্ড। বালটিমোর সান কাগজের রিপোর্টার এইচ এল মেনকেন, যাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ঝগড়ার সংবাদ পরিবেশন করে কাগজের বিক্রি বাড়ানো, তিনি এখানে ই কে হর্নবেক। আর দুই চরিত্র নাটকে নতুন করে আমদানি, লরেন্স এবং লি-কল্পনাপ্রসূত। পাদ্রি জেরেমিয়া ব্রাউন এবং তাঁর কন্যা রেচেল ব্রাউন। জেরেমিয়া বাইবেল বুকে আঁকড়ে ধরেন বলে কেটস-এর প্রতিপক্ষ। আর, রেচেল কেটস-এর প্রেমিকা বলে পিতৃ-আজ্ঞাবলে তাঁকে পরিত্যাগে অক্ষম।

প্রথমে ব্রডওয়ে নাটক থেকে শুরু করে পরে টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের পর্দায়, কত জায়গায় যে ইনহেরিট দ্য উইন্ড (ছবিতে একটি দৃশ্য) অভিনীত হয়েছে। অভিনয় করেছেন বহু দিকপাল অভিনেতা। জর্জ স্কট, জ্যাক লেসন, টনি রেন্ডাল, স্পেন্সার ট্রেসি, কার্ক ডগলাস, জিন কেলি, পল মুনি, এড বেগলি প্রমুখ। ট্রেসি আর কেলি অভিনীত দু’ঘণ্টার সাদা-কালো ছবিটি প্রথম দেখানো হয় বিমানযাত্রা কালে। অ-পবিত্র নাটকে অভিনয় করেছেন ভদ্রা বসু, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং চন্দন সেন।

‘নাট্য আনন’-এর কলাকুশলীদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। শিবরাত্রির সলতের মতো একটা নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজনার ক্ষেত্রে বেছে নিয়েছে বিজ্ঞানকে। হোক না তা এই একমাত্রিক অনুধাবনের অনুসারী যে— বিজ্ঞান সাদা আর ধর্ম কালো। যেমন অনেক বাঙালির স্মৃতিতে শম্ভু মিত্র অভিনীত গালিলেও। ইটালীয় বিজ্ঞানী যেন সত্যের ধ্বজাধারী, আলোকবর্তিকা। নাট্যকার বারটোল্ট ব্রেখট যে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারি শাসন শুধু দেখেননি, দেখেছিলেন স্তালিনিজ়ম—এবং হিরোশিমা, রবার্ট ওপেনহাইমারের বিচার ইত্যাদি— তা এ পোড়া দেশে ক’জন দর্শক জানেন? ক’জন জানেন যে, ব্রেখট-এর এই নতুন নতুন দেখায় পরিবর্তিত হয়েছিল গালিলেও-র মূল্যায়ন? ইনকুইজ়িশনের সামনে নতজানু গালিলেও হিরো না ভিলেন, তা জিজ্ঞাসে কোন দর্শক? বিজ্ঞান যে সরলরৈখিক বিষয় নয়, তার পরতে পরতে যে জটিলতা, তা বোঝার মতো এ সময় নয়। এখন শুধু চটুলতা আর ইতরামির উপাসনা। বিজ্ঞান অসচেতনতার ঔদাসীন্যের যুগে যা হয়েই থাকে।

এক্সপেরিমেন্ট আবশ্যক? তা হয়ে যাক। দেখি চলে কি না চলে কোপেনহাগেন নাটক? উপজীব্য এক সাক্ষাৎ। ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহাগেন শহরে জার্মান ছাত্র ভার্নার হাইজ়েনবার্গ দেখা করতে এসেছেন গুরু বিজ্ঞানী নিলস বোর-এর সঙ্গে। তখন জার্মানি যুদ্ধে জিতছে। ডেনমার্ক পদানত। এমতাবস্থায় কী নিয়ে কথা বলেছিলেন দুই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী? আমেরিকা-ইংল্যান্ড অ্যাটম বোমা বানাচ্ছে কি না, তা কি বোর-এর কাছে জানতে এসেছিলেন হাইজ়েনবার্গ? না কি বলতে এসেছিলেন এই কথাটা যে, হিটলারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও জার্মান বিজ্ঞানীরা বানাচ্ছেন না অ্যাটম বোমা, সুতরাং, বোরও যাতে আমেরিকা-ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দেন মারণাস্ত্র না বানাতে? ঠিক উত্তর কেউ জানে না। ওঁদের কথোপকথন রহস্যাবৃত। লেখক মাইকেল ফ্রেন ওই রহস্য নিয়ে ফেঁদেছেন নাটক কোপেনহাগেন। মানুষের অভিপ্রায় দেবা ন জানন্তি গোছের ব্যাপার। ইউরোপ আমেরিকায় যেমন সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলেছে কোপেনহাগেন, কলকাতায় চলবে তেমন? মনে হয় না। চলতে গেলে যে বাতাবরণ চাই, তা আজকের পশ্চিমবঙ্গে কোথায়? বিগ বেন-এর অনুকরণে রাস্তায় ঘড়ি বসিয়ে কলকাতাকে লন্ডন বানানো যায় না।

একটা রাজনৈতিক দল ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গকে শাসন করেছিল। বিজ্ঞান মঞ্চ নামে তার একটা শাখাও ছিল। থাকলে কী হবে, সেই দল আবার একের পর এক ভোট-বৈতরণি পার হওয়ার জন্য সমানে নিম্নমেধার চাষ করে গিয়েছে। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়েও মৌলবাদকে ভয় পায়, ভয় পেয়ে এক লেখিকার কলকাতায় প্রত্যাবর্তন রোধে ব্যবস্থা করে, সে রাজনৈতিক দলকে চেনা হয়ে যায়। যে দল মুসলমান-প্রধান এলাকায় এক জন হিন্দু ভোটপ্রার্থীকে দাঁড় করাতে সাহস পায় না, তার মানসিক দৈন্য ধরা পড়ে। আসলে, গণতন্ত্রে ভোট বড় দায়। সব উদ্যোগ, আয়োজন তার জন্য। বিজ্ঞান যে যুক্তিবোধ বা উঁচু চিন্তা দাবি করে, তার জন্য সময় কোথায়!

এখন বিজ্ঞানের জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অপবিজ্ঞান। গোমূত্রে সোনা আবিষ্কার! একে আর কী বা বলা যায়? লোকগাথায় পুষ্পক রথের বর্ণনা নাকি প্রাচীন ভারতে এরোডিনোমিক্সের জ্ঞানের উদাহরণ। এ ভাবে ভাবা নাকি দেশপ্রেম! আলবার্ট আইনস্টাইন জার্মান জাতীয়তাবাদকে ঘৃণা করতেন অকৃত্রিম বন্ধু ও নোবেলজয়ী ফ্রিৎজ় হেবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিষ গ্যাস আবিষ্কার করায়। আইনস্টাইনের কাছে কট্টর জাতীয়তাবাদ ছিল এক চিকিৎসাতীত অসুখ। বিজ্ঞানীদের মধ্যে ফাদারল্যান্ডের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ দেখে তাই তিনি শিহরিত হয়েছিলেন। এ দেশে এখন দেশপ্রেমে মাতোয়ারা মানুষের অভাব নেই।

বিজ্ঞান গুরুত্ব না পেলে বিজ্ঞানীও গুরুত্ব পান না। তাঁদের মতামতের মূল্য দেওয়া হয় না। উল্টে সরকার-বিরোধী নীতি নিলে বিজ্ঞানীদের উপর নেমে আসে খাঁড়া। দু’বছর আগে দেশের বিজ্ঞানীরা কেন্দ্রের শাসক দলের নেতামন্ত্রীদের বিভিন্ন ফোরামে অবৈজ্ঞানিক ঘোষণার প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। ফল ভাল হয়নি। পালের গোদা বিজ্ঞানীদের খুঁজে খুঁজে সরকারি অনুদান ছাঁটাইয়ের হুমকি দেওয়া হয়।

অবিমৃশ্যকারিতার ফল হাতেনাতে। বিশ্ব জুড়ে এখন অতিমারি। ভারতে ফণা তুলেছে কোভিড-১৯’এর দ্বিতীয় ঢেউ। দৈনিক সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা তিন লক্ষের উপর। দৈনিক মৃত্যুহার চার হাজারের এ দিক-ও দিক। এর মাঝে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন হয়ে গেল। রাজনৈতিক নেতাদের মুখে শুনে আমরা ধন্য হলাম যে, ভোট নাকি গণতন্ত্রের উৎসব। সে উৎসবে হাজারে-লাখে মানুষ জমায়েত হলেন। ছবিতে দেখলাম, প্রায় কারও মুখে মাস্ক নেই। হয়তো তাঁদের মাস্ক কেনার পয়সা নেই। অথবা নেই সচেতনতা। একা রামে রক্ষে নেই, তায় সুগ্রীব দোসর! একে ভোট উৎসব, তার উপরে আবার মকরস্নান, কুম্ভস্নান-এর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান। নিষেধ করে কার সাধ্য! নির্বাচনী সভা, রোড শো কেন বন্ধ হবে? বিজ্ঞানে উদাসীন না হলে, এমনটা হতে পারে না। বিজ্ঞানের বিখ্যাত জার্নাল নেচার সম্প্রতি এক সম্পাদকীয়তে তুলোধুনা করেছে ভারতীয় প্রশাসনকে। নির্বাচনী প্রচারসভা এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ না করার জন্য। নেচার আর নিন্দা করেছে ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর। যিনি অতিমারিকে হালকা ভাবে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ও তো এক ধরনের জ্বর।

ফিরে আসি অ-পবিত্র প্রসঙ্গে। নাট্যপত্রে পরিচালক চন্দন সেন উদ্ধৃত করেছেন দার্শনিক রেনে দেকার্ত-এর উক্তি। ‘আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই একজ়িস্ট।’ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বার বার বলেন, বাংলা নাকি রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু, তাঁর দলের নেতামন্ত্রীরা উঠতে-বসতে চিন্তকদের ব্যঙ্গ বা উপহাস করেন। রবীন্দ্রনাথ চিন্তক ছাড়া আর কী?

অন্য বিষয়গুলি:

science Religion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy