করোনাভাইরাস সঙ্কটে প্রতিটি দেশ যেন দুটি বিকল্পের সামনে দাঁড়িয়েছে, জনস্বাস্থ্য না কি অর্থনীতি? যেহেতু এটা গোটা বিশ্বের স্বাস্থ্যসঙ্কট, তাই যত দিন না স্বাস্থ্যের সঙ্কট কাটবে, এবং মানুষের মন থেকে ভয় দূর হবে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না। যদি ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি শেষ হওয়ার, বা অন্তত কমার আগেই অর্থনীতিকে খুলে দেওয়া হয়, তা হলে তার ফল কী হতে পারে, বোঝাই যায়। নতুন করে যদি সংক্রমণ ছড়ায়, সেই আতঙ্কে মানুষের আস্থা একেবারে চলে যাবে। বাজারে মন্দা আরও বাড়বে, আরও মানুষ কাজ হারাবে। এই জন্য এই সঙ্কটের জনস্বাস্থ্যের দিকটাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। অত্যন্ত জরুরি কিছু পরিষেবা বাদে সব অর্থনৈতিক কাজকর্ম বন্ধ রাখতে হবে।
অন্য দিকে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা মানে জরুরি পণ্যে টান, কাজ থেকে ছাঁটাই, ব্যবসার ঝাঁপ বন্ধ, যার ফলে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে না-পারার ঝুঁকিতে পড়বেন লক্ষ লক্ষ মানুষ— যাঁরা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বা হতে পারেন, হয়তো তাঁদের থেকে অনেক বেশি লোক। অতএব এই সঙ্কটের জনস্বাস্থ্যের দিক আর অর্থনীতির দিক, এ দুটোর সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। এ দুটোকে আলাদা করা যায় না বলেই, আগে জনস্বাস্থ্য না কি আগে অর্থনীতি, এই উত্তর খুঁজে লাভ নেই। এগোনোর একমাত্র উপায় সমস্যার দুটি দিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটা স্পষ্ট ধরতে পারা, এবং তার ভিত্তিতে সমাধানের খোঁজ করা।
যে সব দেশ তুলনায় ধনী, যেখানে বৈষম্য চরম নয়, তাদের ক্ষেত্রেও জনস্বাস্থ্য আর অর্থনীতির সঙ্কট পরস্পর সংযুক্ত। আর যে সব দেশে রোজগার কম, বৈষম্য বেশি, সেখানে এই সংযোগ আরও ঘনিষ্ঠ।
যদিও সংক্রমণের ঝুঁকি সমাজের সব স্তরেই, সাধারণত কম আয়ের মানুষদের ক্ষেত্রে তা বেশি, কারণ খারাপ স্বাস্থ্য আর চিকিৎসার অভাবে তাঁদের শরীরে নানা রোগ বাসা বেঁধেই থাকে। এটা সব দেশেই সত্যি, তবে ভারতে আরও বেশি, কারণ এখানে জনসংখ্যার তুলনায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল, এবং দেশবাসীর একটা বড় অংশ অপুষ্টি, অচিকিৎসার ধার ঘেঁষে কোনও মতে বেঁচে থাকেন। জনসংখ্যার ঘনত্ব যদি বেশি হয়, বিশেষত শহরগুলোতে যদি অধিক সংখ্যায় দরিদ্র মানুষ থাকেন যাঁদের কোনও বাঁধাধরা আয় নেই, পরিচ্ছন্নতার বিধি মানার উপায় নেই, তা হলে লকডাউন জারি করে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং-এর নিয়ম চাপানো দুঃসাধ্য, এমনকি অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে বেড়ে যায় সংক্রমণের ঝুঁকি। ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে রোগ ছড়াতে শুরু করলে চিকিৎসাব্যবস্থার উপর বিরাট চাপ তৈরি হতে বাধ্য।
অতএব সংক্রমণ যদি একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সঙ্কটকে আরও অতিকায় করে তুলবে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চাপ বাড়বে। একই সঙ্গে, ভারতে কর্মীদের ৯০ শতাংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করার ফলে তাদের যথেষ্ট সঞ্চয় বা নিয়মিত আয় নেই, তাই অর্থনৈতিক মন্দার আঘাত খুব তীব্র হবে। সংক্রমণের ফলে মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে অনাহারে মৃত্যু, কিংবা অন্যান্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতা এই সমস্যাকে আরও গভীর করবে। এই ভাবে সঙ্কটের জনস্বাস্থ্যের দিক এবং অর্থনীতির দিক একটা অন্যটাকে গভীর করতে থাকবে।
আপাতত কোভিড-১৯-এর চিকিৎসার তিনটি পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে। এক, টিকা বা ভ্যাকসিন তৈরি। দুই, ভাইরাসের মোকাবিলা করতে পারে এমন নতুন ওষুধ তৈরি। তিন, যে সব ওষুধ এখন অন্য অসুখের মোকাবিলায় ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলোর ব্যবহার। এর মধ্যে টিকা তৈরিই সবচেয়ে কার্যকর, কিন্তু তাতে ১২-১৮ মাস সময় লাগবে। এ ছাড়া সেরে-ওঠা রোগীদের দেহ থেকে অ্যান্টিবডি নিয়ে আক্রান্তদের চিকিৎসার চেষ্টাও চলছে। এই অ্যান্টিবডি থাকা মানে রোগের প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, অতএব তার ব্যবহার ব্যাপক পরীক্ষায় বিনিয়োগ করলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে রোগের বিস্তার কমানোর সব চাইতে কার্যকর উপায় হল চলাফেরা কমানো এবং একে অন্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। এই ভাইরাস এত দ্রুত ছড়ায় যে এক একটা অঞ্চল এক এক বার বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও এক ধরনের নীতি নিতে হবে। যে কোনও দেশে সেই নীতিকে জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিতে হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তথ্যভিত্তিক, বৈজ্ঞানিক বিবেচনার দ্বারা চালিত এবং অর্থনৈতিক কর্তব্যের দ্বারা নির্ধারিত।
আরও পড়ুন: মহামারি, রাজধর্ম ও প্রজাকল্যাণ
আশ্চর্য এই যে, ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা এখনও বেশ কম। হতে পারে রিপোর্ট হচ্ছে কম, কিংবা হয়তো এর প্রতিরোধের কৌশল কাজে দিয়েছে, কিংবা হয়তো আবহাওয়াগত কারণে (গরম, আর্দ্রতা— যদিও এর সঠিক প্রমাণ এখনও মেলেনি) ভাইরাস ছড়াচ্ছে কম। আর একটি ভীতিপ্রদ সম্ভাবনা হল, সংক্রমণের শীর্ষ সময়বিন্দু হয়তো এখনও আসেনি। হয়তো আরও পরে আসবে। যাঁরা আক্রান্ত হবেন, তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই হয়তো রোগের তীব্রতা বেশি হবে না। তবু যখন সংক্রমণ শীর্ষে উঠবে, তখন একই সঙ্গে বহু মানুষ সংক্রমিত হতে পারেন। যদি মোট জনসংখ্যার দশ শতাংশের রোগলক্ষণ থাকে, আর তাঁদের অর্ধেকেরও যদি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হয়, সেই বাড়তি চাহিদা চিকিৎসাব্যবস্থাকে বিপন্ন করতেই পারে। পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে যদি সংক্রমণ ছড়ায় গ্রামে, যেখানে স্বাভাবিক সময়েই চিকিৎসার ব্যবস্থা তত ভাল নয়।
অবশ্যই দূরত্ব বজায় রাখা, মুখোশ আর দস্তানা পরা, বার বার হাত ধোওয়ার মতো পদ্ধতি ব্যাপক ভাবে মেনে চললে সংক্রমণের সংখ্যা অনেকটাই কমানো যাবে। কিন্তু ঘন জনবসতি এলাকায় এই পদ্ধতিগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা কঠিন হবে কি না, সেটা এখনও বোঝা মুশকিল। সেখানে জনস্বাস্থ্যের শিক্ষাও সুলভ নয়, গ্রাম বা শহরতলিতে দূরত্ব বজায় রাখার মতো পরিকাঠামোও তৈরি নেই। হয়তো বিপুল সংখ্যায় মুখোশ আর দস্তানা বিলি করাটা সংক্রমণ কমানোর অনেক বাস্তবোচিত উপায় হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য আর অর্থনীতির এই ঘনিষ্ঠ সংযোগের কথা মাথায় রেখে সমাধান খুঁজতে গেলে মনে হয়, অবিলম্বে যা করা উচিত, তা হল— লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণ প্রতিরোধ, এবং সেই সঙ্গে (সংক্রমণ আছে কি না বুঝতে, এবং সেরে ওঠার হার বুঝতে) জোরের সঙ্গে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া, যাতে ধাপে ধাপে, এক একটি অংশে লকডাউন শিথিল করা যায়। যে কর্মীরা রোগীদের সংস্পর্শে এসে কাজ করছেন, তাঁদের পরীক্ষা প্রথমেই প্রয়োজন।
যদি দেখা যায় তাঁদের দেহে ভাইরাস নেই, বা প্রতিরোধ তৈরি হয়ে গিয়েছে, তা হলে তাঁরা কাজে ফিরে যেতে পারেন। অর্থনীতির দৃষ্টিতে কর্তব্য হল খাদ্য ও জ্বালানির জোগান দেওয়া, বেঁচে থাকার জন্য যা একান্ত প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কিছু নগদ টাকা ও জীবনধারণের জন্যে আবশ্যক অন্যান্য কিছু সামগ্রীও দিতে হবে।
এগুলো না দিলে লকডাউন নিশ্চিত করা কঠিন, এমনকি অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে, যেহেতু অনাহারে মৃত্যু একটা বাস্তব সম্ভাবনা হয়ে উঠছে। আবার রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাগুলো ঠিকঠাক না নিলে সংক্রমণ এমন পর্যায়ে চলে যাবে যে অর্থনৈতিক সহায়তার প্যাকেজ দেওয়া অবাস্তব, অসম্ভব হয়ে পড়বে।
আনন্দলাল রায়, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, ওয়াশিংটন ডিসি।
মৈত্রীশ ঘটক, অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy