ধরিয়া লওয়া যাউক, দমদম স্টেশনের মারমুখী প্রৌঢ়রা কেহ হতাশার শিকার ছিলেন না। দুই তরুণ সহযাত্রীর ঘনিষ্ঠতা তাঁহাদের বিন্দুমাত্র ঈর্ষান্বিত করে নাই। ধরিয়া লওয়া যাউক, মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ যাহাকে ‘কলিকাতার সংস্কৃতি’ বলিয়াছে, সেই নিরালম্ব বায়ুভূত বস্তুটির অপূরণীয় ক্ষতি দেখিয়াই তাঁহারা চটিয়া উঠিয়াছিলেন। ধরিয়া লওয়া যাউক, সেই দুই তরুণ-তরুণীর ঘনিষ্ঠতায় সত্যই সহযাত্রীদের ভাবাবেগে আঘাত লাগিতেছিল, এমনকী অসুবিধাও হইতেছিল। এবং, হয়তো এই ঘটনা মাত্র এক দিনের নহে, প্রায়শই এমন ঘনিষ্ঠ-যুগলের উপস্থিতিতে সহযাত্রীরা অসুবিধায় পড়িয়া থাকেন। অর্থাৎ, দমদম স্টেশনে যুগল-যাত্রীর উপর চড়াও হইবার পক্ষে যতগুলি যুক্তি হাওয়ায় ভাসিয়া বেড়াইতেছে, তর্কের খাতিরে তাহার প্রতিটির সত্যতা এবং ন্যায্যতা স্বীকার করিয়া লওয়া গেল। অতঃপর প্রশ্ন, তাহার পরও কি কোনও ভাবে এই আক্রমণকে ‘বৈধ’ বলা চলে, তাহাকে মানিয়া লওয়া চলে? নির্বিকল্প উত্তর: না। দমদম স্টেশনে যাহা হইয়াছে, তাহা বর্বরতা। মানুষের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। একটিমাত্র যুক্তিতেই তাহাকে সমর্থন করা সম্ভব। সেই যুক্তি গো-সন্ত্রাসীদের যুক্তি। মহম্মদ আখলাক বা পেহলু খানের হত্যাকারীরা যে যুক্তি ব্যবহার করে, প্যারিসে শার্লি এবদো-র দফতরে হামলাকারীরা যে যুক্তি দেয়, কেবল তাহাই দমদমের মারমুখী জনতার পার্শ্বে দাঁড়াইবে। সেই যুক্তি বলে, যাহা আমার নিকট অগ্রহণযোগ্য, তাহার অস্তিত্ব থাকিতে পারে না। সেই অস্তিত্ব মুছিয়া দেওয়ার জন্য যাহা করণীয়, সবই ন্যায্য। এই যুক্তি মৌলবাদের। সভ্য সমাজ এই যুক্তিকে স্বীকার করিতে পারে না।
প্রকাশ্যে যুবকযুবতীর ঘনিষ্ঠতা দেখিতে অনভ্যস্ত চোখে তাহা দৃষ্টিকটু ঠেকিতেই পারে। রুচির অধিকার ব্যক্তিগত, কাজেই প্রকাশ্য রাস্তায় কোনও মেয়ের শ্লীলতাহানি দেখিয়াও যাঁহার চিত্ত বিচলিত হয় না, এই ঘনিষ্ঠতা যদি তাঁহার নিকট অগ্রহণযোগ্য ঠেকে, সেই আপত্তিও তাঁহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কিন্তু এই নীতি-অন্ত-প্রাণ নাগরিকদের সেই পরিচিত বাণীটি মনে রাখা দরকার: নিজ মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। তাঁহারা এতখানি ঘনিষ্ঠ না হইবার অনুরোধ করিতে পারেন, সেই অনুরোধ লঙ্ঘিত হইলে কর্তৃপক্ষের নিকট নালিশ ঠুকিতে পারেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উজাড় করিয়া দিতে পারেন, এমনকী সত্যাগ্রহও করিতে পারেন। প্রতিটি কাজই গণতন্ত্রে স্বীকৃত, এবং সমাজের স্বাস্থ্যের পক্ষে ইতিবাচক। কিন্তু, আপত্তি আছে বলিয়াই গায়ের জোরে সেই ঘনিষ্ঠতা বন্ধ করাইয়া দিবেন, অথবা মেয়েদের বোরখা পরিতে বাধ্য করিবেন, বা ভিন ধর্মের প্রণয়ী যুগলকে হত্যা করিবেন— সভ্য সমাজে এই গা-জোয়ারি চলিতে পারে না। আপত্তির এই প্রয়োগ সংবিধানদত্ত জীবনের অধিকারের, ভাবপ্রকাশের অধিকারের পরিপন্থী।
মেট্রোর জেঠামহাশয়রা এতখানি তলাইয়া ভাবেন নাই বলিয়াই সন্দেহ হয়। বর্তমান ভারত তাঁহাদের শিখাইয়াছে, সংখ্যার জোর থাকিলে সব কিছুই করা চলে। মানুষের যে কোনও অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যায়, যে কোনও ‘শাস্তি’র বিধান দেওয়া যায়। প্রেক্ষাগৃহে জাতীয় সঙ্গীত চলাকালীন কেহ উঠিয়া না দাঁড়ানোয় যাহারা ‘শাস্তি’ দিয়াছিল, ট্রেনে গোমাংস বহনের সন্দেহে যাহারা একটি পঞ্চদশ বর্ষীয় কিশোরকে প্রাণে মারিয়া ফেলিয়াছিল, ভিন জাতে প্রণয় করায় যে খাপ পঞ্চায়েত প্রাণদণ্ড দিয়াছিল— এই ভারতে তাহাদের কাহারও শাস্তি হয় নাই। জাতির স্বঘোষিত অভিভাবকরা শিখিয়া লইয়াছেন, সমষ্টির জোর থাকিলে ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকার লঙ্ঘন করাই যায়। মেট্রোর ঘটনাটিকে এই বৃহত্তর প্রেক্ষিতে দেখাই বিধেয়। বর্বরতার গায়ে সনাতন সংস্কৃতির নামাবলি চাপাইয়া দিলেই যে আর ভয় নাই, কথাটি কলিকাতাও শিখিয়া লইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy