শপথ: রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও নবনিযুক্ত মুখ্য তথ্য কমিশনার সুধীর ভার্গব
স্বাধীনতার পর আটান্ন বছর যে ক্ষমতা ছিল কেবল সাংসদ আর বিধায়কদের হাতে, ২০০৫ সালে তা পেলেন সব নাগরিক। তথ্যের অধিকার আইনের জোরে এখন যে কেউ সরকারকে প্রায় যে কোনও প্রশ্ন করতে পারেন। প্রতিরক্ষার মতো কয়েকটি বিষয় ছাড়া আর সব বিষয়ে নাগরিককে উত্তর দিতে বাধ্য সরকার। পঞ্চায়েত প্রধান থেকে প্রধান বিচারপতি, থানার পুলিশ থেকে রাষ্ট্রপতি, সকলেই এই আইনের অধীনে। উত্তর না দিলে জরিমানা থেকে বরখাস্ত, সবই করতে পারে তথ্য কমিশন।
ভারতের মতো দেশে মন্ত্রী কিংবা আধিকারিকরা স্বচ্ছতাকে স্লোগান করেই রাখতে চান। রাজ্যে রাজ্যে তথ্য কমিশন তৈরি হল, কিন্তু কমিশনার কোথায়? আইনত মুখ্য তথ্য কমিশনার ছাড়া আরও দশ জন পর্যন্ত কমিশনার নিয়োগ করতে পারে রাজ্যগুলি। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্যে আছেন দুই কী তিন জন। তা ছাড়াও শূন্য থাকে বহু পদ। প্রতি বছর তথ্য জানতে ষাট লক্ষ আবেদন জমা পড়ে সারা দেশে।
২০১৮-র মার্চে মোট তথ্য কমিশনারের সংখ্যা ছিল ১০৯। কিন্তু খুঁড়িয়ে-চলা কমিশনেও সন্তুষ্ট নন নেতা-মন্ত্রীরা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তথ্যের অধিকার আইনে একটি সংশোধনের প্রস্তাব এনেছে, সংসদে পাশ হলে যা তথ্যের অধিকার কমিশনের স্বাতন্ত্র্যের গোড়ায় কুঠারাঘাত করবে।
তথ্যের অধিকার আইন বলছে, তথ্য কমিশনারদের কাজের মেয়াদ পাঁচ বছর, বয়সের ঊর্ধ্বসীমা ৬৫। অর্থাৎ বয়স ৬৫ না পেরোলে, অথবা পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পূর্ণ না হলে, তথ্য কমিশনারকে সরানো যাবে না। আইনে আরও বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের ক্ষেত্রে মুখ্য তথ্য কমিশনারের বেতন হবে মুখ্য নির্বাচনী কমিশনারের সমান, অন্য তথ্য কমিশনারদের বেতন নির্বাচনী কমিশনারদের সমান। রাজ্য তথ্য কমিশনের ক্ষেত্রে মুখ্য কমিশনারের বেতন হবে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনারদের সমান। অন্য কমিশনারদের বেতন রাজ্যের মুখ্য সচিবের সমান। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার যাতে অপছন্দের ব্যক্তিকে সরাতে বা বঞ্চিত করতে না পারে, যাতে কমিশনাররা নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন, তার জন্যই আইনে এই ব্যবস্থা।
কেন্দ্র সেই রক্ষাকবচ উপড়ে ফেলতে চায়। সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, তথ্য কমিশনাররা ‘নিয়োগের দিন থেকে পাঁচ বছর পদে বহাল থাকবেন’— আইনের এ অংশটি বদলে করা হবে, ‘তত দিন থাকবেন যত দিন কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট করবে (ফর সাচ টার্ম অ্যাজ় মে বি প্রেসক্রাইবড বাই দ্য সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট)।’ একই ভাবে, তথ্য কমিশনারদের বেতন ও ভাতা নির্বাচন কমিশনারদের সমান করার আইনি নির্দেশ বাতিল করে প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, ‘‘মুখ্য তথ্য কমিশনার এবং অন্য তথ্য কমিশনারদের বেতন ও ভাতা, এবং তাঁদের কাজের অন্যান্য শর্ত হবে তা-ই যা কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট করবে।’’ কেবল কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের সদস্যদের কাজের শর্তাবলি, মেয়াদ ও পারিশ্রমিক যে কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারণ করবে, তা-ই নয়। রাজ্য তথ্য কমিশনারদের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তই কাজ করবে। মন্দের ভাল, ছাড় পেয়েছেন বর্তমানে কর্মরত তথ্য কমিশনাররা।
কেন এই সংশোধন? প্রস্তাবের ‘উদ্দেশ্য ও যুক্তি’ ব্যাখ্যা করে সরকার বলছে, নির্বাচন কমিশন তৈরি হয়েছে সংবিধানের ধারা মেনে, আর তথ্য কমিশন তৈরি হয়েছে সংসদে পাশ-করা আইনের ধারা মেনে— দুইয়ের মর্যাদা এক হতে পারে না। আর কমিশনারদের বেতন কিংবা মেয়াদ কী হবে, সেটা সংসদের বিবেচনার বিষয়ই নয়, ওটা প্রশাসনের খুঁটিনাটি ব্যাপার (‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ডিটেলস’)।
এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি উঠেছে। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের অন্যতম সদস্য শ্রীধর আচার্যালু অন্য কমিশনারদের কাছে চিঠি লিখে আবেদন করেছেন, সকলে একযোগে এই প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি তোলা হোক, কারণ তা তথ্যের অধিকার আইনের উদ্দেশ্যই নস্যাৎ করে দিচ্ছে। আচার্যালুর আপত্তি দু’টি। এক, বেতনের অঙ্ক ও কাজের মেয়াদ অনিশ্চিত রেখে, তা নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে, তথ্য কমিশনগুলির স্বাতন্ত্র্য কমজোরি করছে কেন্দ্রীয় সরকার। দুই, রাজ্য তথ্য কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়ে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকেও আঘাত করছে কেন্দ্র।
তথ্যের অধিকার আন্দোলনে যুক্ত সংগঠনগুলির মতে, মোদী সরকারের এই প্রস্তাব ষড়যন্ত্রের নামান্তর। ২০১৮-র এপ্রিল থেকে এই সংশোধনী প্রস্তাবের কপি চাইছেন তাঁরা, কিন্তু কোনও সাড়া পাচ্ছেন না। লোকসভায় এক লিখিত প্রশ্নের উত্তরে ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ এই সংশোধনী প্রস্তাবের কথা স্বীকার করেন।
অথচ ২০১৪ সালে কেন্দ্র এই নীতি নেয় যে, কোনও খসড়া আইন সংসদে পেশ করার আগে অন্তত ত্রিশ দিনের জন্য জনগণের কাছে পেশ করতে হবে মতামত জানতে চেয়ে। সেই সব মতের সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে। এ ক্ষেত্রে তা আজ পর্যন্ত করা হয়নি। লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনের শুরু থেকেই আন্দোলনকারীরা প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে চলেছেন।
তথ্যের অধিকার আইন পরিবর্তনের এ হল তৃতীয় সরকারি প্রচেষ্টা। ২০০৬ সালে কেন্দ্র প্রস্তাব করে, সরকারি ফাইলে মন্ত্রী-আধিকারিকদের হাতে-লেখা মন্তব্য (‘ফাইল নোটিং’) তথ্যের অধিকার আইনের বাইরে রাখা হোক। জনমতের চাপে তা পেশ হতেই পারেনি। ২০১৩ সালে প্রস্তাব হয়, রাজনৈতিক দলগুলিকে তথ্যের অধিকার আইনের বাইরে রাখা হোক। নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রতিবাদে সেই প্রস্তাবও সংসদে ওঠেনি।
লক্ষণীয়, মোদী সরকার কোনও বিশেষ পদাধিকারী বা প্রতিষ্ঠানকে আইন থেকে আড়াল করার পথে হাঁটেনি, আইনটাকেই কার্যত নস্যাৎ করতে উদ্যোগী হয়েছে। চুপিসারে যে প্রস্তাব পেশ হয়েছে, তার প্রতিরোধে যথেষ্ট শোরগোল না হলে মস্ত বিপদ হতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy