ফাইল চিত্র।
শিশুকন্যার প্রতি যৌন নির্যাতনের যে সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞা দিয়াছে বম্বে হাইকোর্ট, তাহাতে হতবাক গোটা ভারতবর্ষ। শিশুর পোশাকের উপর দিয়া তাহাকে স্পর্শ করিলে, অথবা তাহাকে যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করিলে, সেই দুষ্কার্য ‘যৌন নিগ্রহ নহে’— নাগপুর বেঞ্চের বিচারপতি পুষ্পা গনেড়িওয়ালা দুইটি মামলায় এমনই রায় দিয়াছেন। আইনের ব্যাখ্যার সহিত ন্যায়বিচারের এমন সংঘাত— বিরলের মধ্যেও বিরলতম! একটি রায় ইতিমধ্যেই স্থগিত করিয়াছে সুপ্রিম কোর্ট। অপরটিও শীর্ষ আদালতে পুনরায় বিবেচিত হইবে, তাহার সম্ভাবনা যথেষ্ট। দুই লাঞ্ছিতা নাবালিকার সুবিচার মিলিবে, অপরাধী শাস্তি পাইবে, দেশবাসী সেই আশা পরিত্যাগ করে নাই। কিন্তু ইহাতেই ঘটনা শেষ হইতে পারে না। ওই দুইটি রায়ের অভিঘাত ভারতের বিচারব্যবস্থার ইতিহাস হইতে মিলাইবে না। বিচারবিভাগের উপরে মানুষের আস্থা একটি ভিত্তিপ্রস্তর, যাহার উপরে দাঁড়াইয়া থাকে গোটা সমাজ। যাহার বিত্ত নাই, লোকবল নাই, প্রথাগত শিক্ষার জোর বা অর্থের সহায়-সম্বল কিছুই নাই, তাহার জন্যও থাকে পুলিশ এবং বিচারব্যবস্থা। সেখানে অভিযোগ করিলে, তাহার উপর অপরাধের সুবিচারের জন্য আবেদন করিলে, সুবিচার মেলে যে কোনও সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে। সমাজে যাহারা প্রান্তবাসী, তাহাদের ক্ষেত্রে এই ‘সুবিচার’ কেবল অপরাধীর শাস্তি নহে। দলিত বা মহিলাদের মর্যাদাহানিকে সনাতন সমাজ ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া দেখে। যে সকল আচরণের দ্বারা তাঁহাদের মনুষ্যত্বের নিত্য অবমাননা করা হয়, তাহাকে ‘অপরাধ’ বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিবার উদ্দেশ্যেই তাঁহারা আইনের বিচার প্রার্থনা করেন। মহিলা ও শিশুকন্যাদের প্রতি অশ্লীল, যৌন-ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ তাহার অন্যতম। কটূক্তি, কদর্য আচরণ দেহে চিহ্ন না রাখিলেও মর্মে আঘাত করে, কারণ তাহার স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তাটির অমর্যাদা করা হয়। বিচারবিভাগের প্রতি সম্মান জানাইয়াও প্রশ্ন থাকিয়া গেল, মানুষের এতখানি আস্থার মূল্য কি এই ভাবেই দিবার কথা? ইহাই কি সঙ্গত ও ন্যায্য বিচারের বাণী?
আইন যে তাহার আক্ষরিক অর্থ ধরিয়া চলে না, ভাবার্থ দিয়া তাহার প্রয়োগ নির্ণয় করিতে হয়, এই কথা কেহ অস্বীকার করেন না। কিন্তু সেই নির্ণয়ের কাজে বস্ত্রের আচ্ছাদন রহিল কি না, অঙ্গস্পর্শ ঘটিল কি না, তাহা কি অপমানের মাপকাঠি হইতে পারে? কুরুসভায় দুর্যোধন দ্রৌপদীকে লক্ষ করিয়া নিজের ঊরু প্রদর্শন করিয়াছিলেন। সেই ইঙ্গিতের অশ্লীলতা সে কাল হইতে এ কাল অবধি সকল পাঠককে আঘাত করিতেছে। ধর্ষণ-নিগ্রহের ইচ্ছার যে কোনও রূপ বাহ্যিক প্রকাশই অপরাধ। ভারতের বিবিধ আইনে কি সেই সত্যতার প্রতিফলন নাই?
আইনসভা আইন প্রণয়ন করে, আদালত তাহার প্রয়োগ করিয়া বিচার করে। সেই বিচারে আইনের যথার্থ ব্যাখ্যা হইল কি না, সে প্রশ্ন বার বার উঠিয়াছে। চার দশক পূর্বে মথুরা ধর্ষণ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় তাহার অন্যতম দৃষ্টান্ত। মহারাষ্ট্রে একটি থানার ভিতরে ষোলো বৎসরের একটি আদিবাসী কিশোরীর সহিত দুই পুলিশকর্মীর যৌনসংসর্গকে ‘ধর্ষণ’ বলিতে রাজি হন নাই শীর্ষ আদালতের দুই বিচারপতি, কারণ তাহার শরীরে ক্ষতচিহ্ন ছিল না। ইহার প্রতিবাদের জেরে ধর্ষণের আইনে পরিবর্তন হয়। অতঃপর নির্যাতন প্রতিরোধে নূতন আইন আসিয়াছে, অতীতের আইন সংস্কার হইয়াছে। নির্যাতিতা ও তাহাদের পরিবার আইনের বিচার পাইবার আশায় বহু ধৈর্য ধরিয়া, সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করিয়া আদালতের দ্বারে আসিয়াছেন। তাঁহাদের বিপন্নতা ধরা পড়িয়াছে আইনের ধারায়, এই বিশ্বাস লইয়া আসিয়াছেন। আদালত যখন তাঁহাদের অবমাননার যন্ত্রণাকে আইনের সীমার বাহিরে ঠেলিয়া দেয়, তখন আইন এবং বিচারব্যবস্থার উপরেই অবিশ্বাস জন্মাইবার উপক্রম হয়। দেশের জন্য ইহাপেক্ষা বড় সঙ্কট আর কী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy