এক ছাত্রীকে প্রশ্ন করছে তার বন্ধুরা। “তুই কি বাঙালি? না মুসলমান?” মেয়েটি উত্তর দেয়, “আমার বাবা বাংলাদেশি।” “আর তুই?” “বাবা বাংলাদেশের, আমরা তো এখানকার।” শীতের রোদে, মাঠে নিজেদের মধ্যে হাসি-হাসি কথা বলছে ওরা। কী ভাবছে কথা বলতে বলতে কে জানে।
রাজনীতি-সচেতন ছাত্রীটি চিন্তিত প্রশ্ন করে, বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে, অর্থনীতি ও উন্নয়নের কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ? বিশেষজ্ঞের লেখা এনে জানতে চায়, তাদের জানাটুকুর সঙ্গে মেলাতে চায়।
যে ছাত্রীটির নামের মধ্যে, পরিচয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু চিহ্ন আছে, কিছু একটা বলবে বলে সে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু বলার আগে চোখ থেকে বিষাদ উপচে যেতে চায়। “এই বার পরীক্ষা খুব ভাল হবে রিজ়ওয়ানা— মন খারাপ কোরো না। তোমার ভালর জন্যই হয়তো কেউ তোমায় একটু বকেছেন...।” কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তর আসে— “শুধু ওই জন্য বকছেন না ম্যাম, আমি তো অন্যদের থেকে আলাদা, তাই।”
খেলার মাঠে তো বেশ হাসি-হাসি মুখেই উত্তর দিচ্ছিল বন্ধুদের। এমন ব্যবহার করেছি আমরা, হয়তো অজানতে বা হয়তো অজানতে নয়, মেয়েটি বুঝতে পেরেছে সাম্প্রদায়িকতা কাকে বলে।
কোন তত্ত্ব, কোন ইতিহাস তাকে বোঝাবে, কেন শুধুমাত্র ধর্মীয় চিহ্নওয়ালা নামটি তাকে কত রকম বিদ্বেষের মুখোমুখি করে। হয়তো ছোটবেলা থেকেই করেছে, হয়তো আহত সে এখন বেশি করে, বা হয়তো তার সেই আঘাত অভ্যাস হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তো নানা মত, নানা তত্ত্ব। বিভেদেরও কি তত্ত্ব হয়, হতে পারে? আমি পাশে বসা ছাত্রীটির থেকে এর সঙ্গে পৃথক ব্যবহার করি, কোনও ব্যাখ্যা তত্ত্ব কি আমায় আড়াল করতে পারে?
বাংলাদেশ ঘুরে ফিরে আসে সব আলোচনায়। হিন্দুদের উপর আক্রমণ আলোচিত হয়। সেই প্রসঙ্গে সামনে আসে পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সংখ্যালঘু জনসংখ্যার কথা। কোথা থেকে আসে এই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যার কথা? জনসংখ্যার পরিমাপ করার নির্দিষ্ট পদ্ধতির কথা আমাদের জানা— সেনসাস। কিন্তু ভারতে জনগণনা হয়নি ২০১১ সালের পর থেকে। তা হলে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি বা জনসংখ্যার কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বৃদ্ধির কথা আমরা জানছি কী করে? নিশ্চয়ই কোনও না কোনও পরিসংখ্যান এই তথ্য জানাচ্ছে। আন্তর্জালে সমাজমাধ্যমে ভেসে আসছে সেই সব সংখ্যা, কখনও বা তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকছে অজ্ঞাত কোনও সমীক্ষা বা সংস্থার নাম। সেই তথ্য দেখাচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ছবি। সত্যিই কি তা-ই? পরিকল্পিত ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া ভুল তথ্যদের সম্পর্কে আমরা কম অবহিত নয়। আর সেই তথ্যদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়ে চলেছে, প্রতি দিন।
কোন দিকে নিয়ে যাবে আমাদের এই ইতিহাস? প্রতি বছর মেলায় বাংলাদেশি স্টলে জামদানি শাড়ি কেনার সঙ্গে আদানপ্রদান হয় আরও কত ভাল, না-ভাল লাগার গল্প। হয়তো শাড়িটি কেনা হয়, হয়তো হয় না। প্রতি বার নতুন করে আবার ফোন নম্বর, বার্তারা এ-পার ও-পার করে। এখন আর ফোন পাই না। আরও কিছু চেনাজানা নম্বর হঠাৎ করে অচল হয়ে গেছে।
আর অমিল হয়ে গেছে মনের কোণে থাকা অনেকখানি বিশ্বাসের জায়গা। নামেই প্রতিবেশী দেশ, আসলে বাংলাদেশ আমারই উঠোনের ও-পারে থাকা আর একটি ঘর, যেখানে ইতিহাস রেখে এসেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষ, যেখানে বন্ধুত্ব পাতিয়েছি দুই প্রজন্ম পেরিয়ে আমরা। দুই বাংলার লেখক গবেষকরা নিরন্তর যাতায়াত করেছেন, তাঁদের ভ্রমণকাহিনি স্মৃতিকথা পড়ে আমরাও উঠে বসেছি সেই স্মৃতির ছইয়ে। সেইখানে থেকে সাদা-কালো ছবিতে উঁকি দিয়ে গিয়েছেন পিতামহী। তিনি এ দেশের মানুষ ছিলেন, তবু বিবাহসূত্রে পাওয়া পরিবারের উৎস সন্ধানে গিয়েছিলেন সে দেশে, শ্বশুরবাড়ির দেশকে দুই হাত বাড়িয়ে আপন করে নিয়েছিলেন। সব ভুলে গেলাম আমরা? ধর্মের নামে ভাগাভাগি, হানাহানি জিতে গেল? যে বাংলাদেশ আমাদের এত হৃদয়ের কাছে ছিল, যে বাংলাদেশের ইলিশ না এলে আমাদের বর্ষাকাল মিথ্যে হয়ে যেত, ঢাকাই শাড়ি ঢাকাই বিরিয়ানির জন্য আমরা কিছু দিন আগেও উদ্বেল ছিলাম— সেই দেশ শুধু ‘মুসলমানের দেশ’ হয়ে গেল। ঢাকাই শাড়ি পুড়িয়ে কি বহ্ন্যুৎসব পালন করব আমরা?
ছেড়ে আসা বাড়ির উঠোনের গাছটার জন্য মন খারাপ করতেন যাঁরা, তাঁরা এমন করে মিথ্যে হয়ে গেলেন? ফিরে যাব না আর? সেই চেনা মাটির কাছে?
কোনও তথ্য, কোনও তত্ত্বের কাছে এর উত্তর নেই। আপনার, আমার কাছে আছে। দেরি হয়ে গেছে। আরও দেরি হওয়ার আগে, যদি হাত বাড়াই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy