সাংবাদিক হলে এ এক বড় সমস্যা। যেখানেই যাচ্ছি, একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি। ২০১৯ কী বুঝছেন? নরেন্দ্র মোদী কি আবার আসছেন? না কি তাঁর বিদায় আসন্ন? টিভি চ্যানেলের বিতর্কে অংশ নিলে তো সে আরও ভয়ংকর প্রশ্ন। আজ যদি ভোট হয়, নরেন্দ্র মোদী জিতবেন? না হারবেন? এক কথায় জবাব দিতে হবে।
আমি দুঃখিত। এক কথায় এ-প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। তবে এই জনপ্রিয় জিজ্ঞাসা সম্পর্কে আজ, আসুন, আলোচনা করি আপনাদের সঙ্গে। ২০১৯-এ কী হতে পারে তা আলোচনার আগে ২০১৪ সালে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে কিছু বক্তব্য আছে আমার।
২০১৪ সালে মোদী ২৮২টি আসন পেলেও বিজেপি শতকরা ভোট পায় মাত্র ৩১ ভাগ। ১৯৮০ সালে জনতা-পরীক্ষায় বিরক্ত হয়ে মানুষ যখন আবার কংগ্রেসকে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনে তখনও কিন্তু ৩৫১টি আসন পাওয়ার জন্য ইন্দিরা গাঁধীর কংগ্রেসকে ৪২.৬৯ ভাগ ভোট পেতে হয়েছিল। ১৯৭৭ এবং ১৯৮৯ সালে কংগ্রেস পরাস্ত হলেও সে-দিনও তাদের শতকরা ভোট ২০১৪ সালের বিজেপির চেয়ে বেশি ছিল। তা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে মোদী বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। কী ভাবে তা সম্ভব হয়েছিল?
আমার মনে হয়, ২০১৪ সালের ভোট ছিল মোদীর ভোট। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো। স্লোগান ছিল, অব কি বার মোদী সরকার। হর মোদী, ঘর ঘর মোদী। হর হর মহাদেব অনুকরণে তৈরি হয়েছিল এ স্লোগান। হিন্দু দেবতার প্রতি অন্ধভক্তির সঙ্গে মোদীর উপর আস্থা মিলে মিশে যায়।
২০১৪ সালের ভোটের ফলাফলে তাই এত কম শতকরা ভোট পেয়েও বিরোধী অনৈক্যের পটভূমিতে মোদী এক সুস্পষ্ট জনাদেশ লাভ করেন। ১৯৮৪ সালের পর, মানে প্রায় ৩০ বছর পর, এহেন সুস্পষ্ট রায় পেল কোনও শাসক দল। অন্য দিকে মনে করুন ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস, হেরে গেলেও, ১৫০টি আসন পেয়েছিল। ১৯৯৯ সালেও কংগ্রেস ১১৪টি আসন পায়। কিন্তু ২০১৪ সালে কংগ্রেস পেল ৪৪টি আসন। ১৯৭৭ সালের পর এই প্রথম কংগ্রেসের আসন সংখ্যা ১০০-র তলায় চলে গেল।
২০১৪ সালের শতকরা ভোটের নিরিখে তৃতীয় দল ছিল মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি। শতকরা ভোট ছিল ৪.১৪ ভাগ। কিন্তু এই দল ২০১৪ সালে একটি আসনও পায়নি। এর অর্থ কী? ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে-কোনও রাজনৈতিক দল একটা ন্যূনতম চৌকাঠ অতিক্রম করতে না পারা পর্যন্ত প্রাপ্ত শতকরা ভোট আসনে প্রতিফলিত হবে না। আর এরই পাশাপাশি ২০১৪ সালের ভোটে প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার এক অত্যাধুনিক বিপ্লব আনেন মোদী। তাও বোধহয় আমাদের দেশে আগে এ ভাবে কেউ করতে পারেননি।
এই পটভূমিতে এ বার আলোচনা করি ২০১৪-র সঙ্গে ২০১৯-এর তফাত কোথায় কোথায় হতে পারে? প্রথমত, ২০১৪ সালে যে বিরোধী ঐক্য সম্ভব হয়নি, ২০১৯-এ তা সম্ভব হতে পারে। যে ভাবে ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা এবং ১৯৮৯ সালে রাজীব প্রধান রাজনৈতিক শত্রু হয়ে ওঠেন বিরোধী পক্ষের সকলের কাছে, এ বার তা হতে পারে। যদি উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম-মায়াবতী একজোট হয়ে যান, এমনকী তৃণমূল এবং সিপিএম মোদী-বিরোধী যদি জাতীয় মঞ্চে শামিল হয়, তবে তাতে বিজেপির নিশ্চিত বিপদ। দ্বিতীয়ত, রাহুল গাঁধী দলের সভাপতি হওয়ার পর আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। ২০১৯-এর আগে তিনি যদি জোট রাজনীতির পথে হাঁটেন ও রাজ্যওয়ারি সমন্বয় সাধন করেন, তবে তা বিজেপির পক্ষে অশুভ।
২০১৪ সালের ভোটে মোদী ছিলেন স্বপ্নের সওদাগর। কিন্তু সেই প্রত্যাশা, সেই স্বপ্নের ভোটব্যাংক ২০১৪ সালেই অনেকটা নিঃশেষিত। এখন চার বছরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে আর্থিক পরিস্থিতিতে মানুষের অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান। বৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়ল। চাকরি নেই, বিনিয়োগ নেই। মূল্যবৃদ্ধি ভয়াবহ। এখন তো ব্যাংক ঋণ দেওয়া নিয়েও চলছে রাজনৈতিক নৈরাজ্য। রাহুল গাঁধী সরাসরি মোদীকে আক্রমণ হানছেন। নীরব মোদীর ব্যাংক লুটে ব্যক্তিগত ভাবে জড়িত না থাকলেও এটিকে শুধু ব্যাংক ব্যবস্থার বিপর্যয় বলে প্রচার করে মোদীর ভাবমূর্তিকে নিষ্কলঙ্ক রাখা কিন্তু ২০১৯-এর ভোটে সহজ কাজ নয়।
বহু রাজ্যেই আজ ক্ষমতায় বিজেপি। বিজেপির রাজনৈতিক ইতিহাসে এ যেমন একটা গর্বের বিষয়, ঠিক তেমনই ২০১৯-এর ভোটে রাজ্যে-রাজ্যে গদিয়ান বিজেপির বিরুদ্ধে অসন্তোষ মোদীর পক্ষে উদ্বেগের কারণ। ২০১৪ সালে ভোটের আগের রাজ্যগুলির পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি এক না। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, এমনকী উত্তরপ্রদেশেও স্থানীয় বিজেপির বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ, তা ‘মোদী’ নামক ব্যক্তির পক্ষে কতটা দূর করা সম্ভব হবে? ২০১৪ সালের সেই ‘মোদী-ঝড়’ তো নেই।
দিল্লি ও বিহারে দলের বিপর্যয়ের পর বিজেপির এক শীর্ষ নেতা আমাকে বলেছিলেন, আমাদের দেশে এক জন ব্যক্তি এক জন নেতার ছবি দেখিয়ে এক বার ভোট হয়, তার ছবি দেখিয়ে আর একটা লোকসভা ভোট করা কঠিন। যদি সে ব্যক্তি মনমোহন সিংহের মতো হন, তবে তা মন্দের ভাল, কিন্তু যে ব্যক্তি মানেই এক অতিনাটকীয় পপুলিজম, হাইপার প্রচার, তবে অ্যাকশন-রিপ্লে খুব কঠিন। অটলবিহারী বাজপেয়ী কম জনপ্রিয় ছিলেন না। কেউ ভাবতেও পারেননি, কিন্তু বাজপেয়ী সরকার, অতি নিশ্চিত হয়ে ভোট ছ’মাস এগিয়ে নিয়ে এসেও, পরাস্ত হয়েছিলেন।
২০১৪ মোদীর পক্ষে ছিল ‘ব্লু স্কাই সিনারিয়ো’। এই পরিস্থিতিতে অনেক অজানা অপ্রত্যাশিত ঘটনা হঠাৎই ঘটে এবং সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যায়। তার পর শুরু হয় ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগিতার খেলা। এই মুহূর্তে মোদীর জনপ্রিয়তা কতটা কমেছে তা নিয়েও বিতর্ক আছে। আগের চেয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় তৈরি হচ্ছে এক নতুন পটভূমি। কিন্তু ২০১৪ সালে যে ভাবে মনমোহন সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে ঝড় উঠেছিল, তা কি আজ দৃশ্যমান? হিন্দি বলয়ে সেই নেতিবাচক ঝড়ও কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।
এই কারণে মোদী-অমিত শাহও ২০১৯-এর জন্য নতুন কৌশলে ময়দানে অবতীর্ণ হচ্ছেন। সুশাসনের কথা মুখে বললেও বিজেপি হিন্দুত্বকে মূলধন করে সাবেকি মেরুকরণের রাজনীতি করবে। এই রাজনীতিকে সমর্থন করি না, কিন্তু যে দেশে আজও বহু মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পশ্চাৎমুখিতায় আক্রান্ত, সতীর মাহাত্ম্য প্রচারে ব্যস্ত, সে-দেশের সেই অচেতন ভিড়কে ভোটব্যাংক হিসাবে সঙ্গে পায় বিজেপি। এ বার ভোটেও মোদী প্রচারের প্রধান ছবি হলেও হিন্দুত্বের রাজনীতি প্রাধান্য পাবেই। উত্তরপ্রদেশে ব্যবহার করতে হবে যোগী আদিত্যনাথকে, রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে কোনও সমাধানের মরিয়া চেষ্টাও চলছে। কিন্তু এ-সবের পাশাপাশি প্রাধান্য দিতে হবে শরিক দলগুলিকেও। বিহারে ভাল করতে গেলে আজ নীতীশ কুমারকে বেশি আসন দিতে হবে। অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানার মতো রাজ্যে বিজেপি কোথায়? সব মিলিয়ে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে আসন কমার সম্ভাবনাই বেশি। আর এই কারণে কর্নাটকে বিধানসভা জেতাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে অমিত শাহের সামনে।
এখনও এক বছর বাকি। আমি এক জন নাগরিক হিসাবে কী চাই, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদীর সামনে কুসুমাস্তীর্ণ পথ নেই, সে কথা বিজেপিও জানে। কিন্তু তা বলে মোদী ২০১৯ সালে জিতবেন না, ক্ষমতাচ্যুত হবেন, এ কথাও বলা যায় না। আগামী এক বছরে মোদী-শাহের মতো স্ট্র্যাটেজিস্টরা কী কী কৌশল অবলম্বন করেন সেটা দেখার। আবার রাহুল গাঁধী এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের জোট, মোদী-বিরোধী নির্বাচনী ঐক্য তৈরিতে কতটা সফল হন, সেটাও দেখতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy