Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Narendra Modi

ভীতি বনাম প্রীতি

তীব্র মুসলিম-বিদ্বেষী বয়ানে ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকর লিখিয়াছিলেন, এই দেশে মুসলমানদের যদি থাকিতে হয়, তবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবেই থাকিতে হইবে।

নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২০ ০০:০৫
Share: Save:

ভয় বিনু হোই ন প্রীতি’, অর্থাৎ ভীতি জাগাইতে না পারিলে প্রীতিও পাওয়া যায় না— জানাইয়াছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই অযোধ্যায় দাঁড়াইয়া, যেখানে প্রায় পাঁচ শতাব্দী কাল প্রাচীন মসজিদের জমিতেই গড়িয়া উঠিতেছে রামমন্দির। মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল প্রচুর, কিন্তু তাহারও অধিক ছিল একটি বিশ্বাসের গুরুত্ব— ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনও মতেই মসজিদের জমিতে হিন্দু মৌলবাদীদের মন্দির গঠনের অন্যায় দাবি মানিয়া লইবে না। রাষ্ট্রের ন্যায্যতাবোধ সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের সেই রাজনীতিকে প্রতিহত করিবে। রাষ্ট্রের এই ন্যায্যতাবোধই সংখ্যালঘুকে নিরাপত্তার বোধ দিতে পারিত, তাঁহাদের নির্ভয় করিতে পারিত। যে দিন সোনার ইটে এই কথাটি গাথা হইল যে, রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের প্রতি তাহার দায়িত্ব পালন করিবে না, তাহাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিবে না, সেই দিনই প্রধানমন্ত্রীর মুখে ভয়ের আয়ুধে প্রীতি আদায়ের কথা— তাহা কি নিতান্ত সমাপতন? না কি, প্রধানমন্ত্রী সচেতন ভাবে এই মুহূর্তটি বাছিয়া লইলেন, যাহাতে বার্তাটি নির্ভুল ভাবে সংখ্যালঘুর মর্মে বিঁধে— তাঁহারা বুঝিয়া লউন, ভারতে থাকিতে হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠকে ভয় পাইতেই হইবে? এবং এমনই প্রতিরোধহীন থাকিতে হইবে, যেন তাহাকে প্রীতি বলিয়া ভ্রম হইতে পারে?

প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত-ভাবনাটি উঠিয়া আসিয়াছে মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের বাঞ্চ অব থটস-এর পৃষ্ঠা হইতে। তীব্র মুসলিম-বিদ্বেষী বয়ানে ‘গুরুজি’ গোলওয়ালকর লিখিয়াছিলেন, এই দেশে মুসলমানদের যদি থাকিতে হয়, তবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবেই থাকিতে হইবে। অর্থাৎ, সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্য মানিয়া, তাহাদের অত্যাচার সহিয়া। স্বাধীনতার পূর্ব হইতেই স্বাধীন দেশের যে কল্পনা জাতীয়তাবাদী নেতারা করিতেছিলেন, সেই ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী ভারতের সহিত ‘গুরুজি’-র ভারত-ভাবনার বিরোধ প্রত্যক্ষ, এবং অসেতুসম্ভব। নেহরু-যুগের ভারত হিন্দুত্ববাদী কল্পনার বিপ্রতীপে জাতি ও জাতীয়তার নির্মাণ করিতে চাহিয়াছিল। জানাইয়াছিল, দেশের প্রতি আনুগত্য প্রমাণের কোনও দায় সংখ্যালঘুর নাই এবং রাষ্ট্রের অধিকার নাই তাঁহাদের নিকট সেই প্রমাণ চাহিবার। সংখ্যাগরিষ্ঠের দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলেন জওহরলাল নেহরু। ক্ষমতায় আসা ইস্তক নরেন্দ্র মোদী ভারত নামক ধারণাটির আত্মায় আঘাত হানিয়াই চলিয়াছেন। ইহাকে শুধু নেহরুর প্রতি তাঁহার ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ভাবিবার কারণ নাই— ভারতের ধারণার সহিত হিন্দুত্ববাদের এই সংঘাত কাঠামোগত। নরেন্দ্র মোদী সাভারকর, গোলওয়ালকরদের স্বপ্ন পূরণ করিতেছেন, এইমাত্র। অযোধ্যার মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি জানাইলেন, জাতির জনকও এই রামরাজ্যেরই স্বপ্ন দেখিতেন। প্রধানমন্ত্রী ভুলিয়াছেন, গোলওয়ালকরকে ভারত এখনও ‘জাতির জনক’-এর স্বীকৃতি দেয় নাই; হিন্দুত্ববাদী গুলিতে নিহত গাঁধীকেই এই দেশ এখনও পিতা হিসাবে চিনে।

‘ত্রাসের দাসত্বে’ নাগরিক তাহার রাজার সহিত একাত্ম বোধ করিতে পারে না, ফলে রাজার শাসনও কখনও বৈধ হইতে পারে না। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রকল্পনার সর্ববৃহৎ খামতি এখানেই। রামচন্দ্র যখন সমুদ্রের উদ্দেশে ধনুর্বাণ তুলিয়াছিলেন, তখন সমুদ্র তাহার স্বজন ছিল না, ছিল অপর। যে আচরণ অ-মিত্রের প্রতি সঙ্গত, যে অস্ত্রে শত্রুর আনুগত্য অর্জন করিতে হয়, তাহা যে আত্মজনের প্রতি অপ্রযোজ্য, এই কথাটি স্বতঃসিদ্ধ। নরেন্দ্র মোদী বলিতে পারেন, হিন্দুত্ববাদের কল্পনায় মুসলমানরা আত্মজন নহেন। তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিবার, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ— সেই অধিকারেই আগামী কাল তিনি লালকেল্লায় উপস্থিত হইবেন— ফলে, তাঁহার রাজনৈতিক বিশ্বাস যাহাই হউক, মুসলমানদের আত্মীয়জ্ঞান করা ভিন্ন উপায় নাই। আত্মজনের বিরুদ্ধে ভীতির অস্ত্র অপ্রযোজ্য।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Ram Mandir Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy