হরেনবাবু নিজের গ্রাম ছেড়ে দূরে এক শহরে চাকরি করেন। এক দিন হঠাৎ দেখলেন অফিসে বাড়ির কাজের লোকটি হাজির। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে তুই হঠাৎ?’ মাথা চুলকোতে চুলকোতে সে উত্তর দিল, বাড়ির পশ্চিমে দু’টি শিরীষগাছ কাটতে হয়েছে। হরেনবাবু অবাক— ‘এই খবরটা দিতে তুই এত দূর এসেছিস! তা কাটতে হল কেন?’ সে আরও মাথা নিচু করে উত্তর দিল, ‘যে আজ্ঞে, বুড়ো হাড় কি কম কাঠে পোড়ে?’ হরেনবাবু একটু চমকে গিয়ে বললেন, ‘বুড়ো হাড়, মানে?’
‘আজ্ঞে আপনার মতো বুড়োই ছিলেন, তাই তাঁকে পোড়াতে অনেক কাঠ লাগল।’
‘সে কী! আমার মা মারা গেছেন?’
‘তা আজ্ঞে কচি নাতির শোক বুড়ো মানুষ সইতে পারলেন না।’
‘সে কী রে! আমার ছেলেও...!’
‘কচি ছেলে, মায়ের দুধ না পেলে আর বাঁচবে কী করে? আমার স্ত্রীও মারা গেছে!’
এই তিনটি সংবাদ গ্রামের পচা প্রভুর কাছে নিরুত্তাপ কণ্ঠে পৌঁছে দিল। গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষ এ ভাবেই দেশের কাছে, দলের কাছে অনেক সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ এমনই নির্বাক হয়ে পৌঁছে দেয়।
এক সময় আমাদের বিশ্বাস ছিল যে, পৃথিবীটা এক বিরাট বড় অজগরের মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে পাশ ফিরলে ভূমিকম্প এবং নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। দরিদ্র দেশে গ্রামের মানুষ পাশ ফিরলে সব কিছুই সংকটে পড়ে। এক নিরক্ষর কিশোর আমাকে বলেছিল, ‘আচ্ছা বাবু, আজকাল শুনি অনেকেই শহরে দাবি আদায়ের জন্য ধর্মঘট করছে, পথ আটকে দিচ্ছে, মসনদে যাঁরা, তাঁদের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছচ্ছে। আমরা গরিব মানুষরা, যারা চাষ করি, লোকের বাড়িতে জন খাটি, বীজ বুনি, ধান-কলাই শুধুমাত্র কায়িক পরিশ্রম করে টিকিয়ে রেখেছি, সেই গতর বেচে খেটে-খাওয়া মানুষগুলি যদি সারা দেশ জুড়ে এক মাস ধর্মঘট করি, তা হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে?’ শুনে সেই ভয়াবহ অবস্থার কথা ভাবতে গিয়ে আমি শিউরে উঠলাম। যাদের ক্ষমতা আছে, তারা নানা ভাবে সেটা জাহির করতে পারে, যাদের ক্ষমতা নেই তারা নাচার। কিন্তু যদি কোনওদিন অজগর পাশ ফিরে শোয়, বহু বলীয়ান সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, সব কিছু ভূমিকম্পের সম্মুখীন হবে।
গ্রামের চেহারা পাল্টাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে দেখলে উন্নয়নের একটা ছাপ অতি প্রকট। রাস্তাঘাট হচ্ছে। গঞ্জগুলি চকচকে রূপ পাচ্ছে। নেশার দ্রব্যের অফুরন্ত জোগান বাড়ছে। স্কুল হচ্ছে, কলেজ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এই উন্নয়ন অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু যে কোনও গরিব পাড়ায় ঢুকুন, পঞ্চাশটা বাড়িতে খোঁজ নিন, তাদের জীবন-জীবিকার উন্নতি উপর থেকে চুঁইয়ে খুবই কম নেমেছে। জন্মসূত্রে বংশপরম্পরায় এরা সব দিক থেকেই গরিব। গাঁধীজি এই অন্তের লোকগুলির উন্নয়নকেই উপরের দিকের মাথাঅলা লোকদের সমস্ত চিন্তা ও কর্মের অভিমুখ হবার কথা বলেছিলেন। বাস্তবে কি তা হচ্ছে? পচাকে আমি জানি, ওদের পাড়ায় আমি বহু বার গিয়েছি। প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের হালহকিকত ব্যক্তিগত ভাবে জানতাম। আকাশে বাতাসে উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের গুণে বহু দিন পর তাদের পাড়ায় আবার গেলাম। এ পাড়ায় দারিদ্র, দুঃখ, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, আধিব্যাধি সবই ছিল। পাঁজরের হাড় দিয়ে শতকিয়া লেখা যায় এমন মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। মা-মেয়েদের অবস্থা আরও চরমে। ২০০টি পরিবারের মধ্যে গোটা কুড়ির দু-বেলা ভাত জুটত। ছেলেদের পরনে আট-হাতি ধুতি এবং মেয়েদের দশ-হাতি শাড়ি, এই ছিল লজ্জা নিবারণের হাতিয়ার। তিন-চারটি বাড়ির ছেলেমেয়ে স্কুলে যেত। আধিব্যাধির জন্য ছিল তন্ত্রমন্ত্র, জড়িবুটি, কিছু হোমিওপ্যাথ। খাবার জলের ব্যবস্থা ছিল না। পুকুর বা খালের জলেই সর্বকর্মসাধন। বাড়িতে শৌচালয় স্বপ্নেও কাছে আসত না।
বহু যুগ পরে সেই পাড়ায় গিয়ে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল, সে একটা ছন্নছাড়া অবস্থা। আগে গরুর লাঙল দিয়ে হাল চাষের ব্যবস্থা ছিল, এখন ট্রিলার-ট্রাক্টর তার জায়গা নিয়েছে এবং গ্রামে যে মানুষগুলির চাষের কাজ জুটত, তার প্রায় ৭৫ শতাংশ উধাও হয়ে গেছে। নিজেদের জলভাসি বলে কিছু নেই। যে গ্রাম দুটিতে ঘুরলাম, প্রায় সব পরিবারেই চোখে পড়ল, সক্ষম যারা, তারা পালিয়েছে। যারা আছে, তাদের কেউ দেবে এবং তাঁরা পাবে, এই ধারণাটাই প্রবল।
তবু, এই বৃদ্ধ বয়সে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, এই মানুষগুলিই এক দিন নড়েচড়ে উঠে দারিদ্রকে নিশ্চিহ্ন করে বাসযোগ্য সমাজ তৈরি করবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy