Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Weaver

শিল্পীর দশা

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২১ ০৯:১২
Share: Save:

নববধূর বেনারসি শাড়ি ভারতীয় পরিবারের সমৃদ্ধি ও সম্মানের দ্যোতক। রেশমের জমির উপরে জরির বিচিত্র কারুকাজ ফুটাইয়া শিল্পীরা যাহা সৃষ্টি করেন, তাহা নান্দনিক উৎকর্ষে বিশ্বের বয়নশিল্পের জগতে আপন স্থান করিয়া লইয়াছে। সেই বেনারসির কারিগর আজ অভাবের তাড়নায় তাঁত বেচিতেছেন, ইহা কি জাতীয় বিপর্যয় নহে? নান্দনিক ঐতিহ্যের যাঁহারা ধারক ও বাহক, তাঁহাদের বিপন্নতা ভারতের লজ্জা। সংবাদে প্রকাশ, কোভিড অতিমারিতে বেনারসির চাহিদা প্রায় সত্তর শতাংশ কমিয়াছে, অন্য দিকে পেট্রোলিয়াম জ্বালানির দামে বৃদ্ধির জন্য রেশম, ধাতুর তার-সহ সকল উপকরণের দাম মাত্রা ছাড়াইয়াছে। এই উভয়সঙ্কটে বহু শিল্পী-কারিগর আপন পেশা ছাড়িয়া রোজগারের অন্য উপায় খুঁজিয় লইয়াছেন। এই চিত্র পশ্চিমবঙ্গেও জেলায় জেলায়। হস্তচালিত তাঁত এবং হস্তশিল্পীরা অতিমারিতে যে দুর্দশায় পতিত হইয়াছেন, তাহার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নাই। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম-সহ নানা জেলায় তাঁতিদের বরাত কমিয়াছে, পূজা কিংবা বিয়ের মরসুমেও তাঁহারা বাড়তি বিক্রয়ের আশায় বসিয়া আছেন, কিন্তু তাহার আশা কম। লকডাউন বহু মানুষকে কর্মহীন করিয়াছে, আরও অনেক মানুষের রোজগার কমাইয়াছে। দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটাইয়া হস্তশিল্পীর উৎপাদন কিনিবার ক্রেতা স্বভাবতই কমিয়াছে। তৎসহ ভাটা আসিয়াছে পর্যটনে। স্থানীয় শিল্পবস্তুর প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ বহু কারিগরের প্রধান ভরসা। সরকারি মেলাগুলিও স্থগিত হইয়াছে। বাজার মন্দ বলিয়া মহাজনেরা শিল্পী-কারিগরদের মজুরি কমাইয়াছে, বাড়িয়াছে কাঁচামালের দাম।

হস্তচালিত তাঁতের শিল্পী এবং বিবিধ হস্তশিল্পের কারিগরদের আর্থিক দুর্দশা নূতন নহে, তাঁহারা চিরকাল কুঁড়েঘরে বাস করিয়াই প্রাসাদ সাজাইবার সামগ্রী নির্মাণ করিয়াছেন। ব্রিটিশ যুগে কারখানা-নির্মিত বস্ত্র উৎপাদনের মুখে ভারতের তাঁতিরা কী রূপ বিপর্যস্ত হইয়াছিলেন, ইতিহাস তাহার সাক্ষ্য রহিয়াছে। এই কারণে দেশপ্রেমের সহিত নিবিড় ভাবে যুক্ত হইয়াছিল ভারতের হস্তশিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা, যাহার অন্যতম প্রকাশ গাঁধীর স্বহস্তে চরকা চালনা এবং খদ্দরের বস্ত্রকে গৌরবান্বিত করিবার চেষ্টায়। স্বাধীনতার পরে কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, পুপুল জয়াকরের মতো ব্যক্তিত্ব ভারতের হস্তশিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য উদ্যোগী হইয়াছিলেন। ভারত সরকারও পরম্পরা-বাহিত শিল্পের প্রতি দায় স্বীকার করিয়া হস্তচালিত তাঁত এবং হস্তশিল্পের জন্য দুইটি পৃথক বোর্ড নির্মাণ করিয়াছিল, যাহা শিল্পীদের প্রশিক্ষণ, কল্যাণ এবং বিপণনে সহায়তা করিত। আক্ষেপ, অতিমারির প্রথম ঢেউয়ে গত বৎসর যখন হস্তশিল্পী বিপন্ন, ঠিক সেই সময়েই এই দুইটি পর্ষদ বিলুপ্ত করিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার।

আপাতত সরকারি সহায়তা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে সরকারি ঋণে। কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারই হস্তশিল্পীদের সহজ শর্তে ঋণদানের নানা প্রকল্প শুরু করিয়াছে। ইহা হস্তশিল্পীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নহে— অতিমারির আর্থিক ধাক্কা হইতে নিস্তার পাইবার পথ হিসাবে কেন্দ্রীয় সরকার ঋণ প্রদানকেই বাছিয়া লইয়াছে। কিন্তু, যখন বাজারে মন্দা, চাহিদা তলানিতে— তখন হস্তশিল্পীরা কোন ভরসায় ঋণ লইবেন? উৎপন্ন পণ্য বেচিয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করিবার পরও সংসার চালাইবার মতো উদ্বৃত্ত থাকিবে, শিল্পীদের তেমন ভরসা নাই। ব্যাঙ্কেরও নাই। কেন্দ্রীয় সরকার যে নির্দেশই দিক না কেন, ব্যাঙ্কগুলি ঋণ প্রদানের পূর্বে প্রার্থীর টাকা ফেরত দিবার ক্ষমতা যাচাই করিয়া দেখিবেই। তাহাই স্বাভাবিক। হস্তশিল্পীদের অধিকাংশই সেই পরীক্ষায় পাশ করিবেন না। অতএব ঋণগ্রস্ত, নিরুপায় তাঁতশিল্পী টোটো চালাইতেছেন। কেহ পরিযায়ী শ্রমিক হইয়া ভিন্‌রাজ্যে গিয়াছেন। এত অনায়াসে মানবসম্পদের এমন অপচয় বোধ হয় ভারতেই সম্ভব।

অন্য বিষয়গুলি:

Weaver Banarasi Saree
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy