বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে চিনের সঙ্গে সামরিক কৌশলগত সঙ্ঘাত আমেরিকার। তার অনুষঙ্গে হঠাৎই তৎপরতার কেন্দ্রে চলে এসেছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে সেখানে, আমেরিকা ও পাকিস্তান সরকার এবং মায়ানমারের নানা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা যে ভাবে আনাগোনা বাড়িয়েছে বাংলাদেশে, কপালে ভাঁজ পড়েছে দিল্লিরও। বস্তুত মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে না জড়ানোর কৌশল নিয়েছে ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকার। কিন্তু বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এই তৎপরতার কেন্দ্রে আসলে মায়ানমার।
মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকারের সঙ্গে চিনের খুবই দহরম-মহরম। তবে দেশটির বাংলাদেশ লাগোয়া কুকি-চিন ও রাখাইন প্রদেশ এখন বিদ্রোহী বাহিনীর দখলে। আমেরিকা এক দিকে এই বিদ্রোহী বাহিনীগুলিকে পরিকাঠামোগত সহযোগিতা করা (পড়ুন অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ)-র কৌশল নিয়েছে। একই সঙ্গে আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইন (সাবেক আরাকান) প্রদেশকে মায়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণার জন্য উস্কানি দিচ্ছে। সূত্রের খবর, আমেরিকা ইউনূস সরকারের কাছে আবদার করেছে, ঢাকা যাতে স্বাধীন রাখাইনকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়ে আসে। এ নিয়ে দফায় দফায় ঢাকা সফরে আসা আমেরিকার বিদেশ বিভাগের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে ঢাকা এখনই এ বিষয়ে আমেরিকাকে চূড়ান্ত ভাবে কিছু বলেনি।
সম্প্রতি আরাকান আর্মির ওয়েবসাইটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়, যাতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বান্দারবনের একটি গ্রামে বৌদ্ধদের জলকেলি উৎসবে মেতেছেন সংগঠনের উর্দি পরা কিছু যোদ্ধা। এই জায়গাটি মায়ানমার সীমান্ত থেকে অন্তত ১০ কিলোমিটার ভিতরে। উৎসবের ছবিতে বাংলাদেশের কয়েক জন সীমান্তরক্ষীকে দেখা গিয়েছে নির্বিকার দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই ভিডিয়ো সামনে আসার পরে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামি সীমান্ত লঙ্ঘনের দাবি করে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু বিএনপি বা ছাত্রদের তৈরি নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি চুপ।
সম্প্রতি আমেরিকার বিদেশ দফতরের তিন কর্তা ঢাকায় আসেন। মায়ানমারে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ইয়াঙ্গন থেকে এসে তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। আরাকান আর্মি এবং কুকি-চিন বিদ্রোহী বাহিনীর প্রতিনিধিরা যেমন এঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন, একই সময়ে ঢাকা সফরে আসেন পাকিস্তানের বিদেশ সচিব আমনা বালোচও। পাক প্রশিক্ষণে তৈরি রাখাইনের রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি)-র প্রধান আতাউল্লা সম্প্রতি ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ থেকে ধরা পড়ে বাংলাদেশের জেলে রয়েছেন। সূত্রের খবর, রাখাইনে আরসা যাতে বিবাদ সরিয়ে রেখে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরাকান আর্মিকে সাহায্য করে, তেমন একটি বোঝাপড়া করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
কিন্তু রাখাইনকে মায়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমেরিকার কী লাভ? লাভ হল বিশ্বজুড়ে চিনের পণ্য পরিবহণের একটি বৃহৎ পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া। চিন এখানে মস্ত একটি বন্দর নির্মাণ শুরু করেছে। সেই বন্দরে পৌঁছনোর জন্য বাংলাদেশে সড়ক পরিকাঠামো তৈরির লক্ষ্যে ঢাকাকে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পে নিয়েছে চিন। অভিযোগ, এই বন্দর নির্মাণের জন্যই জুন্টা সরকারকে দিয়ে রাখাইন থেকে ১০ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বিতাড়ন করিয়েছে চিন। রাখাইন বিচ্ছিন্ন হলে চিনের সেই পরিকল্পনা আটকে যাবে। এই প্রকল্পে নজরদারির জন্যই তাঁদের সরকারের কাছে আমেরিকা সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি দাবি করেছিল বলে অভিযোগ করেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই দ্বীপকে নানা কায়দায় জনশূন্য করে ফেলেছে ইউনূস সরকার। অচিরে দ্বীপটিকে তারা আমেরিকার হাতে তুলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা হাসিনার দল আওয়ামী লীগের।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)