অভিজ্ঞতা বলিতেছে, ভিন্নতা কেবলই বৈষম্যের ভিত্তি হইতে চায়। সেই সঙ্কীর্ণ, ঢালু পথে মনকে চালিত করে দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস। আদিবাসীদের সঙ্গে বহু যুগ তাহাই ঘটিয়া আসিতেছে। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখাইল, সেই ধারা আজও অব্যাহত। পুষ্টিকর খাদ্য, সুলভ চিকিৎসা হইতে প্রাথমিক শিক্ষা, আদিবাসী অঞ্চলে যে কোনওটির নাগাল পাওয়া কঠিন। একত্রিশ শতাংশ আদিবাসী পরিবার এখনও সংবৎসর দুই বেলা খাইতে পায় না। খাদ্য নিরাপত্তা, রোজগার নিশ্চয়তার প্রকল্প কী করিল তবে? প্রচারের আড়ম্বর কি তবে ক্ষুধা ঢাকিয়াছে? কিছু দিন পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে পর পর কয়েক জন শবরের মৃত্যু ঘটিলে সরকারের তরফে তাঁহাদের জীবনযাত্রাকে দায়ী করা হইয়াছিল। মনে পড়িতে পারে, ২০০১ সালে ওড়িশায় আমের শুকনা আঁটি হইতে প্রস্তুত খাদ্য খাইয়া চব্বিশ জন আদিবাসী প্রাণ হারাইয়াছিলেন। তখনও বলা হইয়াছিল, অনাহার নহে, উহা ভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের পরিণাম। ক্রমে প্রকাশ পায়, কালাহান্ডি, কোরাপুট, বোলাঙ্গির, রায়গড় প্রভৃতি জেলায় ক্ষুধা কত ভয়ানক। আদিবাসীরা প্রান্তবাসী বলিয়া তাঁহাদের সমস্যাগুলিও একান্ত তীব্র না হইলে কাহারও নজরে পড়ে না। এবং কিছু শোরগোল হইবার পর ফের সংবাদের উপান্তে, উন্নয়নের প্রান্তে স্থান হয় সেই সকল সমস্যার।
নজর করিলে বোঝা যায়, ভিন্নতার ভিত্তি যতটা ধারণায়, ততটা বাস্তবে নহে। পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি বা উৎসব ভিন্ন হইতে পারে, কিন্তু জীবনের মৌলিক প্রয়োজনের মোকাবিলায় তাঁহাদের সহিত বাকি সমাজের দূরত্ব সামান্যই। এশিয়াটিক সোসাইটি ও প্রতীচী ইনস্টিটিউটের গবেষণাটি দেখাইল, আদিবাসী শিশুদের চুরানব্বই শতাংশ স্কুলে নাম লিখাইয়াছে, গৃহশিক্ষকের নিকট পড়িবার প্রচলনও কম নহে। আটানব্বই শতাংশ আদিবাসী আধুনিক চিকিৎসার সহায়তা লন। চাহিদায় নহে, সমস্যা জোগানে। এখনও আট শতাংশ শিশু এক কিলোমিটারের অধিক হাঁটিয়া স্কুলে যায়। ঘাটতি রহিয়াছে সরকারি চিকিৎসারও, তাই ৬১ শতাংশ আদিবাসী পরিবার বেসরকারি চিকিৎসকের দরজায় দাঁড়াইয়া থাকে। সেই চিকিৎসার মান কেমন, সে প্রশ্নও করিতে হয়। আদিবাসীদের গড় আয়ু যে রাজ্যের গড় অপেক্ষা অনেকটাই কম, তাহাতে অপুষ্টি এবং মন্দ চিকিৎসার অবদান কম নহে। অনেকের ধারণা, আদিবাসীরা অরণ্যের নিকট বাস করে বলিয়া তাঁহাদের প্রাণিজাত খাদ্যের অভাব নাই। ইহা অসত্য। অরণ্যের অধিকার নাই, খাদ্যে প্রোটিনের একান্ত অভাব।
যে কোনও সরকারি পরিষেবার নিরিখেই আদিবাসী অঞ্চল বঞ্চিত। ছেষট্টি শতাংশ বাড়িতে শৌচ-নিকাশির ব্যবস্থা নাই, অধিকাংশ আদিবাসী গ্রাম হইতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র পাঁচ কিলোমিটারেরও অধিক দূর, একত্রিশ শতাংশ শিশুর টিকাকরণ কার্ড নাই। তালিকা দীর্ঘ করিয়া লাভ নাই। সর্বপ্রথম ‘হাস্যরত আদিবাসী’ চিত্রটি মন হইতে মুছিতে হইবে। সরকার-বিতরিত ধামসা-মাদলের বোল আদিবাসীর বঞ্চনার বিবরণকে ঢাকিতে পারিবে না। আদিবাসী তাহাই চাহে, যাহা চায় বাকি রাজ্যবাসী— সুষ্ঠু পরিষেবা, উন্নত পরিকাঠামো, অধিকারের মর্যাদা। এই বার সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে রাজ্যকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy