মহাশ্বেতাদেবীর সঙ্গে। নিজস্ব চিত্র
নিজের জীবন দিয়ে দেখেছিলেন, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা লোধা-শবর ছেলে মেয়েদের পক্ষে কতটা কঠিন। সেই অভিজ্ঞতা আর বোধ থেকেই পাশে থাকার চেষ্টা শুরু। অবশ্য অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন প্রবোধকুমার ভৌমিককে দেখে। লোধা-শবরদের জন্য তৈরি প্রবোধবাবু ‘বিদিশা’র সমাজসেবক সঙ্ঘ দেখেই কিছু করার ভাবনা। প্রহ্লাদকুমার ভক্তা গত শতকের সত্তরের দশকে ডেবরা ব্লকের চকসাহাপুর গ্রামে তৈরি করেন ‘চকসাহাপুর লোধাসমাজ সেবক সঙ্ঘ’। তখন তিনি কলেজের ছাত্র।
১৯৭২ সালে চারজন লোধা-শবর ছেলে মেয়েকে নিয়ে সঙ্ঘের কাজ শুরু হয়েছিল। টাকা পয়সার অভাব। এগিয়ে এসেছিল কলকাতার অগ্রণী ক্লাব, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। সাহায্য মিলত। সাহায্য করতেন গ্রামবাসীরাও। তাঁদের সাহায্যে আনাজ ফলিয়ে ফসল বিক্রি করে সেই টাকায় প্রতিষ্ঠানের আবাসিক পড়ুয়াদের বিভিন্ন খরচ জোগানো হত। দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন এসসি-এসটি ওয়েলফেয়ার দফতরের অধিকর্তা উজ্জ্বলকান্তি রায়। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে সরকারি অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেন। উজ্জ্বলকান্তি মেদিনীপুরের জেলাশাসক হয়েছিলেন। পরে আবার এসসি-এসটি ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের অধিকর্তা হন। উজ্জ্বলকান্তি বুঝেছিলেন, লোধা যুবকটির বুকে আগুন আছে। সরকারি অনুমোদন মিলল ১৯৭৮ সালে। এলাকার কয়েকজন লোধা, সাঁওতাল, ভূমিজ ও মুন্ডা সম্প্রদায়ের যুবক প্রহ্লাদের পাশে দাঁড়ালেন।
লড়াই করেই লোধাদের কাজ চলতে লাগল। ১৯৭৮ সালে সরকারি অনুমোদন মিলল। আরও কয়েকজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য নিজের জমিতেই কাজ শুরু করেছিলেন প্রহ্লাদ ভক্তা। কিন্তু জনজাতি গোষ্ঠীর কল্যাণে চিন্তাভাবনা, কাজ এবং প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য বিপাকেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে মিসা আইনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন জেলাশাসক উজ্জ্বলকান্তির হস্তক্ষেপে গ্রেফতারি এড়িয়েছিলেন।
আবার এই কাজের জন্যই অনন্য স্বীকৃতি মিলেছিল মহাশ্বেতাদেবীর কাছ থেকে। ১৯৮৩ সালে সিআরআই-এর অধিকর্তা অমলকুমার দাসের সৌজন্যে আলাপ হল মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে। মহাশ্বেতা নিজে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রহ্লাদ ভক্তা কলকাতায় বালিগঞ্জের বাড়িতে দেখা করলেন। সেখানে এক রাত ছিলেন। পরদিন প্রহ্লাদ দেখেন, মহাশ্বেতা তাঁর জুতো পালিশ করছেন। প্রহ্লাদ বলেছিলেন, ‘‘দিদি আপনি ব্রাহ্মণ হয়ে এ কী করছেন!’’ জবাবে মহাশ্বেতা বললেন, ‘‘আমি তোর মা। তুই কীসে কম ব্রাহ্মণ রে।’’ মহাশ্বেতাদেবীর ‘বর্তিকা’ পত্রিকায় বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রহ্লাদ। আমৃত্যু ‘শবর জননী’র সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তাঁর মৃত্যুর দু’সপ্তাহ আগে দেখা করে এসেছিলেন প্রহ্লাদ।
চারজনকে নিয়ে যে আশ্রম চালু হয়েছিল এখন সেখানে থাকে ১৩০ জন। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর এবং হুগলি জেলার ২৫টি ব্লকের লোধা ও অন্য জনজাতির ছেলে মেয়ে এখানে থেকে এলাকার দু’টি প্রাথমিক এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। খাওয়া, থাকা, চিকিৎসা বিনামূল্যে। বালিকা বিভাগে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ৭০ জন আবাসিক রয়েছে। বালক বিভাগে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির ৬০ জন আবাসিক আছে। প্রহ্লাদের আক্ষেপ, ‘‘এর বেশি পড়ুয়া রাখার অনুমোদন মেলেনি। পর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য ও অনুমোদন না মেলায় ইচ্ছে থাকলেও বেশি পড়ুয়া রাখা সম্ভব হয় না। সেই কারণে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র ২৯ জন লোধা জনজাতির ছেলে মেয়েকে মাধ্যমিক পাস করাতে পেরেছি।’’ এখন সংস্থার কর্মী ১১ জন। এ ছাড়া বাইরে থেকে কোচিং পড়াতে আসেন ১৮ জন তরুণ-তরুণী।
নিজে অবশ্য এখন সরাসরি যুক্ত নন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তবে প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য হিসেবে আছেন। এখন সংস্থার মূল কাজকর্ম দেখভাল করছেন প্রহ্লাদবাবুর অভিন্ন হৃদয় বন্ধু গঙ্গারাম হেমব্রম এবং স্নেহভাজন শিবশঙ্কর অধিকারী। প্রহ্লাদবাবু জানালেন, শিবশঙ্করের মতো জনজাতি গোষ্ঠীর বাইরের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরাও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে। এখন সংস্থার ২১ জনের পরিচালন কমিটিতে লোধা-শবর সম্প্রদায়ের ছ’জন রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি তথা জলিমান্দা পঞ্চায়েতের সদস্য সঞ্জয় মল্লিক উচ্চ মাধ্যমিক পাস।
চকসাহাপুরের প্রতিষ্ঠান গাছগাছালিতে ঘেরা। দেবদারু, আম, সবেদা, নারকেল, বাদাম, কলা, পেয়ারা, অর্জুন, বাঁশ, কত গাছ। আশ্রমে এসে ডুবে যান স্মৃতিচারণায়। মহাশ্বেতা দেবী, প্রবোধকুমার ভৌমিক, তাঁর ভাই সুহৃদকুমার ভৌমিকের মতো বহু বিশিষ্টজন প্রতিষ্ঠানে এসেছেন। প্রহ্লাদ লিখেছেন দু’টি গ্রন্থ। নিজের জীবন কাহিনি ‘আমার ভুবন’। প্রহ্লাদের কথায়, ‘‘আমার ভুবন হল এক লোধা-শবর জীবনের বেড়ে ওঠার কোলাজ। ২০১৬ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কনফেডারেশন অ্যান্ড অ্যাকাডেমি অব অ্যানথ্রপলজিস্টস্-এর প্রকাশনায় বইটি মুদ্রিত হয়। বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ অজিতকুমার দণ্ড ও দীপালি দণ্ডের প্রচেষ্টায় আমার ভুবন প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল।’’ ২০০৯ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের মেচেদার মারাংবুরু প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় ‘লোধাশবর জাতির সমাজজীবন’। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করার কাজ চলছে। বইটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইংরেজি বিভাগের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছে।
প্রহ্লাদ এখনও লোধা-শবর গ্রামে ঘোরেন। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষগুলোর জন্য সেভাবে কিছু করতে পারিনি। তবে তাঁদের সঙ্গ ছাড়িনি। পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলার ২০টি ব্লকের ৪২৩টি গ্রামে লোধা-শবরদের বাস। প্রায় ২০ হাজার পরিবারের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভূমিহীন। লোধাদের ৯০ শতাংশ স্কুল ছুট হয়ে যায়। তার কারণ পরম্পরাগত অবাধ বিচরণের অভ্যাস। এই অভ্যাসে দাঁড়ি টানতে হলে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনা ও আন্তরিকতা।’’ অরণ্যনির্ভর লোধা-শবরদের জন্য চাষাবাদ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মনে করেন প্রহ্লাদবাবু। তাঁর মতে, লোধাদের উন্নয়নে প্রধান বাধা হল পাঁচটি— ১) উৎপাদনের উপাদান বিশেষ করে জমির অভাব, ২) অশিক্ষা, ৩) মাদক দ্রব্যে অধিক আসক্তি, ৪) অস্বাস্থ্যকর ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবনযাত্রা অভ্যাস ৫) আয় বুঝে ব্যয় না করার অভ্যাস।
প্রহ্লাদ ভক্তা প্রগতিশীল। নিজের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তবে কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেন না। অনেকে তাঁকে লোধা জনজাতির ‘রামমোহন’ বলে আখ্যা দেন। নিজে অবশ্য বলেন, ‘‘সীমিত সাধ্যের মধ্যে খুবই স্বল্প পরিসরে কিছু কাজ করে চলেছি। সমাজ বদলানোর স্বপ্নটার বাস্তব রূপ দিতে না পারার যন্ত্রণাটা কুরে কুরে খায়। ভালবাসার মানুষরা এই সব উপমা দিলে যন্ত্রণাটা আরও বাড়ে।’’ কিন্তু শুভানুধ্যায়ীরা অকপটে মানেন, লোধাদের নিয়ে সমীক্ষার কাজটা তাঁর মতো কেউ করতে পারেননি আজ পর্যন্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy