কন্যাশ্রীর পর এ-বার রূপশ্রী। বঙ্গীয় নারীসমাজের ‘উন্নতিকল্পে’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর একটি ‘ঐতিহাসিক’ প্রকল্প। ২০১৮-১৯ সালের রাজ্য বাজেটে ঘোষিত দেড় হাজার কোটি টাকার রূপশ্রী প্রকল্পের উদ্দেশ্য: যে সকল পরিবারের বার্ষিক আয় দেড় লক্ষ টাকার কম, রাজ্য সরকার তাহাদের কন্যার বিবাহের সহায়তা হিসাবে পঁচিশ হাজার টাকা দিতে চলিয়াছে। শর্ত: কন্যার আঠারো বৎসর বয়স হইতে হইবে। দুঃস্থ পরিবারে কন্যার বিবাহের দরুন যে আর্থিক সংকট উপস্থিত হয়, তাহার উদ্ধারকল্পে এই প্রকল্পের অবতারণা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ঘোষণা করিয়াছেন, রাজ্যের মেয়েদের ক্ষমতায়নের পর এ-বার তাহাদের পাশে দাঁড়াইবার পালা। তাঁহাদের তৃপ্তির প্রকাশ মনোমুগ্ধকর। ‘পাশে দাঁড়াইবার’ ভাবনাটিও অতীব প্রশংসার্হ। তাঁহারা যে সাধারণ মানুষের কথা ভাবিতে ভুলিতেছেন না, জানিয়া আশ্বস্ত হইতে হয়। কিন্তু আশ্চর্য হইতে হয় তাঁহাদের বিবেচনার হাল দেখিয়া। এই প্রকল্প কল্পনার সময় কি তাঁহাদের মাথায় এক বারও এই ভাবনা খেলে নাই যে, কন্যার আঠারো বৎসর পূর্ণ হইলে যদি বিবাহার্থে সরকার টাকা দেয়, তবে তাহা পাইবার জন্য আরও বেশি সংখ্যক পরিবার মেয়ের আঠারো হইলেই বিবাহ দিতে ছুটিবে? অর্থাৎ মেয়েদের বিবাহের বয়সকে টানিয়া নামাইবার চেষ্টা করিবে? ঠিক, আঠারো বৎসরে আইনমতে বয়ঃপ্রাপ্ত, বিবাহে বাধা নাই। কিন্তু ‘ক্ষমতায়ন’-এর কথা যাঁহারা ভাবেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই বয়ঃপ্রাপ্তর সঙ্গে সঙ্গেই কন্যাকে বিবাহের পিঁড়িতে বসাইবার কথা বলেন না। অর্থাৎ বিরাট সম্ভাবনা যে— রূপশ্রী প্রকল্প আসলে অল্প বয়সে মেয়েদের বিবাহ দিতে একটি ইনসেনটিভ বা প্রণোদনা হইয়া দাঁড়াইবে। নারীর ক্ষমতায়ন বলিতে কি মুখ্যমন্ত্রীরা তবে তাহাই বুঝিতেছেন?
নূতন পরিকল্পনাটিকে কন্যাশ্রীর সঙ্গে মিলাইয়া দেখিলে প্রশ্নটি আরও গুরুতর। তৃণমূল সরকারের ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রকল্প কন্যাশ্রী যদি মেয়েদের আঠারো বৎসর অবধি পড়াশোনা করিতে বলে, তবে রূপশ্রী বলিবে আঠারো হইলে পড়াশোনা ও কাজকর্মের পথ ছাড়িয়া বিবাহ করিতে। কিন্তু যে মেয়েরা পড়াশোনা করিতে পারিতেছে, তাহাদের নিজের পায়ে দাঁড়াইবার চিন্তাটিতে উৎসাহ দিলেই কি কন্যাশ্রীর প্রতিও সুবিচার হইত না? বিবাহ তো নিজের পায়ে দাঁড়াইবার পথ হইতে পারে না। বিবাহে উৎসাহ দেওয়া ‘ক্ষমতায়ন’-এর পন্থা হিসাবেও স্বীকৃত হইতে পারে না। মেয়েরা নিজেরা পড়াশোনা বা কর্মসংস্থানের পথে পা বাড়াইতে চাহিলেও পরিবারের আর্থিক চাপের দায় এড়াইতে না পারিয়া, হয়তো পরিবারের চাপেই, পতিগৃহে যাওয়াকেই বাছিয়া লইবে। আর পতিগৃহে গিয়া সাধারণ ঘরের মেয়েরা কত দূর ‘নিজের পায়ে’ দাঁড়াইতে পারে, সাম্প্রতিক সংবাদ-সমূহই তাহা চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেয়। মুখ্যমন্ত্রী কি বুঝিতে পারিতেছেন, কন্যাশ্রীর যেটুকু সাফল্য, তাহাকে নষ্ট করিবার উপযুক্ত দাওয়াই রূপশ্রী?
সোজা কথা, জনপ্রিয়তা বাড়াইতেই হউক, আর ক্ষমতায়নের স্বার্থেই হউক, মেয়েদের জন্য যদি কিছু করিতেই হয়, তবে বিবাহের অঙ্গনে তাহা করিবার মধ্যে একটি পশ্চাৎপদ মানসিকতা আছে। যে সমাজ আগাইতে চাহে, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব সে অস্বীকার না করিলেও বিবাহে সরকারি উৎসাহ বা সহায়তা দিবার কথা ভাবে না। বিবাহের ক্ষেত্রে যাহাতে পরিবারের ‘আর্থিক সংকট’ না হয়, তাহাই মানুষকে বুঝাইতে চেষ্টা করে। নয়তো সরকারি অনুদানের পঁচিশ হাজার টাকাকে আসলে পণের টাকার অংশ ভাবিয়া লইতে হয়! আরও একটি কথা। নারীর ক্ষমতায়নই যদি উদ্দেশ্য হয়, তবে প্রকল্পের নাম ‘রূপশ্রী’ করিয়া তাঁহারা ঠিক কী বুঝাইতে চাহেন? রূপই তবে ক্ষমতা? বিবাহ ‘অর্জন’ করিতে হইলে রূপেরই ‘আরাধনা’ চাই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy