মাননীয়
শ্রী নরেন্দ্র মোদী,
অনেক দিন ধরেই এ চিঠি লিখব ভাবছিলাম। আসলে, মনে মনে লিখছি অনেক দিন ধরেই। আপনি যখন গাঁধীনগর থেকে দিল্লিতে এসে ক্ষমতাসীন হলেন তখন মনে হয়েছিল কংগ্রেস-বিজেপি মতাদর্শগত বিতর্ক যা-ই থাকুক না কেন, অন্তত ভারতের মতো এমন একটি বিশাল ও জটিল দেশে প্রশাসনিক পরিচালনার ক্ষেত্রে এক নতুন অভিমুখ আসবে। জগদীশ ভগবতীর মতো অর্থনীতিবিদেরা বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে দেশে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সংস্কার হবে। বৃদ্ধি ও বিকাশ হাত ধরাধরি করে চলবে। আবার গ্রামীণ কৃষক সমাজ এক নতুন অর্থনীতির সাক্ষী হবে। তারাও স্বপ্ন দেখেছিল এ বার হয়তো সবুজ বিপ্লব হবে।
আসলে ১০ বছর ধরে মনমোহন সরকারের বিবিধ দুর্নীতি, প্রশাসনিক নীতিপঙ্গুত্ব দেখে হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। সেই কবে থেকে দেখছি আপনাকে। ১৯৮৪ সালে সাংবাদিকতায় এসেছি। ’৮৭ সালে যখন দিল্লিতে আসি, তখন থেকে আপনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেশাদারি সাক্ষী। দিল্লি থেকে গুজরাত যাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আপনার সাফল্য দেখে বার বার চমকিত হয়েছিলাম। ভাইব্র্যান্ট গুজরাত উৎসবটি দেখতে ফি বছর গুজরাত যেতাম আর ভাবতাম, এ রকম শিল্প পরিস্থিতি কেন পশ্চিমবঙ্গে হয় না। সে সব কথাও কম লিখিনি।
কিন্তু এ বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যখন দু’বছর অতিক্রান্ত, তখন হতাশ না হয়ে পারছি না। যারা কট্টর বিজেপি বিরোধী, যারা কট্টর মোদী বিরোধী, যারা আরএসএস বিরোধী, তারা অনেকে আপনার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটাকে মনস্তাত্ত্বিক ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। আমি কিন্তু সে দলেও নেই। মতাদর্শগত ভাবে বিজেপির সঙ্গে আমার মতপার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম নরেন্দ্র মোদী বিজেপির প্রধানমন্ত্রী হবেন না। আরএসএসের প্রধানমন্ত্রী হবেন না। তিনি ভারতের ১২৫ কোটি মানুষের প্রধানমন্ত্রী হবেন। অনেকে বলছেন, দু’বছরে কোনও কাজই হয়নি, আমি কিন্তু তা-ও বলছি না। আলাদা রেল বাজেট উঠিয়ে সাধারণ বাজেটে তা মিশিয়ে দেওয়া— এ রকম একটি ছোট্ট সিদ্ধান্ত ভারতের মতো দেশে বাস্তবায়িত করা সহজ কাজ নয়। যোজনা কমিশন অবলুপ্ত করে নীতি আয়োগ গঠন নিয়ে বিতর্ক যা-ই হোক তবু তো নতুন অভিমুখ দেখানোর চেষ্টা। যেখানে যোজনা বরাদ্দ নিয়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করার বার্তা ছিল।
কিন্তু সব মিলিয়ে আমার বার বার আপত্তি একটি জায়গায়। সেটা হল, মনে হচ্ছে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বলে যেন আপনার সরকার সারা ক্ষণ সবার সঙ্গে এক ‘যুদ্ধং দেহি’ মুডে আছে। তা সে বালুচিস্তানের ইস্যুই হোক বা কাশ্মীর উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোণঠাসা করার উদ্দেশ্য, রাজ্যগুলিকে চাপে রাখার কৌশলই হোক অথবা সংবাদমাধ্যম পরিচালনার কৌশলই হোক। ইংরেজিতে যাকে বলে কমব্যাট মোড। বয়সে আমি আপনার চেয়ে প্রায় দশ বছরের ছোট। তাই অপরাধ নেবেন না। কেন জানি না মনে হচ্ছে, ভারতের মতো সুবিশাল একটি দেশে, যেখানে নানা ভাষা, নানা বেশ, নানা পরিধান, সেখানে বহুত্ববাদের বিনয় যদি না থাকে তা হলে স্টিম রোলারের উপরে বসে ভারতের মতো দেশ চালানো যায় না।
আপনি নেহরুবাদী না ফেবিয়ান সোশ্যালিস্ট, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের শিষ্য, নাকি দক্ষিণপন্থী রিপাবলিক্যান পার্টির ভারতীয় সংস্করণের উদ্গাতা— এ সব বিতর্কে আমার আগ্রহ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে এই সরকার যতটা আঙ্গিক (ফর্ম) নিয়ে ব্যস্ত ঠিক ততটা বিষয়বস্তু (কন্টেন্ট) নিয়ে নয়। তাই প্রচারকৌশল আজ মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব পাচ্ছে। আসলে আমি কী, তার চেয়েও যেন বড় হয়ে উঠেছে আমাকে মানুষ কী ভাবে দেখছে। এই কারণে পীযূষ পাণ্ডে, প্রসূন জোশীরা এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গ্রামের প্রত্যন্ত কৃষককুলের চেয়ে। সংসদ সদস্যদের আদর্শ গ্রামগুলি কী অবস্থায় আছে দেখে আসুন। এমনকী, আপনার নির্বাচন কেন্দ্র বারাণসী এখন কী জায়গায় আছে সেটাও আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। এ কথা সত্য যে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। যে নৈশভোজেই যাই লোকজনদের বলতে শুনি, যত দিন রাহুল গাঁধী বিরোধী দলনেতা তত দিন নরেন্দ্র মোদীর আর কোনও চিন্তা নেই। আর সেখানেই আমার আরও সমস্যা। বিরোধী-হীনতার মধ্যে ব্রুট মেজরিটি নিয়ে যদি চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতাই এ সরকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে তবে সেটা বোধহয় গণতন্ত্রের জন্য দুঃখের খবর হবে।
আপনি সারা ক্ষণ বলছেন, বিকাশ বিকাশ এবং বিকাশ। অথচ অমিত শাহের রাজনীতি চলছে উল্টো পথে। দলিতবিরোধী, মুসলিমবিরোধী, খ্রিস্টানবিরোধী এই মেরুকরণের রাজনীতি কি আসলে ভোটব্যাঙ্কের জন্য? বাজপেয়ী জমানায় প্রধানমন্ত্রীর ছিল উদার ভাবমূর্তি। আর লালকৃষ্ণ আডবাণী ছিলেন কট্টর ব্যক্তিত্ব। এখন আপনি তো টু-ইন-ওয়ান। আপনি উদার, আপনি কট্টর। আপনি সরকার, আপনি দল। আপনি বাজপেয়ী, আপনি আডবাণী। আর সেই কারণে আপনার দায়িত্ব বোধহয় এখন আরও বেশি। অশোক থেকে আকবর— এই দেশে উদারবাদী গণতন্ত্রের একটি ঐতিহ্য রয়েছে। এই দেশটা নিছক কংগ্রেস-বিজেপির দেশ নয়।
প্রণাম নেবেন
বিনীত
জয়ন্ত ঘোষাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy