২০১৬ সাল শেষ হয়ে এল। আপনার এ বারের সাংসদ পর্বের অর্ধেক রাস্তা হেঁটে এলেন। সংসদের মধ্য থেকে আড়াই বছরে এই দেশে কি কোনও পরিবর্তন দেখলেন?
২০১৬ সালটা গোটা পৃথিবীতেই খুব দুশ্চিন্তা রেখে গেল। ২০১৪ সালে আমি যখন সংসদীয় নির্বাচনে লড়তে রাজি হয়েছিলাম, মনে হয়েছিল, দেশের সামনে দুটি বিপদ। প্রথমত, কংগ্রেস ধসে যাচ্ছে, বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবার ক্ষমতায় উঠে আসছে, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। একটা ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের দিকে দেশ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয়ত, এ দেশের যে অল্পসংখ্যক বিলিয়নেয়ার, তাঁদের স্বার্থই রক্ষা করবে মোদীর বিজেপি, এমনও মনে হয়েছিল। দেখেছিলাম, কী ভাবে তাঁরা মোদীকে সমর্থন করছেন। সংসদে ঢোকার পর একাধিক বক্তৃতায় বলেছিলাম, গণতন্ত্র কিন্তু সংখ্যাগুরুবাদ নয়। এই সরকার জাতীয়তাবাদের কথা বলে, কিন্তু জাতীয়তাবাদ মানেই উগ্র ও সংকীর্ণ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ নয়। এর পর আড়াই বছরে আমরা দেখলাম ঘর ওয়পসি, লাভ জিহাদ, গোরক্ষা। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের ঝোঁক সমানেই বেড়ে যাওয়া। অন্য ভয়টাও সত্যি হল। খুব উচ্চবিত্ত যারা, এই সরকার তাঁদেরই হয়ে কাজ করে। অনেকে বলছে যে মোদী নাকি তাঁদের খুব একটা প্রতিদান দেননি। আমি কিন্তু বলব, প্রথমে এসেই মোদী প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন জমি অধিগ্রহণ বিল-এর মাধ্যমে। অবশ্য বিশেষ এগোতে পারেননি, বিরোধিতা সফল হয়েছিল। প্রতিদানের এই পথটাই ওঁর জানা ছিল, গুজরাতে এটাই উনি করে এসেছিলেন, আম্বানি-আদানিদের জমি বিলিয়েছিলেন। গোটা ভারতে কিন্তু সেটা করা সম্ভব হল না। তার পর এল, ডিমনিটাইজেশন। আপাতদৃষ্টিতে, এটা কালো ধনের বিরুদ্ধে বিরাট একটা যুদ্ধ। কিন্তু ক্রমে দেখা গেল, গরিব জনসাধারণের বিরুদ্ধেই একটা যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে।
গুজরাতে গিয়েছিলাম একটা কনফারেন্সে। ভারুচ— সেই পুরনো বন্দর শহর। সেখান থেকে দাহেজ, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে চেপে। যেতে হল এসইজেড-এর মধ্য দিয়ে, যেখানে বড় শিল্পপতিদের সব রকমের সুবিধে পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। অমন একটা সর্বব্যাপী পরিবেশ-দুর্গতি ভারতের আর কোথাও দেখেছি কি না সন্দেহ। আগুন, ছাই, কয়লার ছড়াছড়ি চার দিকে। বন্দরে গিয়ে দেখলাম, দেশের উপকূলও আদানিদের হাতে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা গেলাম নৌবাহিনীর জাহাজে, কিন্তু আদানির প্রাইভেট বন্দরের মধ্য দিয়ে। সেই জাহাজেও আদানির নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষীরা সর্বত্র ওয়াকি-টকি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই তো দেশের অবস্থা। তাই আমি ব্যক্তিগত দুর্নীতি ইত্যাদির কথা বলি না। ঘটনা হল, এর চেয়ে আরও অনেক বড় কথা আছে, নীতির প্রশ্ন আছে। সরকারের নীতি কাদের সুযোগসুবিধে করে দিচ্ছে সেটা ভাবা জরুরি। অথচ মুখে সারাক্ষণ বলা হচ্ছে, গরিবদের জন্যই সব। এই দুই দিক থেকেই মনে হয়, দেশের বিপন্নতা অনেক দূর বাড়ছে।
রাজনীতিতে রেটরিক থাকে, বাইরে-ভেতরের অমিলও থাকে। প্রশ্ন হল, এই সরকারের মধ্যে সেটা কতখানি বেশি। ডিমনিটাইজেশনের কথাই ধরা যাক। যদি অল্পসংখ্যক লোকের কথা ভেবে একটা কাজ করা হয়, যাতে দেশের কোটি কোটি মানুষের অসুবিধে ঘটে, সেটা তো কেবল অর্থনীতির প্রশ্ন নয়, রাজনীতিরও প্রশ্ন— একটা কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি।
একেবারে ঠিক। ডিমনিটাইজেশন করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণেই। উদ্দেশ্য? রাষ্ট্র আর নাগরিকের সম্পর্কটা পাল্টে দেওয়া। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেকেই রাষ্ট্রের প্রতিভূ মনে করেন। তিনিই রাষ্ট্র, তিনিই সরকার। আজ দেশের কোনও গ্রামে কেউ নেই যিনি প্রধানমন্ত্রীর কথা জানেন না, প্রধানমন্ত্রী গরিবের হয়ে কালোধনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন সেটা জানেন না। ডিমনিটাইজেশন এক ধাক্কায় সেটা করে দিয়েছে। অমর্ত্য সেন-সহ অনেক অর্থনীতিবিদই বলছেন যে অর্থনীতিতে এটা বিশ্বাসভঙ্গের প্রশ্ন, টাকার নোটের মধ্যে যে রাষ্ট্রের সমপরিমাণ অর্থ বা মূল্য ধরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, সেটা এক ধাক্কায় নষ্ট করে দেওয়া হল। কিন্তু রাজনীতির দিক থেকে ভাবলে ব্যাপারটা আরও সাংঘাতিক। ডিমনিটাইজেশনই প্রমাণ, আমাদের দেশে যা চলছে তার নাম গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র। অন্যান্য অনেক দেশেও একই ব্যাপার চলছে, যেমন পুতিনের রাশিয়া, এর্দোয়ানের তুরস্ক। আমরা নাকি বিশ্বের বৃহত্তম (লোকসংখ্যার দিক দিয়ে) গণতন্ত্র। আমরা যথেষ্ট ভাল ভাবে ভেবে দেখি না আমাদের গণতন্ত্রে গলদ কোথায়। এই শনির ছিদ্র ধরেই উগ্র জাতীয়তাবাদ আর গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার দেশে জায়গা করে নেয়।
গত বছর ডিসেম্বরে সংসদে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক বক্তৃতায় আপনি অম্বেডকরকে উদ্ধৃত করেছিলেন: ভারত চরিত্রগত ভাবে অগণতান্ত্রিক, গণতন্ত্র কেবল এর উপরের সাজ, ‘টপ ড্রেসিং’।
হ্যাঁ। অম্বেডকর যে সাংবিধানিক নৈতিকতার কথা বলেছিলেন, তার আলোচনা করেছিলাম। সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের কথাও বলেছিলাম। উনি সতর্ক করেছিলেন যে আমরা যেন রাজনৈতিক ভাবে প্রগতি আর সামাজিক ভাবে রক্ষণশীলতার দিকে না এগোই। এখন কিন্তু সেটাই ঘটছে। এই পরিস্থিতিতে, আমার মতো কেউ কী করতে পারে? সংসদে গিয়ে কিছু বলতে পারি, পাবলিক ডিবেটে অংশ নিতে পারি, হয়তো তাকে খানিক প্রভাবিতও করতে পারি।
এই কথোপকথন আদানপ্রদানের পরিসরেই গণতন্ত্রের শক্তি। কিন্তু এই পরিসর কি আগের থেকে ছোট আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?
হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু এই অবক্ষয় কেবল আড়াই বছরের অর্জন নয়, তার অনেক আগে থেকেই ঘটছে। স্বাধীনতার আগে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বক্তৃতাগুলো পড়েছি, উনিশশো পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের সংসদের বক্তৃতা পড়েছি, তার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতির বিরাট তফাত। তবে আমি এও বলব যে সংসদে মাঝেমধ্যে যখন বলার সুযোগ পাই, অন্যরা কিন্তু শোনেন। আমি তো সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা বক্তৃতাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে দেন বলে আরও অনেক লোক সেটা শোনার সুযোগ পান। ফলে আমার কাছে সংসদে বক্তৃতা করতে পারাটা একটা বিরাট অনলাইন কোর্সে পড়ানোর সুযোগের মতো! এই তো, অমর্ত্য সেনের স্ত্রী এমা রথসচাইল্ড সে দিন গল্প করছিলেন, ফেব্রুয়ারিতে বস্টনে খুব ঠান্ডার মধ্যে ট্যাক্সিতে উঠে দেখেন ড্রাইভার ইউটিউবে মন দিয়ে আমার বক্তৃতা শুনছেন। এ ভাবেই নানা সীমানা পেরিয়ে কিছু কথা জানানোর সুযোগ হয়।
বিজেপির রাজনীতিই সংখ্যাগুরুবাদকে লালন করে চলা। কিন্তু আরও বড় অর্থে, ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের বিপদ কি ভারতীয় গণতন্ত্রের মধ্যেই নিহিত নয়?
ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদ ভারতের বিপদ ঠিকই। তবে আমাদের দেশে হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদ তৈরি করা খুব সহজ নয়! মোদীও জিতেছিলেন মাত্র ৩১ শতাংশ ভোটে। আমাদের হিন্দু সমাজের ভেতরে যত রকম কৃষ্টিগত, ভাষাগত, জাতিগত, শ্রেণিগত ভিন্নতা, তার কারণেই ব্যাপারটা কঠিন। তবে মানতেই হবে যে এটা একটা সম্ভাব্য বিপদ। অন্যান্য দেশেও একই সমস্যা দেখা যাচ্ছে। আমেরিকায় তো এ বার জাতিভিত্তিক হোয়াইট ন্যাশনালিজম দেখা গেল। আগে থেকেই যে সমাজে সংখ্যাগুরুর অস্তিত্ব, সেখানেই এই বিপদটা বেশি। সংখ্যাগুরু যদি ভয় পায় যে তারা নিজেদের অবস্থান বা সামাজিক প্রতিপত্তি হারাতে বসেছে, তবে রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া উঠে আসে। ইউরোপেও তাই দেখছি। অভিবাসীদের বেছে নেওয়া হয় সহজ টার্গেট হিসেবে। সে দিক থেকে ট্রাম্প আর মোদীর তফাত কোথায়? আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে ২০১৪ সালে মোদী বলেছিলেন, ১৬ মে-র পর সমস্ত বেআইনি অভিবাসীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এটা সোজাসুজি সংখ্যালঘুবিরোধী আক্রমণ, কেবল তাতে নাগরিকত্বের ভাবনার একটা মোড়ক পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ট্রাম্পও একই কথা বলেছেন, এগারো থেকে পনেরো মিলিয়ন বেআইনি অভিবাসীকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন, কংক্রিট আর সিমেন্ট দিয়ে আমেরিকা-মেক্সিকোর মধ্যে হাজার-হাজার মাইল লম্বা দেওয়াল বানিয়ে দেবেন। বৈচিত্রের প্রতি অসহনশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ এই সব কথায়। সংখ্যাগুরুবাদকে তাতানোর জন্যই এ সবের দরকার হয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদ, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ যেহেতু সহজে হয় না, তাই অসহনশীলতা আমদানি করতে হয়। আমি তাই একে ভারতের গণতন্ত্রের নিজস্ব বিপদ বলব না, গণতন্ত্রেরই একটা সাধারণ সংকট বলব।
পশ্চিমবঙ্গেও কি এই অসহনশীল সংখ্যাগুরুবাদের বিপদ টের পাওয়ার সময় এসেছে?
পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের রাজনীতি আরও একটু কঠিন, কেননা আমাদের একটা ভিন্ন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ঘরানা আছে। কিন্তু বিপদ যে আছেই সেটা মনে রাখতে হবে। দেখা তো গেল, অসমে কী হল। জম্মু ও কাশ্মীরের পর ভারতের সবচেয়ে বেশি মুসলিমের বাস অসমেই, অথচ সেখানেও বিজেপি জিতল। তবে যে সব রাজ্যে বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস, সেখানেই এমন ঘটা সহজ। শক্তসমর্থ আঞ্চলিক দল থাকলে কিন্তু বিজেপি সহজে এগোতে পারে না। বিহারে আঞ্চলিক দলগুলি একসঙ্গে হতেই বিজেপি পিছু হটল। ভারতের বড় প্রেক্ষিতটা মাথায় রাখা জরুরি। এটা ঠিকই যে, কোনও দলই এ দেশে সর্বাংশে ভাল নয়, সব দলেরই কলঙ্ক আছে। কিন্তু আমরা যেন ভুলে না যাই, বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের বিপদটা আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের দিক থেকে কত বড়, কত বিরাট মাত্রার। আমি যখন এখানে নির্বাচনে লড়ছিলাম, অনেক দুশ্চিন্তা করছিলেন যাদবপুর কেন্দ্রের ভাঙড় এলাকা নিয়ে। আমি একটাই কথা বলেছিলাম, আপনাদের দুশ্চিন্তা ভাঙড় নিয়ে, আমার দুশ্চিন্তা ভারত নিয়ে। কী ধরনের একটা সরকার হতে চলেছে দেশে, কী ধরনের ক্ষমতা তারা পেয়ে যাবে, সেটা তো ভাবতে হবে। মাত্রাবোধ থাকাটা জরুরি।
দাঁড়ালেন না কেবল গাঁধী
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়ে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত একটি প্রার্থনাসভা হয়েছিল। তখনও ‘জনগণমন’ জাতীয় সংগীত হয়নি, মঞ্চে ‘বন্দে মাতরম’ গানটি হওয়ার সময়ে সকলে উঠে দাঁড়ালেন, বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দিও দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেন না কেবল গাঁধী। বললেন, ওটা একটা পাশ্চাত্য প্রথা, ভারতীয় সংস্কৃতিতে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা দেখানোর চল নেই। দুঃখের বিষয়, গাঁধী বা রবীন্দ্রনাথ কী বলতেন, কী ভাবতেন, এই ভারতে তা কেউ জানেও না, কারও জানার আগ্রহও নেই।
আপনার কি মনে হয়, নাগরিক সমাজেও অসহনশীলতার বিরোধিতা ক্রমশ কমে আসছে? বলিউডের কথা যদি ভাবি: সত্যিই তো পাকিস্তানি অভিনেতাদের অভিনয় নিষিদ্ধ হয়ে গেল, এক ধাক্কায় আমরাও অনেকখানি ‘পাকিস্তান’ হয়ে গেলাম।
বলিউডের বড় বড় প্রযোজক, পরিচালকরা যে ভাবে ক্ষমা চাইলেন, হুমকি মেনে নিলেন, দেখে সত্যি দুঃখ হল। একটা ছোট আঞ্চলিক পার্টি, এখানে ওখানে বিক্ষোভ করে বেড়ায়, তাদের কাছে গিয়ে ওঁরা সারেন্ডার করলেন! পিছনে বড় সমর্থন আছে বলেই এটা ঘটতে পারল। আমার বিশ্বাস, এখনও আশা আছে, এখনও প্রতিবাদীরা আছেন। তবে এটা ঠিক, এই ধরনের সরকার যদি দশ বছর থাকে, দেশের চরিত্র সত্যিই পাল্টে যাবে। ২০১৭ সালটা তাই ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হওয়া উচিত। বছরের শেষে এসে অন্তত দেখছি, বিরোধীরা একটু কথা বলতে পারছে। আঞ্চলিক স্বার্থের ওপরে উঠে গোটা দেশের কথা ভেবে রাজনীতি জরুরি। এখনও তার স্পষ্ট চিহ্ন না থাকলেও সেই দিকে এগোনোর একটা ইশারা দেখছি। কেবল রাজনীতির নয়, সামাজিক ক্ষেত্রেও সেই প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ দরকার।
অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী ধারার উল্টো দিকে হাঁটতে হবে...
হ্যাঁ। একটা কথা এখানে। ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের বলেছিলেন, এটাই তোমাদের ‘শেষ সুযোগ’। আসল কথা, সাবঅলটার্ন, পশ্চাৎপদ, সংখ্যালঘু, কিংবা সমাজের সুযোগসুবিধা-বঞ্চিত মানুষরা ক্ষমতার বেশি কাছাকাছি এসে পড়লেই সমাজের মূলস্রোত থেকে ‘ব্যাকল্যাশ’ বা প্রতিক্রিয়ায় এই শভিনিজম, সংকীর্ণ উগ্র জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়। আমেরিকায় এ বারের ঘটনাটাকে অনেকেই বলছেন ‘হোয়াইটল্যাশ’। ভারতের ঘোর হিন্দুত্ববাদও কিন্তু সেই একই ব্যাকলাশ, প্রতিক্রিয়া। এখন, এ যদি এত দিনের ক্ষমতাধারীদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ‘শেষ সুযোগ’ বা উদভ্রান্ত প্রতিরোধ হয়, তবে ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গা অবশ্যই রয়েছে। আমেরিকার সঙ্গে যদিও ভারতের একটা তফাত আছে— ওখানে তরুণ প্রজন্ম ট্রাম্পকে ভোট দেয়নি, ভারতে মোদী কিন্তু ২০১৪ সালে তরুণ ভোট অনেকটাই পেয়েছিলেন। তবে সেটা উন্নয়নের আশায়। আমার বিশ্বাস, সব সময় যদি কেউ বানানো এবং ভুল প্রতিশ্রুতির ফাঁদে মানুষকে ফেলতে চায়, মানুষ সেটা বোঝেন। পরের বার ওই সমর্থন আর মোদী পাবেন বলে মনে হয় না।
সংসদের বক্তৃতায় আপনি একটা ভিন্ন জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। এই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিবাদের মধ্যে কি জাতীয়তাবাদের কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে?
এই প্রসঙ্গে, ২০১৬ সালে দাঁড়িয়ে আমি মনে করব ১৯১৬ সালের কথা। রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়েছেন প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে। প্রথমেই জাপানে বক্তৃতা করলেন, তার পর আমেরিকায়। জাতীয়তাবাদের উগ্র চরিত্রের সমালোচনা করলেন। ১৯১৭ সালে ম্যাকমিলান প্রকাশ করল সেই ছোট্ট বই: ন্যাশনালিজম। আশা করি, ২০১৭ সালে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা একটু বইটা পড়ে দেখবে। উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনা মানেই তো জাতীয়তাবাদকে ছুড়ে ফেলা নয়। দেশবন্ধু বা সুভাষচন্দ্রও ভেবেছিলেন, আমাদের এমন একটা জাতীয়তাবাদ চাই যেটা আমাদের মধ্যে আত্মশক্তি আর সৃষ্টিশীলতা তৈরি করবে, দেশের জন্য সেবার ব্রত এনে দেবে। রবীন্দ্রনাথও দেশপ্রেমিক ছিলেন। কোনও তৈরি-করা জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি অন্ধ সমর্থন নয়, তাঁর একটা ভিন্ন ধরনের জাতীয় আবেগ ছিল। তাই আজ আমাদের কাজ, উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে জাতীয়তাবাদকে উদ্ধার করা। ঠিক এই বোধ থেকেই আমি সংসদের বক্তৃতায় নিজেকে জাতীয়তাবাদী বলেছি। আজ যাঁরা নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে ঢাক পেটান, তাঁদের থেকে নিজেকে আলাদা করেছি, কারণ আমার জাতীয়তাবাদ আমি শিখেছি রবীন্দ্রনাথ, গাঁধী, সুভাষচন্দ্রের কাছ থেকে। একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়ে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত একটি প্রার্থনাসভা হয়েছিল। তখনও ‘জনগণমন’ জাতীয় সংগীত হয়নি, মঞ্চে ‘বন্দে মাতরম’ গানটি হওয়ার সময়ে সকলে উঠে দাঁড়ালেন, বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দিও দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেন না কেবল গাঁধী। বললেন, ওটা একটা পাশ্চাত্য প্রথা, ভারতীয় সংস্কৃতিতে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা দেখানোর চল নেই। দুঃখের বিষয়, গাঁধী বা রবীন্দ্রনাথ কী বলতেন, কী ভাবতেন, এই ভারতে তা কেউ জানেও না, কারও জানার আগ্রহও নেই।
সেই আগ্রহ যদি ফেরে, একটা নিম্নগামী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ থেকে সরে এসে সত্যিকারের দেশপ্রেম বা দেশবোধের দিকে যদি একটুও এগোনো যায়, ২০১৭ সালের জন্য সেটাই আমার আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy