বিশ্বছবি: রাষ্ট্রপুঞ্জের পঁচাত্তরতম সাধারণ বৈঠকে অনলাইন উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, নিউ ইয়র্ক, ২৬ সেপ্টেম্বর। ছবি: এএফপি।
পাশের স্টেট নিউ জার্সির বিজন জনপদ, নয়নশোভন পার্ক, কন্ডোমিনিয়াম কুটিরগুলি থেকে পৌনে ঘণ্টার ট্রেন সফরে নিউ ইয়র্ক শহরে ঢোকার পর মনে হয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গ্রহে এসে পড়া গেল বুঝি। ভিড়ে ভিড়াক্কার, যানজট, দু’কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে লেগে যেতে পারে এক ঘণ্টা। আর সময়টা যদি সেপ্টেম্বর হয়? অর্থাৎ, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশন চলে? তা হলে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ারই পরামর্শ দেবেন স্থানীয়রা। সড়কপথ সম্পূর্ণ ভাবে যানজটে বন্দি। গোটা বিশ্বের রাষ্ট্রনেতা এবং তাঁদের মন্ত্রী, সান্ত্রি, কর্তাদের ভিড়ের দখলে মানহাটান। নিরাপত্তা বলয়, কনভয়, ভিআইপি রুটের ঝক্কিতে দিশেহারা সাধারণ নাগরিকরা।
কিন্তু এবারে রাষ্ট্রপুঞ্জের ৭৫তম সাধারণ অধিবেশনটি কাটল আড়ম্বরহীন, নির্জনতায়। বেশির ভাগ বক্তৃতা, বৈঠক, সেমিনার হল অনলাইন সংযোগে। যে যাঁর দেশ এবং শহরে নিজের অফিস বা বাড়িতে বসে পৌঁছে গেলেন ইস্ট নদীর পাশে রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই ঐতিহ্যময় দফতরে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এই শহরটিতে আসার ঝুঁকি নেননি বিশেষ কেউ। বাকিদের কথা ছেড়ে দিন। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এবার নড়েননি ওয়াশিংটনে তাঁর হোয়াইট হাউস ছেড়ে। সেখান থেকেই নিজের বক্তৃতা রেকর্ড করে পাঠিয়েছেন নিউ ইয়র্কে। সে জন্য অবশ্য কোভিড তাঁকে ছেড়ে কথা বলেনি, কিন্তু সে প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র।
বাইরের জাঁকজমক পঁচাত্তরে এসে মাঠে মারা পড়ল অতিমারির কারণে, এটা ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি এই সত্যও আড়াল করা যাচ্ছে না যে, অতিমারির কারণেই রাষ্ট্রপুঞ্জের ভিতরে তৈরি হওয়া দুর্বলতা, জাড্য, এবং রাষ্ট্রপুঞ্জকে ঘিরে অনাস্থা ও মৌরসিপাট্টার অভিযোগও প্রকাশ্যে চলে এল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শান্তির পায়রা উড়িয়ে যে প্রতিষ্ঠানের জন্ম, করোনা যুদ্ধের আবহে কার্যত তার কঙ্কাল এখন দেখতে পাচ্ছে বিশ্ববাসী। কোভিডের উৎপত্তি এবং বিশ্বজোড়া সংক্রমণ নিয়ে একটি আলোচনা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিজেদের রোয়াব খাটিয়ে তা হতে দেয়নি বেজিং। কোভিড সংক্রমণ প্রসঙ্গে বার বার প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র নিরপেক্ষতা নিয়ে। হু-এর উপর চিনের দাদাগিরি নিয়ে আন্তর্জাতিক শিবিরে বেজায় শোরগোল।
রাষ্ট্রপুঞ্জ তথা হু-কে চিন নিয়ন্ত্রণ করছে— এতে কি এতটাই বিস্মিত হওয়ার কোনও কারণ রয়েছে? রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্বপিতাসুলভ শান্তিকল্যাণ সিরিজ়ের বক্তৃতামালা সরিয়ে রাখলে কী পড়ে থাকছে? থাকে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের ক্ষমতার খেলা এবং টানাপড়েনের খেলা। বিশ্ব নিরাপত্তাকে যা নিয়ন্ত্রণ করে।
সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর কয়েকটা বছরকে বাদ দিলে বিশ্বের নিরাপত্তা নিয়ে কাঁধে কাঁধ মেলানো কোনও ঐক্যের ছবি কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতর বিশ্ববাসীকে দিতে পারেনি। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েট এবং মার্কিন লড়াইয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ কার্যত তালাবন্ধ থেকেছে। সোভিয়েট পতনের পর যা হয়েছে, তা সবই আমেরিকার তর্জনী-নিয়ন্ত্রিত। তিয়েন আন মেন স্কোয়ার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত বেজিং সে সময় আমেরিকা তথা পশ্চিম বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার জায়গায় ছিল না। একবিংশ শতকের শুরু থেকে চিন এবং রাশিয়া সম্মিলিত ভাবে আমেরিকার আধিপত্যের বিরোধিতা করতে শুরু করে। যা বাড়তে বাড়তে এখন পুরোদস্তুর এক যুদ্ধই বটে। গোটা বিষয়টি আরও জটিলতর হয়েছে এখন, কারণ পশ্চিম বিশ্ব নিজেরাই বহুবিভক্ত। ইরান-নীতিই হোক অথবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বা বিশ্ব উষ্ণায়ন— ইউরোপ এবং আমেরিকার মধ্যে মতপার্থক্য বাড়ছে বই কমছে না।
আগামী জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হচ্ছে ভারতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদের (অস্থায়ী সদস্য) দু’বছরের মেয়াদ। তার প্রস্তুতির কারণেই কিছুটা গত কয়েক মাস ধরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিদেশ মন্ত্রকের শীর্ষ কর্তারা ধারাবাহিক ভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্কার নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন (যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, গত মাসের শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে মোদীর বক্তৃতা)। কূটনীতিতে ধারাবাহিক ভাবে লেগে থাকার কোনও বিকল্প নেই। গলা ফাটানো ছাড়া কিছু করারও নেই সাউথ ব্লকের। কিন্তু বাস্তব ছবিটা আপাতত কী, একবার দেখে নেওয়া যাক।
যিনি নৈরাশ্যবাদী, তাঁর মত, আগামী দু’বছর অশ্বডিম্ব প্রসব ছাড়া আর কিছুই করার নেই ভারতের। যিনি চরম আশাবাদী, তাঁর মনে হতে পারে নিজেদের সাবেক অবস্থান এবং দাবিকে নতুন করে তুলে ধরার জন্য এই সময়টাই সবচেয়ে ভাল। আর এক জন সক্রিয় কূটনীতিবিদের মতে, বহুপাক্ষিক বিশ্বে নিজেদের ওজন বাড়িয়ে নেওয়ার জন্য সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আগামী দু’বছর।
আজ মোদী যে দাবি করছেন, তা নতুন কিছু নয় অবশ্য। ১৯৯৫ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের অর্ধশতবর্ষ পূর্তির সময় থেকেই ভারত নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের দাবি তুলে ধরছে। পরিষদের স্থায়ী কমিটির সম্প্রসারণ, আরও বেশি দেশকে সদস্য করার দাবি, বার্ষিক রুটিনে পরিণত। কিন্তু এই দিবাস্বপ্ন থেকে সাউথ ব্লকের বেরিয়ে আসারও সময় হয়ে গিয়েছে। আপাতত কোনও সংস্কারের ধারকাছ দিয়েও যে রাষ্ট্রপুঞ্জ হাঁটবে, তা স্পষ্ট নয়। তাই এবার আমেরিকার ঝুলন্ত গাজরটি থেকে মন সরিয়ে নেওয়াটা কাম্য। বরং রাষ্ট্রপুঞ্জ মানেই যে শুধু নিরাপত্তা পরিষদ নয়, এই কাণ্ডজ্ঞান মোদী সরকারের থাকা প্রয়োজন। আর সেই কাণ্ডজ্ঞান নিজেদের বিদেশনীতিতে আমদানি করতে বাইরের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। নিজেদের ইতিহাসের পাতা উল্টোলেই হয়। ঠান্ডাযুদ্ধের সময়, যখন নিরাপত্তা পরিষদ অকেজো, ভারত সফল ভাবেই নিজস্ব একাধিক বহুপাক্ষিক কর্মসূচিকে সামনে নিয়ে আসতে পেরেছিল। তা সে ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতাই হোক বা অস্ত্র সংবরণ চুক্তি বা নতুন অর্থনৈতিকব্যবস্থা গড়ে তোলা। আন্তর্জাতিক সমর্থনও সংগ্রহ করা গিয়েছিল।
তবে এটাও মনে রাখা দরকার বর্তমান ঘনকৃষ্ণ সময়ে, আত্মনির্ভরতা থেকে বসুধৈব কুটুম্বকমের মতো শাস্ত্রসিদ্ধ ভাবনার কথা মুখে আওড়ানো ভাল। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থের সঙ্গে বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থার সংযোগের দিকটি থেকে চোখ সরালে বিপদ হতে পারে, সে কথাটাও খেয়াল রাখা দরকার। চিন এবং পাকিস্তান যখন কাশ্মীরের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রবল চাপ তৈরি করেছে, সে সময় ভারতের বহুপাক্ষিকতা যেন দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
শুধুমাত্র সীমান্ত শান্তিপূর্ণ এবং শত্রুমুক্ত রাখাটাই তো একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং পরিবেশগত অদলবদল এবং ভাঙাগড়ার এই সন্ধিক্ষণে নিজেদের সমৃদ্ধি এবং স্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখাটাও বড় কম জরুরি নয়। এ কাজে রাষ্ট্রপুঞ্জকে ব্যবহার করা, শক্তিশালী জোট গঠন করা, বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে নতুন আইনকানুন তৈরিতে নিজেদের ভূমিকাকে জোরদার করা, আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়াতে সামান্য হলেও রাষ্ট্রপুঞ্জের বাজেটে নিজেদের অবদান বাড়ানোর (যা কিনা মাত্র ০.৭ শতাংশ, চিনের যা ৮ শতাংশ) পদক্ষেপগুলি অতি প্রয়োজনীয় এখন।
তা না হলে, রাষ্ট্রপুঞ্জকে ঢেলে সাজানো এবং বহুপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থা সংক্রান্ত বক্তৃতাগুলি শূন্যগর্ভ হয়েই থেকে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy