আজ আপনাদের ইন্দিরা গাঁধীর বিদেশ সচিব মহারাজা কৃষ্ণ রাসগোত্রের গপ্পো শোনাব। পাক প্রেসিডেন্ট জ়িয়া উল হকের সঙ্গে ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গাঁধী এক যুদ্ধবিরোধী শান্তি চুক্তি করেছিলেন। তার সলতে পাকানোর কাজটা করেছিলেন পঞ্চনদের তীরের বাসিন্দা রাসগোত্র। বিদেশ সচিব হতে না হতেই রাসগোত্রকে ইন্দিরা পাঠান ইসলামাবাদ। সেখানে তিনি ছিলেন টানা আট দিন। পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি, সার্ক গঠন হয়েছে ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। আর রাসগোত্র বিদেশ সচিব হয়েছেন ’৮২-তে। সার্ক গঠনের মধ্যে তখন পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র দেখছে ইসলামাবাদ। সার্ক কেন ভাল ব্যাপার, জ়িয়াকে সেটা বোঝানোটাও ছিল রাসগোত্রের বড় কাজ।
তা যা হোক, রাসগোত্র যে দিন ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট হাউসে ঢুকলেন, দেখলেন জ়িয়া সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে। জড়িয়ে ধরলেন। তার পর আলাপ করালেন তাঁর বিদেশ সচিব নিয়াজ় নায়েকের সঙ্গে। এর পর রাসগোত্র এবং নায়েক টানা তিন বছর আলোচনা চালান।
লাহৌর কলেজে পড়া সুদর্শন রাসগোত্র প্রেসিডেন্ট সাহেবকে খুশি করার জন্য বললেন, আপনারা চান, তাই এ বার আমরা কাশ্মীর নিয়ে পর্যন্ত আলোচনা করতে প্রস্তুত। জবাবে ভারতের বিদেশ সচিবকে অবাক করেই জ়িয়া বলেন, হোয়াট ইজ় দেয়ার টু টক অ্যাবাউট কাশ্মীর? আপনাদের কাছে যে কাশ্মীর আছে তা তো নিতে পারব না। বরং আমি চাইছি আপনি আর নিয়াজ় দু’জনে মিলে একটা শান্তি চুক্তির খসড়া তৈরি করে ফেলুন।
১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১— তিন তিনটে যুদ্ধের পর সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট জ়িয়া বুঝেছিলেন, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। পারভেজ় মুশারফ আর এক জন সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট, তিনি জ়িয়ার প্রিয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। কিন্তু জ়িয়ার মতো তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি আর একটা কার্গিল যুদ্ধ করে বুঝলেন, আগরা গিয়ে কথা বলাই শেষ সমাধানের পথ।
জ়িয়া উল হক রাসগোত্রকে এক অভিনব প্রস্তাব দেন। দু’মাস পরেই প্রেসিডেন্টের ইন্দোনেশিয়া যাত্রা ছিল। তিনি বললেন, আমি দিল্লি বিমানবন্দরে নামব। ইন্দিরাজির সঙ্গে দেখা করে জাকার্তা চলে যাব। রাসগোত্র ফিরে এসে বলতেই ইন্দিরা বললেন, বিমানবন্দরে কেন? রাষ্ট্রপতি ভবনে মধ্যাহ্নভোজন করে যান তিনি। সেই মধ্যাহ্নভোজনের কূটনীতি দেখে চটে যান ইন্দিরার প্রাক্তন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার। তিনি চিঠি লিখে রাসগোত্রকে বলেছিলেন, ভুট্টোর হত্যাকারীর সঙ্গে লাঞ্চ? ইন্দিরাকে বললে তিনি রাসগোত্রকে বললেন, ইগনোর। উনি অতীতে বসবাস করছেন আজকাল! আলোচনা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা আছে কি?
ইমরান খান পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। আবার প্রশ্ন, ভারত পাক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এ বার কী হবে? ইমরান তো সেনাবাহিনীর রোবট। চিনের অঙ্গুলিহেলনে চলবেন? ভারতের সঙ্গে শত্রুতা বাড়বে? সত্যি কি তাই? ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে মোদী সরকারের পক্ষে কোনও শান্তি পর্ব শুরু করার সম্ভাবনা কম। বরং গ্যালারি শো হিসাবে ‘যুদ্ধু যুদ্ধু’ ভাবটা বজায় রাখা দরকার। নির্বাচনী প্রচারে শিরা ফুলিয়ে বিজেপি নেতারা বলবেন, পাকিস্তানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে শেষ করে দেব! ঠিক ইমরান যেমন ভারতবন্ধু ভাবমূর্তি বদলে ভারতবিরোধী বিবৃতির ফুলঝুরি জ্বালিয়েছিলেন প্রাকনির্বাচনী পাকিস্তান রাজনীতিতে।
তবে প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি ভারতের সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন। ভুললে চলবে না, পাক সেনাপ্রধান গত এক বছর ধরে নিজেই আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে চলেছেন। ট্রাম্প সাহেব উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছেন, পুতিনের সঙ্গে সন্ধি করে বিশ্ব জুড়ে উত্তেজনা কমানোর আবহ তৈরি করছেন! ভারত পাক দু’পক্ষের উপর চাপ দিচ্ছেন: যুদ্ধ নয়। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে টাকা দেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন! উল্টে বলি পাকিস্তানের এক কূটনীতিক আমাকে বললেন, জনাব, এখন পাকিস্তানের আর্থিক বৃদ্ধি, ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি ইমরানকে দেখাতেই হবে, তা না হলে সেখানে গৃহযুদ্ধ হবে!
তাই আলোচনা, আলোচনা এবং আলোচনা। কথা বলতেই হবে। পুরনো কংগ্রেস নেতাদের একটা তত্ত্ব ছিল, কাশ্মীর সমস্যা সমাধান নিয়ে ভারত পাকিস্তান নাটকের দরকার কী? ভারতের এ সমস্যা সমাধানে কোনও তাড়া নেই। তাই মনমোহন জমানায় বিদেশ মন্ত্রী হিসেবে ইসলামাবাদ গিয়ে নটবর সিংহ বলেছিলেন, আপনাদের কাছে কাশ্মীর সমস্যা একশো মিটার দৌড়, আমাদের কাছে এটি ম্যারাথন! মনমোহন নিজে সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। শার্ম এল শেখ-এর সেই যৌথ বিবৃতি মনে আছে তো? যেখানে বালুচিস্তানের নাশকতার দায়িত্ব ভারত কার্যত স্বীকার করে নেয়, যার জন্য দলেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। মনমোহন পাকিস্তান যেতে চান, কিন্তু ভোটের আগে দল যেতে দেয়নি। আবার বাজপেয়ী জমানায় পারভেজ় মুশারফ আগরা বৈঠকে আসতে চাইলে আডবাণী এবং সঙ্ঘ আপত্তি করেছিলেন: সামরিক শাসনকে ভারত কেন বৈধতা দেবে? বাজপেয়ী তাঁদের কথা উড়িয়ে দিয়ে ডেকেছিলেন পারভেজ়কে। তাঁর বক্তব্য ছিল: পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান ওদের দেশের ব্যাপার। আমাদের কাছে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান। আর দেশটা যখন সেনা চালায় তখন তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলাই তো ভাল!
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়েই বাজপেয়ী হতে চেয়েছিলেন! নওয়াজ়কে শুধু শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেই আমন্ত্রণ করেননি, তাঁর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করে ফেলেন। অতঃ কিম্? হুরিয়ত নেতাদের দিল্লিতে পাক হাই কমিশনে ডাকা নিয়ে ঝগড়া! বিদেশ সচিব পর্যায়ে বৈঠক বাতিল! আবার নাটকীয় ভাবে প্রোটোকল ভেঙে নওয়াজ়ের মেয়ের বিয়েতে তাঁর বাড়ি পৌঁছে যাওয়া, একাধিক বার দেখা ও সুমিষ্ট ভাষণ। মধ্যস্থতাকারীদের সরিয়ে মোদী নিজেই কথা বলতে শুরু করেন নওয়াজ়ের সঙ্গে। ধীরে ধীরে বোধোদয় হল— নওয়াজ় আশ্বাস যা-ই দিন, দেশটা চালায় সেনা! তার পর হতাশ হয়ে ঝগড়া! বিদেশ নীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব!
একটা সময় ছিল যখন আমরা কাশ্মীরকে ‘কোর ইসু’ বলে মানতাম না। আলোচনাকে বলতাম, কম্প্রিহেনসিভ ডায়ালগ— সামগ্রিক মতবিনিময়। আলোচনা করতে গেলে সিয়াচেন, স্যর ক্রিক থেকে কাশ্মীর, সব নিয়েই কথা বলতে হবে! আগরা শীর্ষ বৈঠকে ভারত প্রথম মেনে নিয়েছিল কাশ্মীর কোর ইসু, আমরা আলাদা করে কথা বলতে প্রস্তুত। কোর ইসু কথাটা পারভেজ়ের দেওয়া। উদার বাজপেয়ী মেনে নেন। নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যেমন হুরিয়তের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। তিনি এই আলোচনায় কোনও দোষ দেখেননি!
মোদী সরকারকেও আজ বুঝতে হবে, একটা নির্বাচনের জন্য আবার হঠকারী নাট্যানুষ্ঠান দেশের জন্য উচিত কাজ কী? বরং জ়িয়া থেকে পারভেজ় যা বুঝেছিলেন, ইন্দিরা থেকে বাজপেয়ী, মনমোহন যা উপলব্ধি করেছিলেন, সেই সত্য সম্পর্কে যদি মোদী সরকারের বোধোদয় হত তবে ভোটের রাজনীতি ত্যাগ করে ভারত-পাক সম্পর্ককে সত্বর সহজ করতে ধাপে ধাপে এগোনোর রোড ম্যাপ তৈরি করতেন মোদী! যেমনটা একাত্তরের যুদ্ধের এক দশক পর ইন্দিরা করেছিলেন রাসগোত্রকে পাঠিয়ে!
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিক মোদী সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy