দীপা, সাক্ষী এবং সিন্ধু
নিঃসন্দেহে একটা আনন্দের দিন। অলিম্পিক্সের আসরে সাক্ষী মালিক ভারতের হয়ে এ বারের প্রথম পদকটা আগেই পেয়েছেন। এ বার পি ভি সিন্ধুও পদক নিশ্চিত করলেন। রৌপ্য নিশ্চিত। স্বর্ণ পদকও আসতে পারে। মনটা খুশিতে ভরে ওঠার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কিন্তু গৌরবে বহুবচন হয়ে ওঠার কোনও অধিকার আমাদের নেই। সাক্ষী বা সিন্ধুর জয়ের পর তাঁদের গৌরবের শরিক হওয়ার যে হিড়িক আমরা জুড়ে দিয়েছি, তার অধিকার সত্যিই আমাদের নেই।
গৌরব যদি সত্যি কারও থেকে থাকে, তা হলে তা সাক্ষী মালিকের, পি ভি সিন্ধুর। দীপা কর্মকারেরও। অসংখ্য প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে আরও যাঁরা রিও অলিম্পিক্সের আসরে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে হাজির হতে পেরেছেন, গৌরব তাঁদের প্রত্যেকের। এ দেশ থেকে অলিম্পিক্সের আসরে পৌঁছতে পারাই গৌরবের। এবং নিতান্তই ব্যক্তিগত কৃতিত্বের।
ভারত থেকে যাঁরা অলিম্পিক্সে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন, যোগ্যতা অর্জনের পথে তাঁদের আমরা কতটুকু সাহায্য করতে পেরেছি? পরিকাঠামো নেই, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নেই, পর্যাপ্ত উৎসাহ নেই। খেলধুলোই যে জীবন হতে পারে, খেলার মাঠ থেকেই যে আকাশ ছোঁওয়া যেতে পারে, সেটুকু উপলব্ধি করার সংস্কৃতিও নেই। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, সরকারি কর্তা, নিদেন পক্ষে স্কুল শিক্ষক হওয়া জীবনের মোক্ষ। কন্যাসন্তান হলে তো কথাই নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্রস্থ করার তাড়না। সংস্কৃতিটাই এমন। খেলার ময়দানটাও অনেক বড়, সেখানেও অনেক সম্ভাবনার আনাগোনা, সেও জীবনের মোক্ষ হতে পারে, এই বোধই নেই আমাদের সংস্কৃতিতে। ফলে সরকারি সাহায্যও নেই। খেলোয়াড়কে গড়ে তুলতে বেসরকারি সহায়করাও তেমন একটা উৎসাহ বোধ করেন না। দীপা কর্মকার, সাক্ষী মালিক, পি ভি সিন্ধুরা এবং আরও কেউ কেউ এত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে এবং প্রায় পুরোটাই ব্যক্তিগত প্রয়াসে অলিম্পিক্সের আসরে পা রাখার টিকিটটা জোগাড় করতে পারলেই, তাঁদের থেকে আমাদের প্রত্যাশার আর অন্ত থাকে না। পদক জিততে পারলে সবাই সেই গৌরবের ভাগীদার। আর জিততে না পারলেই দেশজোড়া হা-হুতাশ। কেউ কেউ আবার গালিগালাজও করতে থাকি।
প্রত্যেক ভারতবাসীর বোঝা উচিত, অলিম্পিক্সের আসরে ভারতীয় প্রতিযোগীরা পদক জিততে না পারলেও তাঁদের গালিগালাজের কণামাত্র অধিকার আমরা রাখি না। কেউ সাফল্য পেলে, তাঁর গৌরবে ভাগ বসানোর চেষ্টা করাও যারপরনাই অনুচিত। আনন্দিত হতে পারি মাত্র। ভবিষ্যতে তাঁকে আরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করার সঙ্কল্প নিতে পারি। কিন্তু কেউ অসফল হলেও হা-হুতাশে অংশ নিতে পারি না কোনও ভাবেই। কারণ অলিম্পিক্সে অংশ নেওয়ার যোগ্যতামান উত্তীর্ণ হচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা অলিম্পিক্সের আসরে ভারতের নামটুকু জিইয়ে রাখার কাজটা অন্তত করে দিচ্ছেন। অসংখ্য প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়েই সেটুকু করছেন ভারতীয় প্রতিযোগীরা। সেই লড়াইতে আমরা তাঁদের প্রায় কোনও সাহায্যই দিই না। বছরভর বা চার বছর ধরে তাঁদের খোঁজই রাখি না। অলিম্পিক্সে তাঁরা আশা জাগালেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দিন কয়েক তাঁদের নিয়ে হইচই শুরু করি।আবার ভুলেও যাই অচিরেই। যে সব খেলার পিছনে কর্পোরেট জগৎ বিপুল অর্থ ব্যয় করে, সেই সব খেলা নিয়েই মেতে থাকি বছরভর। সেই খেলোয়াড়দের নিয়েই নিত্যদিনের চর্চা আমাদের। কিন্তু এই বিপুল অর্থ ব্যয়, এই বৃহৎ স্পনসরের সহায়তা, দেশজুড়ে এই বছরভরের উৎসাহ যদি আমাদের অলিম্পিয়ানরা পেতেন, তা হলে পদক তালিকার ছবিটা যে অন্য রকম হতে পারত, সে কি আমরা বুঝতে পারছি? যদি বুঝতে পারি এবং নিজেদের বদলাতে পারি, তা হলে ভবিষ্যৎ অলিম্পিয়ানদের সাফল্যের ভাগীদার আমরাও হব। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত অলিম্পিক্স নিয়ে আমাদের বা এই রাষ্ট্রের কোনও গৌরব নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy