Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

যুদ্ধের কাহিনিতে মিশে যায় চরিত্রের দ্বন্দ্ব

বইটির নাম বাংলায় অনুবাদ করলে হতে পারে ‘আমাদের জলাভূমির গান’। বইটি পড়া শেষ হলে মনে এক ধরনের মুগ্ধতা বোধ এল, কিন্তু পরিতৃপ্তি নয়। মুগ্ধতার সঙ্গে মিশে আছে এক মর্মযন্ত্রণার অনুভূতি। অনেক কাল আগে বালিকা বয়সে এমিলি ব্রন্টের উদারিং হাইটস্ পড়া শেষ হলে একই ধরনের ভাল লাগার বোধ ছিল, কিন্তু মানসিক ভাবে অত্যন্ত ডিসটার্বড, কী বলব, এক তীব্র দুঃখবোধ অনুভব করেছিলাম। সমালোচকেরা বলেন উদারিং হাইটস নভেলটি ‘মরবিড’ বিষাদগ্রস্ত। লেখক সৈয়দ মানজুরুল (মানজু) ইসলামের বইটিকে কখনওই ‘মরবিড’ আখ্যা দেওয়া যাবে না। এ তো এক উত্তাল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের কাহিনি।

কৃষ্ণা বসু
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

বইটির নাম বাংলায় অনুবাদ করলে হতে পারে ‘আমাদের জলাভূমির গান’। বইটি পড়া শেষ হলে মনে এক ধরনের মুগ্ধতা বোধ এল, কিন্তু পরিতৃপ্তি নয়। মুগ্ধতার সঙ্গে মিশে আছে এক মর্মযন্ত্রণার অনুভূতি। অনেক কাল আগে বালিকা বয়সে এমিলি ব্রন্টের উদারিং হাইটস্ পড়া শেষ হলে একই ধরনের ভাল লাগার বোধ ছিল, কিন্তু মানসিক ভাবে অত্যন্ত ডিসটার্বড, কী বলব, এক তীব্র দুঃখবোধ অনুভব করেছিলাম। সমালোচকেরা বলেন উদারিং হাইটস্ নভেলটি ‘মরবিড’ বিষাদগ্রস্ত। লেখক সৈয়দ মানজুরুল (মানজু) ইসলামের বইটিকে কখনওই ‘মরবিড’ আখ্যা দেওয়া যাবে না। এ তো এক উত্তাল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের কাহিনি। প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বা কাহিনিগত ভাবে এমিলি ব্রন্টের বইয়ের সঙ্গে কোনও সাদৃশ্য নেই। তবু জলাভূমির উপরের কুয়াশার মতোই এক বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন সমগ্র কাহিনি।

গল্পের শুরু হয়েছে পূর্ব বাংলার (অধুনা বাংলাদেশের) এক অখ্যাত ক্ষুদ্র গ্রামে। যেখানে বড় হয়ে উঠেছে আমাদের কাহিনির নায়ক, যার নাম কামাল। গৃহকর্তা মাস্টারমশাই আব্বাস মিঞা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। আব্বাস ও তাঁর স্ত্রী আতা বালু ছিলেন সন্তানহীন দম্পতি। কিন্তু কামালকে কুড়িয়ে পাওয়ার বছর দুয়েক বাদে তাদের কন্যা মণি বানু জন্মগ্রহণ করে। কামাল ও মণি বানু একসঙ্গে বড় হয়ে উঠছে। কিন্তু কামাল ঠিক পালিত পুত্র নয়, সে বাড়ির কাজকর্ম, খেতের কাজ, সব করে। আবার তাকে ঠিক ভৃত্যও বলা যাবে না। মাস্টারমশাই তার প্রতি স্নেহশীল। প্রতি সন্ধ্যায় দুজনকে পড়াতে বসেন তিনি। তবে কামাল যে পড়াশুনো শিখছে, তা গোপন।

কুড়িয়ে পাওয়া কামাল স্বাভাবিক নয়, সে বিকলাঙ্গ। লেখক তাকে এমন এক ধরনের বিকলাঙ্গ করে এঁকেছেন যে পাঠকের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। তার ঠোঁট, চিবুকের অংশ, অর্ধেক জিভ নেই। মুখের কাছে শুধু এক গহ্বর। অন্য দিকে সে সুগঠিত দেহ, বুদ্ধিদীপ্ত, মনের দিক থেকে অনেক পড়াশোনার ফলে দার্শনিকোচিত। সে কথা বলতে পারে না। লোকসমক্ষে খাদ্যগ্রহণও সংকোচের ব্যাপার। তাকে দেখে অনেকে ভীত হয়, কেউ বা হাসি-ঠাট্টা করে। লেখক তাকে মূক-বধির করতে পারতেন, এত ভয়াবহ কেন করলেন জানি না। এর মধ্যে কোনও প্রতীকী ভাবনা থাকতে পারে, অন্তরের সৌন্দর্য ও বাইরের বীভৎসতার বিপরীতধর্মী চিত্র।

উপন্যাসের সময়কাল আমাদের খুবই পরিচিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হল কাহিনির পটভূমি। ঘটনাপ্রবাহ শুরু হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিখ্যাত আহ্বান ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ উক্তির মাধ্যমে। স্বাধীনতার যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে শহরে, গ্রামে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নেমে পড়েছে নৃশংস ভাবে বিদ্রোহ দমনে। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের অনেক লেখক উপন্যাস লিখেছেন, কয়েকটি বিখ্যাত হয়েছে, আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন কোনও লেখক। তবু বলব, আলোচ্য উপন্যাসটির চরিত্র স্বতন্ত্র, স্বাদ আলাদা।

২৪ মার্চ ১৯৭১ মণি বানুর বিবাহ হয়ে গেল পাশের গ্রামের জাফর আলমের সঙ্গে। সূক্ষ্ম সম্পর্ক সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। মণি বানু আর কামাল ভাই-বোনের মতোই বড় হয়েছে, দুজনে দুজনকে ভালবাসে প্রাণাধিক। কিন্তু ভালবাসা কি কোনও সীমানায় আটকে থাকে! কামাল জানে, তার সব ভালবাসা সে উজাড় করে দিয়েছে মণি বানুকে। জাফর আলম দেশপ্রেমিক। তার ‘জয় বাংলা’ আহ্বানে গ্রামের যুবকরা জড়ো হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রথমে শহর দখল করে, তারপর গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। জাফর আলম আর মণি বানু ইন্ডিয়াতে চলে যায়। সামরিক ট্রেনিং নিয়ে তারা মুক্তিসেনাতে যোগ দেয়। যুদ্ধে জাফর আলমের মৃত্যু হলে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হন ‘ম্যাডাম’ অর্থাৎ মণি বানু।

মাস্টারমশাই আব্বাস মিঞা দুই কাঠমিস্ত্রি দিয়ে এক বড়সড় নৌকো বানিয়েছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে হলে নৌকায় নদীতে ভেসে পড়তে হবে। নদীর আঁকে-বাঁকে বাঁশঝাড়ের আড়ালে, নানান লতাগুল্মের পিছনে কোনও পাকিস্তানির সাধ্য নেই তাদের ধরতে পারে। অকস্মাৎই গ্রাম আক্রান্ত হল, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিল পাক সেনা। মাতৃসমা আতা বালু পুড়ে মারা গেলেন। প্রাণে বেঁচে যাওয়া ক’জন আশ্রয় নিল নৌকোতে। বাইবেলে বর্ণিত নোয়ার তরণীর মতো মহাপ্রলয়ের মধ্যে ভেসে চলল বিচিত্র চরিত্রের কিছু মানুষ। মাস্টারমশাইয়ের মতো মহৎ চরিত্রবান মানুষ যেমন আছেন, তেমনই আছে এক খুনি— গলা কাটা-ই তার একমাত্র কাজ, আছে কাঠুরে সুবান, সে শুধু জানে গাছ কাটতে। আসাদ আলি মুসলিম লিগের লোক, পাকিস্তানের সমর্থক, সুযোগ মতো সে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আছেন ধর্মপ্রাণ আলা মোল্লা। যাত্রা অভিনেতা ডক্টর মালেক। তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, নৌকোতে ‘মহাভারত’ নাটক করবেন, কাকে কোন চরিত্র দেওয়া যায় চিন্তা করছেন। হিন্দু নাটক শুনে আসাদ আলি মুখ বিকৃত করে। আলতা নুরি নামে যে কুরূপা প্রবীণা আছে, তাকেই দ্রৌপদী করা ছাড়া উপায় নেই।

কামাল জানে না তার ধর্ম কী! হাট-বাজারে তাকে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল কেউ। সেই শিশুকে ঘিরে হুঁকো-হাতে প্রবীণেরা ভিড় করেছিলেন। কেউ মত দিলেন নিচু জাতের হিন্দু হবে, মেথর বা চামার বা কামার। কেউ বলল, না, অভিজাত মুসলিম বংশ, বিকৃত শিশু বলে ফেলে দিয়েছে। অন্য কেউ বলল, খ্রিস্টান হবে, বৌদ্ধ হওয়াও বিচিত্র নয়। কামালের তাই ধর্ম নেই।

এরই মধ্যে এক অর্ধমৃত নারীকে উদ্ধার করে নৌকোয় তুলেছে তারা। দেখা গেল, কী সর্বনাশ, মেয়েটি ‘বিহারি’ অর্থাৎ শত্রুপক্ষ। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে বাঙালি-বিহারি যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়েছিল, তুলির আঁচড়ে তা ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। নোয়ার তরণীতে এক কুকুরও আছে।

মাঝে মাঝে নৌকো ঘিরে ফেলে শাম্পানে চড়ে আসা মুক্তি সেনা, তাদের কমান্ডার কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ মণি বানু। কোনও এক সময়ে তাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হয় বিহারি মেয়েকে। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’— গান চোখে জল আনে কামালের। কিন্তু এই বিহারি মেয়েকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না।

পাক সেনারা ঘিরে ফেলে নৌকো কোনও সময়ে। নির্মম ভাবে হত্যা করে মাস্টারমশাই আব্বাস মিঞাকে। কোনও দিন দত্তক পুত্র বলেও স্বীকার করেননি তিনি কামালকে। এখানেও সম্পর্কের টানাপড়েন দেখিয়েছেন লেখক। এক মর্মান্তিক মুহূর্তে পাক সেনা কামালকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে— এ হিন্দু না মুসলমান? তিনি বলেন, আমার পুত্র। বেঁচে যায় কামাল।

এক আশ্চর্য চরিত্র হল সেই গলাকাটা খুনি। মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর তার এক আশ্চর্য উপলব্ধি হল। সে স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী, মনুষ্যত্ব আছে তার। কিন্তু এই উত্তরণের ফলে ম্যাডাম কমান্ডারের আদেশ সত্ত্বেও বিহারি মেয়েটিকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারল না সে। ফিরিয়ে এনে দিল কামালের কাছে, তারা তখন স্বামী-স্ত্রী। যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, যদি সে আবার সাধারণ খুনি হয়ে যায়, সেই ভয়ে নিজের মৃত্যু বেছে নিল সে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের কাহিনির সঙ্গে চরিত্রগুলির অন্তর্দ্বন্দ্ব মিলেমিশে যায়। বিহারি মেয়েটিকে প্রাণে বাঁচাতে হবে, তাই বিবাহে রাজি হয়েছিল কামাল, আন্তরিক ভাবে সে এক দেশপ্রেমিক। মেয়েটি বলে, তার বাবা-মা পাকিস্তানপন্থী, প্রাণ দিয়েছে মুক্তি সেনার হাতে। কামালও প্রত্যক্ষ করেছে পাক বাহিনীর গণহত্যা। তার প্রিয়জনেরাও নিহত হয়েছে চোখের সামনে। তবুও ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’— তারা পরস্পরকে ভালবাসে। তাদের কন্যার নাম হয় মণি বানু। কথা বলতে পারে না কামাল, সে লিখে রেখে যায় পড়ে-পাওয়া হিসেবের খাতার মধ্যে তার জীবনস্মৃতি। সেই হিসেবের খাতাসমেত ছোট্ট মণি বানুকে দত্তক নিয়ে ইংল্যান্ড চলে যান এক ইংরেজ দম্পতি। জীবন বয়ে চলে তার নিজের মতে।

লেখক মানজু ইসলাম গ্লস্টারশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। পিএইচ ডি করেছেন ঔপনিবেশিকতা-উত্তর সাহিত্যে ও সৃষ্টিশীল লেখাতে। এই পরিচিতি বইয়ে আছে। কৌতূহল হওয়ায় খোঁজ নিয়ে জানলাম, তিনি বাংলাদেশ যুদ্ধের স্বাধীনতা সংগ্রামী নজরুল ইসলামের পুত্র। নজরুল ইসলাম, তাজুদ্দিন প্রমুখ কলকাতায় যুদ্ধের সময় সুপরিচিত ছিলেন। পরবর্তী কালে ঢাকায় জেলে বন্দি অবস্থায় তাঁদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE